পর্বতচূড়ার দেশ আমার দেখা ভূটান

Share on Facebook

শহর আর পাহাড়ের আড়ালে ফেলে এলাম গাকিকে। চলছে গাড়ী। শুনছি গান আর দেখছি প্রকৃতির প্রাচুর্যতা। থিম্পু থেকে আবারও পাহাড়ি পথ। তবে পূর্বের দেখা পাহাড়গুলো থেকে সম্পূর্ন ভিন্ন ধাঁচের পাহাড় দেখা যায় এখানে। পারো পথে রাক্ষুসে দাঁতওয়ালা পাথুরে পাহাড় মেটে ধুসর বর্ণ যাকে হিংস্র দেখায়, ন্যাড়া মাথায় সে পাহাড়ে আদৌ কখনো কোন উদ্ভিদ জন্মেছিল বলে সন্দেহ হয়। তার মাঝে পাথর কেটে তৈরিকৃত মূর্তিগুলো প্রাকৃতিকভাবে তৈরি বলে মনে হয়। পারোর পথে মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যের আধার হচ্ছে পারোচা নদী। সুউচ্চ পর্বতকোলে গিরিপথ, তার কোলে ঝর্ণধারা, পর্বত সারির মাঝে পাহাড়ী সে ঝর্ণার স্বচ্ছ জলের নদী পারোচা। যার স্বচ্ছতার তলে স্রোতের তালে জমে থাকা পাথরগুলো পরস্পরের পরশে সৃষ্টি করে হৃদয়স্পর্শী শব্দতরঙ্গ। নদীকুলে ফুটে থাকা চেরি ফুলের বন দখল করে চোখের চাহনি। আবহাওয়া ভাল থাকলে দেখা ভ্রোমর আর প্রজাপতির নাঁচন। চোখের কোণে জমে থাকা নোনা জল সরিয়ে দেখলাম সে রূপ। গাকির জন্য মুখস্ত করা প্রেম নিবেদন প্রকৃতিকেই দেবার ইচ্ছে করলাম।

পারো শহর যখন পৌছানো যায়
পারোচা নদীর দৃশ্য শেষ হয় তখন। শুরু হয় প্রকৃতির নতুন এক চিত্র। আপেল কমলার বাগান ঝুলতে
থাকা কাঁচা-পাঁকা ফলগুলো দেখতে যত সুন্দর খেতেও তেমন মজা। কিন্তু আকারে বড় এবং অতিরিক্ত
রসালো হওয়ায় মন যত চায় তার খেতে হয় কমই। কখনো দেখা যায় ঘন পাইন বন। সারি সারি
পাইন বৃক্ষগুলি বনায়নের না বনের তা জানতে ইচ্ছে করে। নীরব নিস্তব্ধ
পাহাড়ী বন, সেথায় আছে নানা প্রজাতির পাহাড়ী পশু-পাখির আনাগোনা আর ছোপ ছোপ পড়ে থাকা বরফ খন্ড যেন সাগরজলের ফেনা।
হৃদয়ের মাঝে তৈরি করে কখনো ভয়ের কখনো সংশয়ের অনুভুতি। পারো শহর
বা পারোচা নদীর নিকটে আর আমরা নই। আমরা এখন গভীর অরণ্যের ভেতর। কিংগার
কাছে জানতে চাইলে সে জানালো পারো থেকে হাঁ যাওয়ার পথে সবচেয়ে বড় পাস চেলেলা পাস। কিছুক্ষনের
মধ্যেই আমরা সেই চেলেলা পাসের চূড়ায় চড়বো।

নাম শুনার আগপর্যন্ত চেলালা
পাস সম্পর্কে কোন ধারণা অন্তত আমার ছিল না। তাই রহস্যজনক সে পরিবেশের সর্বশেষ রহস্য
জানার জন্য ব্যকুল ছিলাম বেশ। অত্যন্ত বিপদজনক পথ, তাই গাড়ির গতি মন্থর। তুষার স্তরগুলো আর
ছোপ ছোপ নয়। ঘন অরন্য ও তৃণভূমির মাঝে বিস্তৃত। বিস্তৃত সড়কের উপরও। অনেক কষ্ট
পাড়ি দিতে হল বরফে ঢাকা সে পথ। ততক্ষনে আমরা সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ১৩০৮৪ ফুট উপরে। হিমালয়ের
প্রচন্ড হিমেল হাওয়া এলোপাথাড়ি বয়ে এসে যেন এলোমেলো করে দিচ্ছিলো আমাদেরকে। শুধু বরফ
আর বরফ। দুধের মত সাদা বরফের পুরু স্তর কাঁথার মতো ছড়িয়ে আছে চূড়া থেকে গোড়া পর্যন্ত। ঘুরতে আসা
পর্যটকদের লাগামহীন ছুটাছুটি, বরফ ছুড়াছুড়ি, কে শোনে কার কথা! সুউচ্চপর্বত চূড়া থেকে দেখা যায় পদতলে থাকা ধবল ধরণীর রূপ। দৃষ্টি
যতদূর যায়, শুধু সাদা আর সাদা আর তার মাঝে আলোর ঝলকানি। যেন মেঘ বিদ্যুতের চমকের আলো
না লুকিয়ে প্রজ্জ্বলিত হয় হৃদয়ে হৃদয়ে। কি অপরূপ নৈসর্গিক দৃশ্য!

আকাশ ছোঁয়া ভূটানের
সর্ব্বোচ্চ পর্বতশৃঙ জোমলহলি স্পষ্টই দেখা যায় রহস্য ঘেরা চেলালা পাস থেকে। সেখান
থেকে আলোক রশ্মি যেন প্রতিফলিত হচ্ছিল আমাদের চোখ মুখে। ভূটানীদের
ঝুলিয়ে রাখা শত শত প্রেয়ার ফ্লাগ পত পত করে উড়ছে তো উড়ছেই। প্রচন্ড সূর্যের তাপ ও
উষ্ণ আলোকরশ্মি সেখানে অসহায়, পরাস্ত সূর্যদেব। সেদিন দুপুরে ঝলমল উত্তপ্ত রোদের
মাঝেও বরফ স্তর আর হিমেল হাওয়া তাপমাত্রাকে এনেছিল -৬ ডিগ্রিতে। অক্সিজেনের
স্বল্পতা আর অতিমাত্রায় শীতল হাওয়ায় অধিক সময় টিকে থাকা ছিল কষ্টকর। চেলেলা পাস
প্রকৃতির নয়ণাভিরাম সৌন্দর্যের এমন এক লীলাভূমি যার বর্ণনা দেওয়ার মেধা বা যোগ্রতা
আমার নেই। কেননা দৃশ্যমান সৌন্দর্যের মধ্যে অন্তনির্হিত রয়েছে আর এক সৌন্দর্য্য,
যা বুঝা যায় না। হয়তো দেখা যায়, কিন্তু বোঝানো যায় না। এমন রূপের রহস্য অন্য কোন
লেখকও সঠিক ভাবে প্রকাশ করতে পারবে বলে আমি সন্দেহ পোষন করি। আবহাওয়া ও পরিবেশ
অনুকূল থাকলে চেলালা পাস দেখার সৌভাগ্য হয় নইলে সম্ভব নয়। অবাক হতেই হয় স্রষ্টার
এমন সৃষ্টি দেখে। সেথায় রেখে এসেছে কিছু পদচিহ্ন। আর নিয়ে এসেছি শুধুই স্মৃতি।

চেলেলা পাস দেখে ফিরলাম পারো শহরে। বিমানে বন্দর, যাদুঘর, মন্দির, জং সহ অনেক কিছুই আছে সেখানে দেখার মতো। পাহাড় ঘেরা বিমান বন্দর অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ। তার চেয়ে বরং বাই রোডে ভুটান ভ্রমণ শ্রেয়। রাস্তা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখার সুযোগওতো সেখানেই বেশি।

দুপুরের খানা পর্ব শেষ করে অন্য কোন দিকে মনোযোগ না দিয়ে, একমাত্র লক্ষ টাইগার নেষ্ট। ভূটান পর্যটনে বিজ্ঞাপন হিসাবে দেখানো হয় যাকে। যার ঐতিহাসিক তাৎপর্য অনুসন্ধান করলে পাওয়া যায়, মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬৯২ সালে তাক্তসাং গুহার পাশে। ভূটানের ধর্মীয় গুরু পদ্মসম্ভব তিব্বত থেকে বাঘের পিঠে চড়ে আগমন করেন তাক্তসাং গুহায় এবং সেখানে তিন বছর, তিন মাস, তিন সপ্তাহ, তিন দিন, তিন ঘন্টা ধ্যানমগ্ন থাকেন একাধারে। মূলত এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই, নির্জন ও নিভৃতে, পর্বত চূড়ার একটু নিচে নির্মাণ করা হয় টাইগার নেষ্ট নামে নজরকাড়া নকশায় কারুকার্যখচিত এই বৌদ্ধ মন্দির। নির্মাণ কৌশলের কারণে একে মনে হয় পাহাড়ের গায়ে ঝুলন্ত মন্দির। ভারতে যেমন গঙ্গা পূন্যস্নান, ভূটানে তেমনি টাইগার নেষ্ট মহাপূণ্যের স্থান। ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধ জনগোষ্ঠি বিশ্বাস করেন, জীবনে একবার হলেও টাইগার নেষ্টে যাওয়া উচিত সবার। মূলত সেই ধারণা থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশের অসংখ্য বৌদ্ধ ধর্মালম্বীগণ জঙ্গল ঘেরা দূর্গম, পাহাড়ীপথ পাড়ি দিয়ে পাদদেশ থেকে ৯৫০ মিটার উপরের এই তাক্তসাং মন্দিরে গমন করেন। অনেক বৃদ্ধ আছে, যারা সমতল পথেও চলতে অক্ষম, তারাও সে মন্দিরে যায়। মনের জোরে যায়, বন্ধুর পথ বেয়ে। পরপারের শান্তির আশায়।

Leave a Reply