পর্বতচূড়ার দেশ আমার দেখা ভূটান

Share on Facebook

রাতের থিম্পু দেখে রুমে এসে শুয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুম এসেছিল, তা আর বুঝিনি। ঠক ঠক করে দরজার কড়া নাড়ল। সাথে ডাকাডাকি, ‘Hello! Wake up please’। দরজা খুলতেই দেখি, গাকি চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে। সকালের শুভ্র শিশির তখনও গড়িয়ে পরেনি, দূর্বা ঘাসের পাতায় মুক্তার দানার মত জল জল করে জ্বলছে। শিশিরের অমন রূপ দেখে চোখের পলক পড়বে কিন্তু গাকির দিকে তাকিয়ে নয়। অসজ্জিত গাকি প্রকৃত সৌন্দর্য নিয়ে আমার সামনে দন্ডায়মান। স্বর্গ থেকে ডানা মেলে উড়ে আসা পরীর মতো সুন্দরী গাকির চেয়ে কিচেন থেকে চা নিয়ে আসা অগোছালো গাকি অনেক বেশি সুন্দরী। বোকার মত চেয়ে আছি আমি, দেখছি তার সৌন্দর্য। কিন্তু এত বোকা আমি নই। চায়ের কাপ না ধরে ধরতে গেলাম তাকে, আর সে দিল দৌড়। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ইস!!!

সবদোষ ভারী কম্বলের।
রূমের মধ্যে পায়চারি করছি আর ভাবছি, আবার কখন আসবে এমন সুযোগ! এমন সময় আবারও কড়া
নাড়ল। আমিতো ঈদের মত খুশি! এবার কোথায় যাবি?
জবর প্রস্তুতি নিয়ে দরজা খুললাম। খুলতেই মেঘের গর্জন করলেন লুতফুল ভাই। আচ্ছা রাগারাগি
করে দিলো বড় ঝাড়ি- বাহিরে যেতে সবাই প্রস্তুত, অথচ তোমার এখনও ঘুমই ভাঙে নাই!
তুমিতো আস্ত নাদান। দুই মিনিটের মধ্যে বের না হলে তোমাকে রুমেই থাকতে হবে।

একটু নাদান আমি আছি
বৈকি, একটু তাই বলে কি এভাবে বলে! কাল বিলম্ব না করে দ্রুত তৈরি হয়ে নিলাম আমিও।
শুরু হল থিম্পু শহর ও আশপাশের সাইট সিয়িং। একে একে দেখা হল ন্যাশনাল লাইব্রেরী,
ফোক হেরিটেজ, মিউজিয়াম, টেক্সটাইল মিউজিয়াম, ন্যাশনাল মেমোরিয়াল, রয়েল প্যালেস, আর্চারি
গ্রাউন্ড, থিম্পু নদী, চাংখা লাখাং, বি বি এস টাওয়ার, ক্লক টাওয়ার, পার্লামেন্ট
ভবন। ঘুরতে ঘুরতে সাথে কেনাকাটাও। রাতে দেখা বুদ্ধা পয়েন্ট দিনের আলোতেও দেখে ষোল
কলা পূর্ণ হল।

অতি যতনে গড়া ১৭৭ ফুট
উচু বুদ্ধের প্রতিমাসহ বেশ সংখ্যক ব্রোঞ্জের তৈরি প্রতিমূর্তি সকালের সোনালী রোদে
ছড়াচ্ছে কাঁচা স্বর্ণের উজ্জ্বলতা। প্রাণহীন জীবন্ত প্রতিমা গুলো কালান্ত ধরে
ধ্যানমগ্ন। যা দেখে নিশ্চই বিস্মিত হবে মানুষ। ফ্রান্স, জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন
দেশ থেকে আসা পর্যটকদের সাথে দেখা হল, কথা হল, হল সৌজন্যতা। বাংলাদেশ দেখার
আন্তরিক নিমন্ত্রণ করা হল। হয়তো আসবে অথবা আসবেনা, তবুও শ্রদ্ধার সাথে নিমন্ত্রণ
গ্রহন করলো তারা। ইতিমধ্যেই গাকি প্রসঙ্গ সবার জানা শেষ। তাই বিভিন্ন সময় আমাকে
খোঁচা মেরে মজা করে, হাসি তামাশায় চলছে আড্ডা। আমাকে বোকা বানিয়ে তারা করে উল্লাস।
তবু আমি শরমহীন। যদি হয় ভালোবাসার জয়।

পুনাখার উদ্দেশ্যে
যাত্রা। পথে হবে দোচালা পাশ দর্শন। আপেল কমলার বাগান বেষ্টিত পথে পথচলা আর টাটকা
সে ফলের রসে নিজেদেরকে নিমজ্জিত করা আর গল্প আড্ডায় জমেছিল বেশ। ঘন সবুজ অরণ্য,
মৃদুমন্দ বাতাসের বেগ, আর ফলের রসের ঢেউয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম ১০২০০ ফিট উচ্চতায়,
নয়নাভিরাম পর্যটন কেন্দ্র দোচালা পাসে। অপূর্ব সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ পাসটি দেখলে
যেমন মন ভরে যায়, তেমনি তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট জানা থাকলে ভূটান স্বার্থক হয়
ট্যুর। পাহাড়ী অঞ্চলে একস্থান থেকে অন্য স্থনে যেতে সবচেয়ে উঁচু জায়গাকে পাস বলে। ভূটানের
বর্তমান রাজধানী থিম্পু থেকে পূর্বের রাজধানী পুনাখা যেতে মাঝের উঁচু স্থানই হল দোচালা
পাস। পাসটির কেন্দ্রে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিস্তম্ভ, সুসজ্জিত মন্দির, বিশেষ
দূরবীন, ইউনিক ক্যাফেটেরিয়া, ফুল ও ফলের সাঁজানো বাগান। প্রাচীন নিদর্শন নয়, হালে
গড়া স্মৃতিসৌধ। যার রয়েছে রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণতা। দু’দশক পূর্বে
ভারতীয় বিদ্রোহী গোষ্টি (আসামের উলফা) ভূটান সীমান্ত ব্যবহার করে আক্রমন করতে
চেয়েছিল ভারতকে। তৎকালীন ভূটানের রাজা জিগাম সিংহ ওয়াংচুক দমন করেন আক্রমনকারীদের।
দমন করতে যেয়ে ভারতের বিদ্রোহীদের সাথে ভূটান সেনাদের চরম যুদ্ধ হয় ২০০৩ সালে।
বিদ্রোহীরা পরাজিত হয়। মারা যায় বেশ সংখ্যক ভূটানীজ সৈন্যও। তাদের স্মৃতির স্মরণে
রানীমাতা ওয়াংচুক নির্মাণ করেন এই স্মৃতিসৌধ। শিল্পের নিঁখুত শৈল্পিক ছোঁয়ায় নির্মিত
স্মৃতিসৌধে মনোমুগ্ধকর কারুকার্য খচিত তিনটি স্তরে রয়েছে একশত আটটি ষ্টুপার। প্রথম
স্তরে ৪৫টি, দ্বিতীয় স্তরে ৩৬টি ও শেষ স্তরে ২৭টি। আর মাঝে রয়েছে বড় একটি ষ্টুপার।

প্রকৃতি তার রহস্যের
চাদর আবৃত করে স্মৃতিসৌধের সৌন্দর্যকে করেছে অধিকতর সমৃদ্ধ। বছরের বেশির ভাগ সময়ই
দোচালা পাস থাকে মেঘে ঢাকা। কখনো কখনো ষ্টুপার গুলো ভরে যায় তুষারপাতে। তাই শীতল
আবহাওয়া সত্ত্বেও পর্যটকরা ভীড় জমায় দোচালা পাসের সৌন্দর্য উপভোগ করতে।
যাওবার আগে দো্চালা পাস সম্পর্কে আমার তেমন কিছু জানা ছিল না। তাই অরন্য ঘেরা
পাহাড় চূড়ায়, মেঘের পরশে, ভ্রমন পাগল মন আমার শুধু অভিভূতই নয় দারুন ভাবে বাকরুদ্ধও
হলো। হাত বাড়ালেই মেঘ-অনুভূতি যেন ছন্দ হয়ে প্রকাশ পাচ্ছিল…
ছেঁড়া তুলোর গুচ্ছ তুমি
আকাশ পানে উড়ো
ক্লান্ত চরণ, শান্ত তুমি
বারিধারায় ঝড়ো
ধরবো তোমায় হাতের মুঠোয়
করব মেঘ বিলাস
ইচ্ছে আমার পূরণ হলো
দেখে দোচালা পাস।

মেঘের আলিঙ্গনে বাঁধভাঙ্গা
উল্লাস, ছাড়তে চায়না মন দোচালা পাস, কিন্তু ভেজা বাতাস আর হার কাঁপানো ঠান্ডায়
দীর্ঘ সময় টিকে থাকা কষ্টকর। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাই ছাড়তে হল প্রকৃতির সে মায়ার
বাঁধন। দোচালা পাস থেকে রওনা হলাম পুনাখা। থিম্পু থেকে মোটামুটি সত্তর কিলোমিটার
দূরে ভূটানের পুরাতন রাজধানী পুনাখা। পুনাখার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে
ফো-ছু ও মো-ছু নদী, বিখ্যাত পুনাখা জং, হ্যান্ডিক্রাফট এয়াম্পরিয়াম, ন্যাশনাল
লাইব্রেরী, পেন্টিং স্কুল, ট্র্যাডিশনাল মেডিকেল ইন্সটিটিউট, সাসপেনশন ব্রীজ
ইত্যাদি। পুনাখার বর্তমান বড় আকর্ষন রাফটিং। পাহাড়ী নদী পথে নয়নাভিরাম সৌন্দর্য্য
উপভোগ- যার মাধ্যমে অর্জিত হয় সাহসী আভিজ্ঞতা আর তীব্রভাবে বৃদ্ধি পায় ভ্রমন
ক্ষুদা।

অতঃপর আবার থিম্পু উদ্দেশ্যে
যাত্রা। গাড়িতে অনেক কথা, হৈ-চৈ, হাসাহাসি। গাকি প্রসঙ্গে আমাকে বোকা বানিয়ে তারপর
শান্ত হল সবাই। কথা শুনে গাঁ জ্বলছে। সহ্য করতে না পেরে রাগারাগি করে বললাম, আরে
ভাই গাকিকে নিয়ে ভাবনার কি আছে। সে যে রান্না করে খাওয়ায়েছে তাতে আমার পেট খারাপ।
যার জন্য আমি তার উপর ভীষন রেগে আছি তাছাড়া গাকিকে দেশে নিতে পারবো নাকি যে দূর্বল
হব? অনেক হাসাহাসি মনের মাধুরি মিশিয়ে সবাই আমাকে কত বলাই না বলল! বলার সবকথা শেষ
হলে পরে রান্না বিষয়ে সবাই একমত হল, ভূটানের রান্না আমাদের দেশের রান্না থেকে পুরোটাই
ভিন্ন। তাই বাংলাদেশিদের ভূটানে গিয়ে খাওয়ার কষ্ট সহ্য করতে হয়। বন্ধুদের অতি
আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হৃদয় নিয়ে হোটেলে ফিরলাম। স্বেচ্ছায় গাকির খোঁজে না গিয়ে, ফ্রেশ
হয়ে রুমের মধ্যে বসে অপেক্ষায় থাকলাম তার। নিশ্চয় চা বা কফি নিয়ে সে আসবে।

মেকআপ করা রুমটি বেশ
পরিপাটি। সুগন্ধির সুবাসে সুবাসিত। ফুলদানিতে চেরিফুলের গুচ্ছ। রুমে গেষ্ট
না থাকলে সাধারণত মেকআপ বয় রুম গুছিয়ে রাখে। হোটেল ব্যবসায় বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক
এবং সাধারণ। কিন্তু আমি গভীর কল্পনায় মগ্ন, গাকি এসে আমার রুম সাজিয়ে গেছে, এখনি
সে আসবে। কিন্তু না, সে আসলো না। গোঁধুলি বেলা শেষ হলো। সন্ধ্যাবাতি, জোনাকির ঝাকঁ
জেগে উঠলো। নামলো আঁধার রাতি মূর্হুত আমার, বছর সমান ঘূর্ণিভূত হলো সে অভিমানে।
কোথায় আমার গাকি? জীবনে বিরহ এসেছে বহুবার। প্রেম আসে নাই। এসেছে নোলা জল আর
দীর্ঘশ্বাস। গাকির বেলাও তাই।

সারাদিনের ভ্রমনে যত না
ক্লান্ত ছিলাম, কিছুক্ষণ গাকির জন্য অপেক্ষায় তার চেয়ে বেশি ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়লাম
না খেয়েই। ঘুম নেই চোখে। পাশের রুমে চলছে বন্ধুদের তাস খেলার আড্ডা আর হুল্লোর।
কাঠের মেঝেতে গাড়ুম গুডম তাসের বাড়ি। হরতন, রুতন, চিড়া, ইস্কাপুন, ট্রাম, ওভারট্রাম
ম্যারেজ ফোটা আরও কত কথা! ভূটানে উন্মুক্ত স্থানে ধুমপান করা নিষেধ হওয়ায় বদ্ধঘরেই
তারা ইটভাটা জালিয়েছে। তাদের মনে কত সুখ। অথচ ভাটার আগুনে পুড়তে থাকা ইটগুলোর মতোই
আমার সরল হৃদয় মাটি হচ্ছে, সে খবর কেউ নিল না। এমন সময় রুমের ভিতরে সবাই দল ধরে হাজির।
কেন আমি শুয়ে পরেছি সাঝরাতেই? আমার জরিমানা হয়েছে। এবং এক্ষুনি বাহিরে যেতে হবে।

বলতে দেরী, যেতে দেরী
নেই। কেউ পোশাক পড়ার সময় দিল, কেউ দিল না। চলে গেলাম তাদের সাথে। থিম্পুতে রাজার
জন্মদিবস উপলক্ষে শহরের বিভিন্ন স্থানে তিনদিন ব্যাপি অনুষ্ঠান। থিম্পু ক্লাবে তার
একাংশ দেখে, রঙবেরঙের খেয়ে, রাতের বড় অংশ পার করলাম আমরা।

অতঃপর, সকালে পারোর
উদ্দেশ্যে যাত্রা। বিদায় থিম্পু। বিদায় Pema
Yeaseling Villa। গাকি চকলেট দিয়ে বিদায় জানালো সবাইকে স্বসম্মানে। গ্রহণ
করলো কিছু টিপস। চূড়া থেকে পাহাড়ের বুকের
উপর দিয়েই উ-টার্ন নিতে নিতে আস্তে ধীরে গাড়ি নামলো পাহাড়ের গোড়ায়। নিজেদের মধ্যে থিম্পু নিয়ে চলছে হরেকরকম গল্প। এমন সময় মনের অজান্তেই ফিরে তাকালাম Pema Yeaseling Villa-র দিকে। বাড়ির সেই বারান্দা,
যেখান থেকে আমি দেখেছিলাম রাতের থিম্পু, সেখানে আনমনে একলা দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে
রয়েছে গাকি আমাদের গাড়ির দিকে। দৃশ্যটি দেখতে মোটেও
প্রস্তুত ছিলাম না। তাই ডেকে কাউকে দেখতেও বলা হলো না। বুকের গহীন গভীর থেকে জোরেসোরে
বেরিয়ে গেলো একটি হাহাকার। পিছনে হেলান দিয়ে বসে পড়লাম।

জরাজীর্ণ বিধ্বস্ত গাকির কঙ্কাল বিরহ ব্যথা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিদায় প্রহরে। কেউ বোঝে নাই, তবে আমি বুঝেছি। নিশ্চই গাকি তার না বলা কথাগুলো আমাকে বলতে নীরব অভিমানে অপেক্ষায় রয়েছে। চিৎকার করে বলতে চাইলাম তোমরা আমাকে রেখে যাও। আমি না হয় পরে যাবো। কিন্তু সে শক্তি আর হলোনা। পাহাড় আর শহরের আড়ালে পড়লো গাকি, ছুটে চললো আমাদের গাড়ি। মুস্তাকিন ভাইয়ের মোবাইলে করুন সুরে বাজতে শুরু করলো গান-
অবেলায় যদি এসেছ আমার বনে
দিনের বিদায় ক্ষনে
গেয়ো না, গেয়ো না, চঞ্চল গান
ক্লান্ত এ সমীরণে।

One thought on “পর্বতচূড়ার দেশ আমার দেখা ভূটান

Leave a Reply