হালাল পর্যটন এবং বাংলাদেশ | পর্ব- দুই

Share on Facebook

বিশ্বের উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও বিভিন্ন প্রতিকূলতা অতিক্রম করে অগ্রসর হচ্ছে। গত শতকের নব্বই দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রধানত কৃষিভিত্তিক ছিল। আশি দশকের মধ্যভাগ হতে শিল্পায়নের ধারা গতিপ্রাপ্ত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রধানত তৈরী পোশাক, প্রবাসী আয় এবং কৃষির উপর নির্ভরশীল।

২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য একটি আরও ভাল এবং আরও টেকসই ভবিষ্যতের অর্জনের লক্ষ্যে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো জাতিসংঘ নির্দেশিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) বাস্তবায়ন করছে। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) অর্জনে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার জন্য নির্ধারিত লক্ষ্যসমূহের সাথে পর্যটন খাতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পর্যটন খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

বাংলাদেশের পর্যটন সংশ্লিষ্টরা দীর্ঘদিন ধরে পর্যটন খাতকে যথাযথ গুরুত্ব প্রদানের দাবী জানিয়ে আসছিলেন। প্রায় এক দশক আগে, অর্থাৎ ২০০৯ সালে সরকার পর্যটন খাতকে এসএমই এবং পুনঃ অর্থায়নযোগ্য খাত হিসেবে নির্ধারণ করে। এরই ধারবাহিকতায় বেসামরিক বিমান পরিবহন এবং পর্যটন মন্ত্রণালয় ‘জাতীয় পর্যটন নীতিমালা-২০১০’ ঘোষণা করে। এই নীতিমালায় বলা হয় “বাংলাদেশের পর্যটন এখনও প্রারম্ভিক (Taking off) পর্যায়ে রয়েছে।

‘পর্যটন শিল্পের প্রসারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালকে পর্যটন বছর’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন’ উল্লেখ করে তৎকালীণ শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু জানান, ‘টেকসই পর্যটন শিল্পখাত গড়ে তোলার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার প্রণীত জাতীয় শিল্পনীতি- ২০১৬তে পর্যটন শিল্পকে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত করেছে।’ এই শিল্পনীতিতে উচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত হিসেবে কৃষি/খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারী শিল্প, তৈরী পোশাক শিল্প, আইসিটি/সফটওয়ার শিল্প, ঔষধ শিল্প, চামড়া ও চামড়াজাত শিল্প, লাইট ইন্জিনিয়ারিং শিল্প এবং পাট ও পাটজাত শিল্পকে ‘উচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত’ শিল্প হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত শিল্পের তালিকায় পঞ্চম স্থানে পর্যটনের অবস্থান পঞ্চম। অবশ্য জাতীয় শিল্পনীতি ২০২২এর খসড়ায় অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত শিল্পের তালিকায় পর্যটন তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে।

জাতীয় বাজেট ঘোষণার প্রাক্কালে চলতি বছরের ৩১শে মে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি আমিনুল হক শামীম এক সাক্ষাৎকারে দৈনিক বনিক বার্তাকে বলেন, “বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য পর্যটনকে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত।”

‘পর্যটনের উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি’ দাবী করে চলতি বছরের ২৩মে এফবিসিসিআই স্ট্যান্ডিং কমিটির সভায় পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা জানান, পর্যটনের উন্নয়নের সঙ্গে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের (এসডিজি) অন্তত ছয়টি লক্ষ্য সরাসরি জড়িত। পর্যটনের বিকাশ না হলে ২০৩০ সালে এসডিজি অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে। পর্যটনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ১০৯টি এবং পরোক্ষভাবে ১১০০ খাত সংযুক্ত। প্রতিজন পর্যটকের জন্য ১০টি প্রত্যক্ষ ও ৩৫টি পরোক্ষ কর্মসংস্থানের তৈরি হয়। তাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্যও পর্যটনকে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত।

উল্লেখ্য জাতীয় শিল্পনীতি-২০১৬তে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত শিল্পের তালিকায় পর্যটন শিল্প পঞ্চম স্থানে থাকলেও ২০২২এর জাতীয় শিল্পনীতির খসড়ায় অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত শিল্পের তালিকায় তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দু’টি খাত হলো তৈরী পোশাক শিল্প এবং প্রবাসী আয়। সাম্প্রতিক সময়ে ফ্রিল্যান্সিং খাতটি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। এই তিন খাতের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধানতম খাতে পরিণত হতে পারে পর্যটন। জাতীয় শিল্প নীতিতে পর্যটন শিল্পকে অগ্রাধিকার ভিত্তিক খাত হিসেবে চিহ্নিত করলেও এই খাতের উন্নয়নে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও কৌশলগত বিনিয়োগের অভাব দৃশ্যমান। এছাড়া বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন কর্মকান্ডের গতিও তুলনামূলকভাবে ধীর।

নীল অর্থনীতির আলোকে মেরিটাইম ও কোস্টাল ট্যুরিজম, এগ্রিট্যুরিজম, রিভারএডভেঞ্চার ট্যুরিজম এবং ইসলামিক ও হালাল ট্যুরিজমে এশিয়াকে নেতৃত্ব দিতে পারে বাংলাদেশ।

২০১৮ সালে ঢাকায় ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)-এর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পর্যটনমন্ত্রীদের সম্মেলনে ঢাকাকে দুই বছরের জন্য সিটি অব ইসলামিক ট্যুরিজম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে এই বিষয়টিকে বিশ্বের না হোক অন্তত মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোর পর্যটকদের কাছেও আমরা যথাযথভাবে ব্রান্ডিং করতে ব্যর্থ হয়েছি।

হালাল ও ইসলামিক ট্যুরিজমের সুবর্ণভূমি হবার সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য, শিল্প ও সংস্কৃতি, ইতিহাস আর ঐতিহ্য ইসলাম বান্ধব। দেশে ইসলামি নিদর্শনের প্রাচুর্য রয়েছে। বাংলাদেশে পর্যটন আকর্ষণে এতই সমৃদ্ধ যে ‘সমগ্র বাংলাদেশ একটি অখন্ড পর্যটন কেন্দ্র’ হিসেবে ব্রান্ডিং করেই বিশ্বের পর্যটকদের কাছে বাংলাদেশেকে ব্রান্ডিং করা যায়। ‘মেড ইন বাংলাদেশ’-এর মত ‘ডিসকভার বাংলাদেশ : আল্টিমেট ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন’ ব্রান্ডিং অসম্ভব নয়।

বিশ্ব মুসলিমের সবচে বড় জমায়েত পবিত্র হজ্জ। হজ্জের পরেই মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েতটি টঙ্গীর তুরাগ তীরে অনুষ্ঠিত হত। বর্তমানে বিশ্ব ইজতেমা দুই ভাগে বিভক্ত হলেও বিদেশী অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা কম নয়। অর্থাৎ, হালাল পর্যটন ধারাণাটির উৎপত্তির বহু আগেই বিশ্ব ইজতেমায় বিশ্বের ৫৫টি দেশ হতে আগত অতিথিসহ প্রায় ২৫থেকে ৩০লক্ষ মানুষকে সুশৃঙ্খলভাবে সেবা দানের সক্ষমতা আমরা অর্জন করেছি।

বিশ্বের ৫৫টি দেশের যে অতিথিরা বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণ করেন তাদের কাছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থানসমূহ এবং পর্যটন আকর্ষণগুলো তুলে ধরে তাদরকে আকৃষ্ট করার কোনো সুপরিকল্পিত উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় না।

বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত আন্তরিক। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে প্রতিটা দেশেই বাংলাদেশের মিশন রয়েছে। ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)-এর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পর্যটকদের কাছে হালাল পর্যটন গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশকে ব্রান্ডিং করা খুব কঠিন নয়। কিন্তু সর্বাগ্রে প্রয়োজন লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট করে বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহন ও বাস্তবায়ন। শুধু হোটের রিসোর্ট বা অবকাঠামো নির্মাণ নয়, পর্যটন খাতে কৌশলগত বিনিয়োগকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদানের বিকল্প নেই।

বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধানতম খাতগুলোর একটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার সম্ভাবনাকে বিবেচনায় এনে পর্যটনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত শিল্প হিসেবে চিহ্নিত করে যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করা হবে কি না- সর্বাগ্রে এই নীতিগত প্রশ্নটির সমাধান হওয়া প্রয়োজন।
.
পর্ব – এক
https://www.porjotonia.com/?p=13218

Leave a Reply