পর্বতচূড়ার দেশ আমার দেখা ভূটান

Share on Facebook

উঁচু পাহাড়, ঘন বন, তুষার স্তরে বাঁধা পেয়ে উড়ে যাওয়া মেঘের বহর, ছন্নছাড়া হিমেল হাওয়ায় মায়াবী কান্না, ঝর্না ধারায় কখনো মান কখনো অভিমান, এমনই বহু সাজে সজ্জিত নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যের স্বর্গ রাজ্য, ছোট্ট দেশ ভূটান। প্রাকৃতিক অলংকারে অলংকৃত সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি ভূটান শুধু দৃশ্যমান সুন্দরই নয় যার সৌন্দর্য্য থেকে নিঃসৃত হয় নিখাদ অক্সিজেন যা কিনা ভূটানে বাসরত প্রানীকূলের প্রয়োজনের চেয়ে কয়েক গুণ অধিক। তাই তো বিশ্বে একমাত্র ভূটানকেই বলা হয় অক্সিজেনের দেশ।

সৌন্দর্য্যের আধার ভূটান ভ্রমণ নিয়ে পৃথিবীর সকল দেশের মানুষের রয়েছে উচ্ছসিত কৌতুহল। সে কৌতুহলের বাইরে নই আমিও। তাই প্রথমবার যখনই সুযোগ হলো ভূটান ভ্রমণের, স্বব্যবহার করলাম সেটার। আর নয়ন ভরে দেখলাম ছবির মত সুন্দর সে দেশ। শুনেছিলাম যতটুকুবাস্তবে ভূটান তার চেয়েও বেশি সুন্দর। যদিও পুরো ভূটানই একটি পর্যটন কেন্দ্র, তারপরেও ফুন্টশোলিং, থিম্পু, পুনাখা, পারো, হা, বুমথং ঘুরলে মোটামুটি ভূটান ভ্রমণের তৃষ্ণা অবশিষ্ট থাকবার কথা নয়। আবার থিম্পু, পুনাখা, পারো দেখলেও যথেষ্ঠ দেখা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে প্রায় নিয়মিতই অসংখ্য পর্যটক ভূটান ভ্রমণ করে থাকেন। তারা প্রতিবারই নতুন কোন ভূটান দেখে আসেনা কিন্তু নিয়ে আসে নতুন কিছু অভিজ্ঞতা। ভূটান ভ্রমণে বাংলাদেশীদের আগ্রহ ভূটানীরাও সম্মানের সাথেই দেখেন। বাংলাদেশী পর্যটকদের সেবা প্রদান ও সাহায্যে যেন সদা প্রস্তুত থাকেন তারা।

ফুন্টশোলিং শহর-

বারো জনের একটি গ্রুপ নিয়ে সড়ক পথে ঢাকা থেকে ভূটান জয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম
আমরা। গাবতলী থেকে বাস ছাড়লো আনুমানিক রাত আটটায়। সিকিম, দার্জিলিংসহ ভূটান ভ্রমণ উৎসুক যাত্রী ভর্তি বাস। বাসের ভেতরের
তাপমাত্রা যদিও অনুকূলে তবুও আরামদায়ক নয়। আর কেনইবা হবে! যাত্রার শুরুর প্রাক্কাল
থেকে মোটামুটি এলেঙ্গা পর্যন্ত জ্যাম, ইঞ্চি ইঞ্চির গতিতে এগুচ্ছে গাড়ির গতি। সাত
সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিতে নাইক যতটা ক্লান্ত হয়, মাত্র কয়েক মেইল স্থল পথ পাড়ি
দিয়েই তার চেয়ে অধিকতর ক্লান্ত হয়ে গেলাম আমরা। যমুনা সেতুর মনোমুগ্ধকর আলোকসজ্জা
উন ক্লান্ত চরণে কিঞ্চিত প্রশান্তি আনতে পেরেছিলো বটে, তারপর জোসনা রাত কেটে গেলো
কখনো ঘুম কখনো নির্ঘুম। অবচেতন মনে হলেও স্পষ্টতই বুঝতে পারছিলাম স্রোত ও বাতাসের
অনুকূলে চলা পালতোলা নৌকার সাঁই সাঁই ঝড়ো গতি, গাঁও-গেরামের বৃক্ষরাজি, সবই পিছে
পড়ে যাচ্ছে। শুধু পিছু ছাড়ছিলো না প্রজ্জ্বলিত জোসনায় হাস্যোজ্জ্বল চাঁদ মামা।
কেবল ভোরবেলায় যখন সূর্য মামা উঁকি দিলো তখন চাঁদ মামা ঠিকই লুকালো আড়ালে। আর আমার
তখন বুড়িমাড়ী।

এপারে বুড়িমাড়ী, ওপারে চ্যাংড়াবান্ধা, দু’টি দেশের দু’টি পোর্টে ভ্রমন প্রাসঙ্গিক কার্যাদি শেষ করে আমাদের ভুটান যাত্রা শুরু হলো ভারতের সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার মধ্যে দিয়ে। সবুজ প্রান্তর, কাঁচাপাকা ঘর, বাঁশ-বেতের ঝোপ ঝাড়, বিদ্যুতের তার, মাঠে চরন্ত গরুর পাল, মানুষের হালচাল সবই এক ও অভিন্ন। দেশ শুধু দুই, ভারত ও বাংলাদেশ। তাতেই প্রতিদিন দেখা অতি পরিচিত দৃশগুলো কতই না নতুন মনে হল! কত প্রশ্ন জাগে মনে, কারে বলি, কেবে শুনে? তাই তো কিছু না বলে দেখে যাই শুধু দু’নয়নে। দেখতে দেখতে হারাই, আবার খুঁজে পাই। পেয়ে গেলাম ভারতের সীমান্ত শহর, জয়গা; অসংখ্য মানুষের বাস, বিশৃংখল দোকানপাট, রাস্তায় ম্যলার স্তূপ, দুর্গন্ধে কুকুর ও কাকের ডুব, ছুটে চলা মানুষের ভীড়, গতি যেন ধনুকের তীর, যা দেখে ঢাকার মানুষ খুব বেশি অভ্যস্ত। তাই অস্বস্তির বালাই নেই কোন।

শহরের সীমান্তে নয়নাভিরাম নকশা করা বৃহদাকার ফটকে সুসজ্জিত প্রহরী, যানবাহন বা মানুষের অবাধ চলাচল। তবু নেই কোন কোলাহল। প্রহরীর নীরবতায় প্রখর সরবতাই প্রকাশ পায় যেন। সানন্দে প্রবেশ করলাম আমরাও। অতি যত্নে গড়া সুউচ্চ দালান, বাড়িঘর, পরিছন্ন আঙিনা আর পরিপাটি  রাস্তাঘাটে যেন ময়লা ধরেনি কস্মিনকালেও। জনমানবেরও অভাব নেই কোথাও। শুধু নেই কোন হৈ চৈ। আঙ্গিনার ঠিক মাঝখানে দৃষ্টিনন্দন এক মন্দির। মন্দিরে ধর্মপ্রাণ মানুষগুলো পালন করছে ধর্মীয় আচার। মুখে মন্ত্র, হাতে যন্ত্র, সবাই সবার প্রতি অনুরক্ত। হিমেল হাওয়ায় শান্ত পরিবেশ কোন রাজ প্রাসাদ যেন। কিন্তু আদতে সে তা নয়। সে ভূটানের ভারত সীমান্তবর্তী শহর ফুন্টশোলিং। পুরো শহর যেন নিখুঁত পরিকল্পনায় গড়া ও পরিপাটি করে সাঁজানো। প্রথমবার বিদেশ ঘোরা যেকোনো বাংলাদেশিকে অবাক হতেই হবে এমন পরিবেশে। অবাক হওয়ার এই গল্প দিয়েই শুরু হলো ভূটান পর্যটনের চমক। জয়গা এবং ফুন্টশোলিং উভয় ইমিগ্রেশনের ভ্রমন আনুষ্ঠানিকতা যথাযথভাবে শেষ করে উঠলাম আমরা Asian Hotel Kitchen & Bar-য়ে।

ফ্রেশ হয়ে ঘুরতে বের হলাম জয়গা ও ফুন্টশোলিং। জয়গা, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু অধ্যুষিত মাঝারি গোছের শহর, কেনাকাটার জন্য বেশ উপযোগী। ধন ও সৌভাগ্যের দেবী লক্ষীর প্রতিমার সাথে পৈতা-ধুতি, তিলক পড়া গোফওয়ালা বিক্রেতাদের দেখলে বুঝা যায় যে তারা বেশ ধর্মানুরাগী। সন্ধ্যায় ধুপের ধোয়াঁর তীব্র গন্ধে যখন দোকান থেকে পালিয়ে যাচ্ছে অলক্ষীরা, আমাদের লক্ষীর দল হাজির হলো ঠিক তখন। শুরু হলো কেনাকাটা, আড্ডা-গল্প। খাবারের জন্যও প্রসংশা করতে হয় জয়গার। আমরা খেয়েছিলাম শুধু সবজি-রুটি কিন্তু তার সুস্বাদ আর কাঁসার বাসনের পরিবেশন ছিল স্মৃতিতে ধরে রাখার মত। জয়গা ঘুরা শেষ করে আসলাম, ফুন্টশোলিং। ভূটানের ছুখা জেলার বৃহত্তম বাণিজ্যিক শহর ফুন্টশোলিং, আভিজাত্যের কমতি নেই কোন কোথাও। নান্দনিক ভূটান গেট, দর্শনীয় জাংটাপেলেরি মন্দির, পরিচ্ছন্ন ও সুসজ্জিত বিপণন কেন্দ্র, পরিপাটি বার ও রেষ্টুরেন্ট এতোটাই আভিজাত্ময় যে সেখানে ক্যাজুয়েল ওয়্যারে ঘুরাঘুরি করতেও ইতস্তত লাগে। বৈচিত্রময় ভূটানী পোশাক পরিধেয়ভূটানীরা ধারণ করে আছে স্বকীয়তা ও রাজকীয়তা। ঘুরলাম দেখলাম আমরা। ফটোসেশন করলাম, করলাম রাত্রিযাপন।

পরেরদিনের যাত্রা হবে থিম্পুর উদ্দেশে।

Leave a Reply