পর্বতচূড়ার দেশ আমার দেখা ভূটান

Share on Facebook

পাহাড়ি পথ, অরণ্য, আর লাবণ্যময় পাহাড়ী মেয়ে সোনামকে বিদায় দিয়ে এলাম আমরা থিম্পু শহরে।

পাহাড়ের কোল ঘেষে শহর নাকি শহরের চারদিকে পাহাড়, পর্যটকদের মনে জেগে ওঠা সে প্রশ্নের উত্তর আমি খুজে বেড়াই আজও। ইটের তৈরি দালান, কাঠের তৈরি নকশার মাঝে তামা কিংবা পিতলের কারুকার্য। শুধুমাত্র বাঘ, সিংহ, ড্রাগন অথবা বুদ্ধের প্রতিমা নয়, প্রতীকি নকশায় প্রস্ফুটিত হয়েছে শিল্পীর গভীর কল্পনার অজস্র রাজকীয় আলপনা। পরিষ্কার পরিছন্ন তিলোত্তমার শহর। পার্কিংয়ে গাড়িগুলো সাঁজানো সারিবদ্ধভাবে। রাস্তার গাড়িগুলো লেন, সিগন্যাল, জেব্রা ক্রসিং, ফুটপাত, মান্য করে চলছে শতভাগ আইন। গাড়িতে হুইসেল আছে, কিন্তু নেই তার ব্যবহার। ময়লা আছে, ডাস্টবিনও আছে। সুযোগ নেই যততত্র ফেলানোর। পাবলিক প্লেসে ধুমপান শতভাগ নিষিদ্ধ। মানুষের চারণভূমি এতটা পরিছন্ন ও গোছানো হতে পারে, থিম্পু না দেখলে তা বিশ্বাস করা কঠিন। শহরের উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম মোটামুটি দেখা হল অনেক কিছুই।

ষ্টেডিয়ামের সামনে আর্চারি
গ্রাউন্ড, সেখানে বিশেষ পোশাকে এলিট শ্রেনীর ভূটানীরা তীর নিক্ষেপ খেলায় মগ্ন। আর্চারি
বা তীর-ধনুক প্রাচীন যুগের ব্যবহৃত মানুষের হাতিয়ার, বিভিন্ন দেশে তা এখন যাদুঘরের
উপকরণ কেবল। কিন্তু ভূটানে এখনও প্রচলিত জাতীয় খেলা হিসাবে। প্রচলিত এই খেলার মাঝে,
ধনুক থেকে ছুটে যাওয়া তীরের সাথে মানুষের ভাবনাগুলোও ছুটে গিয়ে স্পর্শ করে প্রাচীন
সেই যুগকে। আমি হয়তোবা ভাবতে পারিনি অতটা গভীর ভাবে, তবে তীর-ধনুক হাতে নিয়ে ভাব
নিতে ভুল করিনি কোনো। বেশ ভাবের সাথে কষে ছাড়লাম এক তীর। নিশানা থেকে বহুদূরে,
ঘুমন্ত এক কুকুরের কাছে গিয়ে পড়লো সেটা। আতংকিত কুকুরটি উচ্চস্বরে ঘেউ ঘেউ করতে
করতে দিল ছুট! আর তার চিৎকারে আশেপাশে
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কুকুরগুলোও শুরু করলো চেচামেচি। যেন শুরু হলো কুত্তার মিছিল!
আমি লজ্জা পেলাম নাকি ভয় পেলাম, ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। এদিকে হাসির রোলে শুরু
হলো সোরগোল। ভদ্র ভূটানীরা আমার সাহসের যথেষ্ঠ প্রশংসা করলেও বন্ধুরা আমার উপর চটে
গিয়ে বকতে থাকলো। এভাবে তীর মেরে আমি নিজেকে ডুবিয়েছি, গ্রুপকে ডুবিয়েছি, সর্বোপরি
দেশকে ডুবিয়েছি। সুতরাং ভবিষ্যতে সর্তক থাকতে হবে আমাকে।

সন্ধ্যায় ফিরলাম আমরা
হোটেলে। Pema Yeaseling Villa – “A home away from home’’, আসলেই কি হোটেল?
প্রকৃতপক্ষে পাহাড়ের চূড়ায় বাশঁ ও বেতের এক বাড়ি এটা। হিমেল হাওয়ার তাই অভাব নেই
কোনো। হাড় কাপানো শীত। শীতের পোশাক গায়ে দিয়েও দাতেঁ দাতেঁ বাড়ি খায় অবস্থা।
সারাদিনের জার্নি, শহরে ঘুরাঘুরি, পেট ভরে না খাওয়ার কষ্ট, সব মিলিয়ে এমন জরাজীর্ন
অবস্থা যে ভালোভাবে ফ্রেশ হওয়াটা প্রয়োজন খুব। তাই তীব্র শীতকে উপেক্ষা করে, গরম
পানিতে মনমত ফ্রেশ হলাম। নতুন করে গরম কাপড়ে নিজেকে জড়িয়ে নিয়ে নেটওয়ার্কের সন্ধান
করলাম এলাকার খবর নিব বলে। কিন্তু ভূটানের অনেক ভাল খবরের মাঝে একটি দুঃখজনক বিষয়,
দূর্বল নেটওয়ার্ক। এ কারনে প্রিয়জনের খবর নিতে গিয়ে পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। নেটওয়ার্ক
খুজতে গেলাম কিচেন রুমে। কারণ কিচেনের যারা আয়া-বুয়া, তারাই হোটেলের কতৃপক্ষ। কিন্তু
কিচেনে ঢুকতেই যে চমক!!!!!

অপূর্ব এক সুন্দরী।
হালকা-পাতলা গড়ন, সোনালী বরন, মাথা ভরা আলগা চুল, আড়ালে কানের দুল, কালো বাঁকা ভ্রুর
তলে মায়াবী জোড়া চোখ, উচু চ্যাপ্টা নাকের পরে ইসৎ বাঁকা ঠোঁট। অমন চোখে, রাঙা ঠোঁটে
রঞ্জিত তার হাসি-চাহনিতে প্রকাশ পায় হৃদয় চাষের চাষী। নাম তার গাকি। কথা হলো, নেটওয়ার্কও
পাওয়া গেল। কিন্তু শেষ হলোনা। বরং পাশাপাশি বসে শুরু হল ভূটানের নানা গল্পে জমে
গেল বেশ। গল্পের মাঝেই গাকি আমার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে তার নম্বর সেইভ করে দিল আমার
ফোনে। একে তো বিদেশি, তার উপর সুন্দরী, তারপর পাশে বসে গল্প, তারপর স্বেচ্ছায়
নম্বর আদান-প্রদান। জগতের সব রোমান্স যেন তখন আমার মন ও মস্তিস্কে। যা বলি ভালো
লাগে, যা শুনি ভাল লাগে, আর যা দেখি তা বেশি ভাল লাগে। এত শীত কিন্তু শীতের বদলে গরম
লাগে। মনে মনে বলি, কেন ভূটানে আসিনি আরো আগে!

খাবার সময় হল। সদলবলে
হাজির হলো সবাই। তাই তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইতি টানতে হল গল্পে। খাবার পর্ব শেষে এবারে
ঘুমানোর পর্ব। নরম বিছানায় গরম কম্বল, ভ্রমনের ক্লান্তি, আর আগামীদিনে নতুন জায়গা
ভ্রমন, তাই ঘুমের খুবই প্রয়োজন। তবু কেন জানি ঘুম ছিল না চোখের পাতায়। দক্ষিনা
বাতাসের প্রবাহ, টিনের চালে পড়া টপ টপ কুয়াশার শব্দের সাথে পাহাড়ী ঝিঁ ঝিঁ পোকার
ডাক, রাতের গভীরতাকে যেন গভীর করে তুলেছে আরও।

এমন নির্জন রাতে, অজানা কোন
বিরহে কাতর মন নিয়ে তাকিয়ে আছি জানালার পর্দার ফাঁকে দিয়ে। নয়নে প্রজাপ্রতির নাঁচন,
কর্ণে ভ্রমরের গুঞ্জন, সুরেলা বাঁশির সুরে কে যেন গেয়ে যায় –
আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়
মনে পড়ে মোরে প্রিয়
চাঁদ হয়ে রব আকাশের গায়
বাতায়ন খুলে দিয়ো….।

গ্লাস লাগানো জানালা আর
খুলতে হচ্ছে না, সহজেই প্রবেশ করছে চাদেঁর আলো। সে আলোর সাথে ডানা মেলে লালপরী
নীলপরী সাদাপরী হয়ে উড়ে আসছে গাকি। ধরতে গেলেই নাই! গাকিকে ধরতে আবেগ থেকে বাস্তবে
মনোযোগ দিলাম। কিন্তু ধরবো কিভাবে? একাধিক চন্দ্র থেকে আলোকরশ্মি, সাথে সমসংখ্যক
গাকি আসছে আমার কামরায়, আমার শয্যায়, আমারই সিথানে। কি অদ্ভুদ ব্যপার!! এমন গভীর
রজনীতে কারে আমি জিগাবো ভূটানে একাধিক চাঁদ উদিত হয় কি না?

উপচে পড়া আবেগে আমি আপ্লুত, তবে ভীত নই। বিষয়টা বুঝতে করিডোরে বের হলাম। তখন আর কল্পনায় নয়, বাস্তবেই আরো বেশি উপচে পড়তে থাকলো আবেগ। আপ্লূত সে মন নয়ন ভরে দেখলো, প্রকৃতির মাঝে কৃত্রিমতার মিশ্রনে সাজানো সৌন্দর্যের আধার বুদ্ধা পয়েন্ট। কয়েক ধাপে সাঁজানো বিশেষ আলোকবাতি যেন এক একটি চন্দ্র খন্ড। সেখান থেকে নিঃসৃত হচ্ছে রূপালী আলোকরশ্মি। তার ঠিক মাঝেই গৌতম বুদ্ধের বৃহদাকার প্রতিমূর্তি। নির্জন পাহাড়-চূড়ায়, ঘন অরণ্যের মাঝে চিরন্তন ধ্যানে মগ্ন বুদ্ধ, ধরিত্রীর শান্তি কামনায় গভীর মনোযোগী। কৃত্রিম আলোক সজ্জায় সজ্জিত বুদ্ধ অনায়াসে দৃষ্টিগোচর হবে সবার। কিন্তু কারও দিকে মাথা তুলে তাকাবে না সে। ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের নীরবতার সাথে নীরব রয়েছে রাতের থিম্পু।

পাহাড়ের পাদদেশে সাঁজানো পাঁকা বাড়ি, প্রজ্জ্বলিত রঙ্গিন আলোক বাতি যেন আঁধার আকাশের তারকাপুঞ্জের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রকাশ করেছে নিজের সৌন্দর্য্য। শীতের তীব্রতা, কুয়াশার মেঘ, কোন কিছুই যেন ঢেকে রাখতে পারছে না সুসজ্জিত থিম্পুর আলোর এই ঝল্কানি। নীরব নিশি, নির্জন পর্বতরাশি, ধরণীর নতুন এই রুপ; দেখে উন্মোচিত হলো মনমন্দিরের অভিজ্ঞতার নতুন এক দরজা। অভিজ্ঞতা অর্জিত হল বটে! কিন্তু প্রচন্ড ঠান্ডায় বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা গেলোনা আর। অগত্যা রুমে ফিরে এসে, কম্বলে মাথা গুঁজে ঘুমানোর চেষ্টা।

One thought on “পর্বতচূড়ার দেশ আমার দেখা ভূটান

Leave a Reply