এগিয়ে যাওয়ার গল্প নিয়ে ব্র্যাকের ‘হোপ ফেস্টিভ্যাল’

Share on Facebook

গোলাপি রঙে সেজেছে বাংলাদেশ আর্মি স্টেডিয়াম। গ্যালারির চারপাশ দিয়ে সারি সরি স্টল। মাঝখানে বাঁশ, কাঠের নানা আকৃতির স্থাপনা। উত্তর প্রান্তে বিশালাকার মঞ্চ। আর তার সামনের খোলা জায়গায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা লোকশিল্পীরা ঢোল-মন্দিরা বাজিয়ে গলা ছেড়ে গাইছেন ‘গান গাই আমার মন রে বুঝাই…’। লোকজন ঘুরছেন। স্টলে স্টলে গিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন। ছবি তুলছেন। জমজমাট উৎসবের আয়োজন। এ উৎসব ব্র্যাকের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে।

‘হৃদয়ে বাংলাদেশে’, ‘সম্ভাবনার শক্তি’ এবং ‘যে পৃথিবী আমরা গড়তে চাই’— তিন প্রতিপাদ্য নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার শুরু হয়েছে তিন দিনের এ উৎসব। প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলবে আয়োজন। এতে থাকছে ব্র্যাকের বহুমুখী কার্যক্রমের উপস্থাপনার সঙ্গে আবহমান বাংলার চিরায়ত লোকজ সংস্কৃতির সম্মিলন। পুঁথিপাঠ, গল্পের আসর, বায়োস্কোপ, পুতুলনাচ, শিশুদের খেলার জগৎ, আলোচনা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

আজ প্রথম দিনের উৎসবে প্রতিপাদ্য ছিল ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’। বেলা ১১টায় দর্শনার্থীদের জন্য স্টেডিয়ামের ফটক খুলে দেওয়া হয়।

ব্র্যাকের সামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রম, সামাজিক ব্যবসা কর্মকাণ্ড, বিনিয়োগ, বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য উদ্যোগসহ দেশে-বিদেশে ব্র্যাকের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড (ইকোসিস্টেম) নিয়ে সেজেছে উৎসব প্রাঙ্গণ। বিভিন্ন স্টল, উন্মুক্ত মঞ্চ আর শিশুদের ছবি আঁকা, জাদু পরিবেশনা, লোকগান, সামাজিক সচেতনতামূলক নাটক নিয়ে আর্মি স্টেডিয়াম হয়ে ওঠে জমজমাট।
সব বয়সের মানুষের অংশগ্রহণে মুখর ছিল উৎসবের কেন্দ্র। তাঁরা ঘুরে ঘুরে উৎসবের সব আয়োজন উপভোগ করেছেন এবং বিভিন্ন কর্মশালায় অংশ নিয়েছেন। শিশুদের স্থাপত্যবিদ্যার ধারণা দিতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আর্ককিডস’, মাসুদা খানের ‘ড্র আ ফ্রেন্ড’, আড়ং–এর গয়না তৈরির কর্মশালা ‘জুয়েলস অব বেঙ্গল’ এমন কর্মসূচিগুলোতে দর্শকদের কৌতূহল বেশি ছিল।

আগে থেকে অনলাইনে নিবন্ধনের মাধ্যমে এসব কর্মশালায় অংশগ্রহণের জন্য তালিকাভুক্ত হয়েছেন আগ্রহীরা।

ব্র্যাকের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ বিভাগের প্রধান সাজেদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বজুড়ে আশা জাগানোর ৫০ বছরের পথচলা আর বাংলাদেশের মানুষের দৃঢ়তা, সাহস ও এগিয়ে যাওয়ার শক্তি উদ্‌যাপন করতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এ উৎসব। বাধা, বিপদ ও দুর্যোগে বাংলাদেশের লড়াকু মানুষ থমকেছে, কিন্তু থামেনি। সীমাহীন সম্ভাবনায় খুঁজে নিয়েছে এগিয়ে চলার পথ। এ উৎসবের মূল অনুপ্রেরণা ও আয়োজন তাদের ঘিরেই।

মঞ্চের মূল অনুষ্ঠান শুরু হয় বিকেল পাঁচটায় জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। পরে তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

এরপর দেখানো হয় ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের জীবনভিত্তিক একটি তথ্যচিত্র। ব্র্যাক প্রতিষ্ঠাতার বর্ণাঢ্য জীবন ও কর্ম উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি করে।

দর্শকদের স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য দেন ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে রয়েছে অমিত সম্ভাবনা। সামান্য সহায়তা পেলেই মানুষ সব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে নিজের জীবন পরিবর্তন করতে পারেন।

আসিফ সালেহ বলেন, ‘ব্র্যাক মানুষের মনে আশার সঞ্চার করেছে। সহায়তা করেছে। আর তাতেই মানুষ আত্মশক্তিকে উপলব্ধি করেছে। এ আশা আর আত্মশক্তিতেই মানুষের জীবন বদলে যাচ্ছে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এ অগ্রযাত্রায় সরকার, বেসরকারি সংস্থা, নাগরিক সমাজ অনেকের অবদান আছে। ব্র্যাক তার অর্ধশত বছর পূরণ করছে সামনে আরও ভালো দিনের প্রত্যাশা নিয়ে।’

এরপর আয়োজন করা হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। শুরুতেই ছিল বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিল্পীদের পরিবেশনায় উচ্চাঙ্গসংগীত। এরপর ছিল ‘পুঁথিপাঠ’। বাংলাদেশের ইতিহাস ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জীবনের গল্প নিয়ে পুঁথি পাঠ করেন খ্যাতিমান অভিনয়শিল্পী ফজলুর রহমান বাবু ও তাঁর দল। নাট্যদল ‘প্রাচ্যনাট’ পরিবেশন করে স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আফসানা আক্তারের জীবনসংগ্রামের ভিত্তি করে নাটক ‘প্রতিদিনের যোদ্ধা’। শেষে ছিল ব্যান্ড লালনের পরিবেশন।

একঝলকে ব্র্যাকের যাত্রাপথ

১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে নানামুখী উদ্যোগ শুরু হয়ছিল। তখন ৩৬ বছর বয়সী স্যার ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রথম উদ্যোগ ছিল দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকা সুনামগঞ্জের শাল্লায় ভারত থেকে ফিরে আসা শরণার্থীদের ত্রাণ ও পুনর্বাসন করা। এরপর ক্রমাগত বাংলাদেশ আর ব্র্যাক বহু ক্ষেত্রেই যেন হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক মুক্তির এক ভিন্নতর যুদ্ধের ময়দানে। আজ ব্র্যাক দেশের প্রধান উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানই নয়, পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। বাংলাদেশের সীমা অতিক্রম করে ব্র্যাকের শাখা–প্রশাখা বিস্তার করেছে বহির্বিশ্বে। উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে কাজ করছে ১১টি দেশে।

ব্র্যাকের এই অর্ধশতাব্দীর যাত্রাপথের প্রধান মাইলফলকগুলো তুলে ধরা হয়েছে মাঠের মাঝখানে তৈরি করা এক স্থাপনায়। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ১৯৭৪ সালে শুরু হয়েছিল ক্ষুদ্রঋণদানের কার্যক্রম। ১৯৭৬ সালে মানিকগঞ্জে রেশম চাষের সূচনা, ১৯৭৫ সালে গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগ চালু। ১৯৭৭ সালে শুরু হয় প্রথম গ্রাম সংগঠনের কার্যক্রম। কারুশিল্পীদের সহায়তা ও তাদের পণ্যের বাজার তৈরির জন্য আড়ং চালু হয় ১৯৭৮ সালে। ডায়রিয়া প্রতিরোধের জন্য খাবার স্যালাইনের প্রকল্প চালু হয় ১৯৮০ সালে, ১ কোটি ৩০ লাখের বেশি মানুষকে হাতে–কলমে খাবার স্যালাইন তৈরি করা শেখানো হয়। এর ফলে দেশে ৫ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হার ২ তৃতীয়াংশে নেমে আসে। ১৯৮৩ সালে হাঁস–মুরগির টিকাদান শুরু হয়। এতে গ্রামীণ নারীরা স্বাবলম্বী হওয়ার পথে অগ্রসর হন। বহু কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়।

প্রাথমিক স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুদের জন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৮৫ সালে। এর মধ্য দিয়ে এক নতুন কার্যক্রম শুরু হয়। এশিয়া ও আফ্রিকার ১৫ মিলিয়ন (দেড় কোটি) শিক্ষার্থী এতে অংশ নিয়েছে। মানবাধিকার ও আইনি সুরক্ষার কর্মসূচি শুরু হয় ১৯৮৬ সালে। মহিলা স্বাস্থ্য উন্নয়ন কর্মসূচি শুরু ১৯৯১ সালে, ১৯৯৩ সালে চালু হয় কিশোর-কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্র, ১৯৯৪ সালে কেনিয়ায় খোলা হয় উপানুষ্ঠানিক স্কুল। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের শহরগুলোতে বস্তিবাসী ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য শুরু হয় শহর উন্নয়ন কর্মসূচি। ডেয়ারি ও ফুড প্রোডাক্টের কার্যক্রম ১৯৯৮ সালে, ২০০০ সালে প্রতিবন্ধীদের জন্য চালু হয় কৃত্রিম পা সংযোজন কেন্দ্র। ২০০২ সালে চালু হয় অতি দারিদ্র্য দূর করার কর্মসূচি। একই বছর আফগানিস্তানে ব্র্যাকের কার্যক্রম চালু হয়।

উগান্ডায় ব্র্যাক যায় ২০০৬ সালে, ২০০৭ সালে অতিদরিদ্র দূর করার জন্য গ্র্যাজুয়েশন কর্মসূচির শুরু হয়। এ কর্মসূচি এত সফল হয় যে বিশ্বের ৫০টি দেশে প্রায় দেড় কোটি মানুষ এতে অংশ নিয়েছেন। ফিলিপাইনে ব্র্যাকের কাজ শুরু হয় ২০১২ সালে, পরের বছর চালু হয় সমন্বিত উন্নয়ন কর্মসূচি। তানজানিয়া ও উগান্ডায় চালু হয় প্লে–ল্যাব কর্মসূচি। রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের সহায়তা কর্মসূচি, করোনা মহামারি শুরুর পর ২০২০ সাল থেকে দেশের ৩৫টি জেলায় ৪১টি বেসরকারি সংস্থাকে নিয়ে চলছে ব্র্যাকের সেবাদান কর্মসূচি।

Leave a Reply