ভারতীয় পাসপোর্টের দাবিতে আদালতে ‘রাষ্ট্রহীন’ এক নারী

Share on Facebook

ভারত, যুক্তরাজ্য, উগান্ডা সব দেশের কাছ থেকেই ‘রাষ্ট্রহীন’ তকমা পাওয়া নারী ইলা পোপাট এবার ভারতীয় পাসপোর্ট পাওয়ার দাবি নিয়ে মুম্বাই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন।
ভারত, যুক্তরাজ্য এবং উগান্ডা কোনও দেশই ইলা পোপাটকে নিজেদের নাগরিক করতে রাজি নয়। পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে ভারতে বাস করা এই নারী এবার ভারতীয় পাসপোর্টের দাবি নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন।

উগান্ডায় ১৯৫৫ সালে জন্ম নেওয়া ইলা মাত্র ১০ বছর বয়সে মায়ের হাত ধরে জাহাজে করে ভারতে যান। এখন তার বয়স ৬৬ বছর। তিনি ভারতে বিয়ে করেছেন, সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, ভারতে তার ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে। এমনকী তার ভোটার আইডেন্টিটি কার্ডও আছে।

কিন্তু তার যা নেই সেটি হল, ভারতের একজন নাগরিক হিসেবে একটি ভারতীয় পাসপোর্ট। আর একারণে তিনি রাষ্ট্রহীন হয়ে আছেন। পাসপোর্টের অভাবে তিনি দেশের বাইরে যেতে পারেন না।

বিবিসি জানায়, ভারতীয় পাসপোর্ট পেতে ইলা এবার হাজির হয়েছেন মুম্বাইয়ের হাই কোর্টের দ্বারে। ভারতীয় কর্মকর্তারা যাতে তাকে পাসপোর্ট ইস্যু করেন সেজন্য আদালতের আদেশ চান তিনি।

কয়েক দশক ধরে ভারতে বাস করছেন, দেশটিকে নিজের বাড়ি করে নিয়েছেন। তার ভাষায়, একজন ‘ভারতীয় হতে’ যেসব কাগজপত্র দরকার তার অনেক কিছুই তার আছে। তারপরও তিনি এক বিরল পরিস্থিতিতে পড়েছেন।

কয়েক দশক ধরে তিনটি ভিন্ন দেশ থেকে তিনি পাসপোর্ট পাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু পাচ্ছেন না। ফলে তিনি হয়ে আছেন রাষ্ট্রহীন। ইলা বলেন, ‘‘প্রত্যেকবার, আমি কোন দেশের নাগরিক এই প্রশ্নে তারা আটকে যাচ্ছে।”

ইলার বাবা ভারতের পশ্চিমের রাজ্য গুজরাটের পোরবন্দর নগরীতে জন্মেছেন এবং বড় হয়ে উঠেছেন। ১৯৫২ সালে ইলার বাবা কাজের সূত্রে উগান্ডা যান এবং কয়েক বছর পর ব্রিটিশ পাসপোর্ট গ্রহণ করেন। উগান্ডা তখন ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। ইলার জন্মের সাত বছর পর উগান্ডা স্বাধীন হয়।

স্বাধীনতার পর দেশটিতে চরম রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে এবং জরুরি অবস্থা জারি হলে ১৯৬৬ সালে মা ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে উগান্ডা থেকে ভারতে চলে যান ইলা।

তিনি বলেন, ‘‘একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে আমি ভারতে আসি। আমার নাম আমার মায়ের পাসপোর্টে লেখা ছিল। তার পাসপোর্ট অনুযায়ী, তিনি একজন ‘ব্রিটিশ প্রোটেক্টেড পারসন’ ছিলেন।” যুক্তরাজ্য সরকার যাদের নাগরিকত্ব দেয় তাদেরকে এভাবেই শ্রেণীবদ্ধ করা হয়।

ইলার পরিবার প্রথমে পোরবন্দরে বাস করত এবং ১৯৭২ সালে তারা মুম্বাই (তখন বোম্বে) চলে যায়। ১৯৭৭ সালে সেখানেই ইলার বিয়ে হয় এবং সন্তানদের জন্ম হয়।

ভারতের নাগরিকত্ব আইনের (১৯৫৫) অধীনে ১৯৯৭ সালে ইলা ভারতের নাগরিকত্ব পেতে প্রথম আবেদন করেন। ওই আইন অনুযায়ী, কেউ ভারতের কোনও নাগরিককে বিয়ে করলে এবং সাত বছর দেশটিতে বাস করলে তিনি ভারতের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারেন।

ইলার দাবি, তার আবেদন ‘ইতিবাচকভাবে দেখা’ হয়নি এবং তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।

এরপর ইলা মুম্বাইয়ের ব্রিটিশ হাই কমিশনে গিয়ে যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব পাওয়ার চেষ্টা করেন। যেহেতু তার বাবা-মা দুইজনই যুক্তরাজ্যের পাসপোর্টধারী। তাছাড়া, তার মায়ের পরিবার তখনও সেখানে ছিল।

কিন্তু ব্রিটিশ হাইকমিশন থেকে বলা হয়, যেহেতু তার বাবা বা তার দাদা ১৯৬২ সালের পর যুক্তরাজ্যে বা ব্রিটিশ কোনও কলোনিতে ‘জন্মগ্রহণ, নিবন্ধিত বা নাগরিকত্ব নেননি, তাই তিনি যুক্তরাজ্যের পাসপোর্ট পাওয়ার যোগ্য নন।

তাকে আরও বলা হয়, তিনি খুব সম্ভত উগান্ডার একজন নাগরিক হতে পারবেন। ‘‘কিন্তু যদি উগান্ডা কর্তৃপক্ষ তাকে পাসপোর্ট দিতে অস্বীকৃতি জানায়, তবে তিনি একজন রাষ্ট্রহীন নাগরিকে পরিণত হবেন।” ইলা সেই প্রথম শুনলেন তাকে কেউ ‘রাষ্ট্রহীন’ বলেছে।

তারপর তিনি দুইবার ভারতের পাসপোর্ট পাওয়ার আবেদন করেন এবং দুইবারই তার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়। তিনি বলেন, ‘‘আমি এমনকী বলেছিলাম, যদি আমাকে অন্তত ভ্রমণের জন্য একটি পাসপোর্ট দেওয়া হয়, তবে আমি যুক্তরাজ্যে আমার নানাকে দেখতে যেতে পারি। কিন্তু আমি সেটিও পাইনি।”

ইলার ভাই ভারতেই বাস করেন এবং বাবা-মা’র মত তার যুক্তরাজ্যের পাসপোর্ট আছে। ভাই ব্রিটিশ পাসপোর্ট পেলেও কেন ইলা পেলেন না সে উত্তর তার কাছে নেই।

তিনি বলেন, ‘‘আমরা যৌথ পরিবারে বসবাস করতাম। আমি খুব বেশি কিছু জানতাম না এবং বড়দের কথার বাইরেও যেতাম না। আরও বেশি কিছু জানতে সেখানে প্রশ্ন করা যেত না। তাই আমরা জানি না কী ভুল হয়েছিল।”
২০১৫ সালে ভারতীয় পাসপোর্ট পেতে ইলার তৃতীয় আবেদন প্রত্যাখ্যান হওয়ার পরই কেবল ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাকে জানায় যে, প্রথমে তাকে ভারতের নাগরিক হিসাবে নিবন্ধিত হতে হবে।

ইলার আইনজীবীও এ বিষয়ে একমত পোষণ করে বলেন, ‘‘তার উচিত আগে নাগরিত্ব পেতে আবেদন করা। সেটি ছাড়া তিনি পাসপোর্ট পাবেন না।” ইলা বলেন, কেউ এ বিষয়ে তাকে সঠিক পথ দেখায়নি।

২০১৮ সালে ইলার মেয়ে দিল্লিতে উগাণ্ডার হাই কমিশনে চিঠি লিখে তার মাকে উগান্ডার নাগরিকত্ব বা পাসপোর্ট দেওয়ার আবেদন করেন। যার ভিত্তিতে তিনি যেন ভারতের পাসপোর্ট পেতে আবেদন করতে পারেন।

কিন্তু সেখান থেকে বলা হয়, যদিও ইলা উগান্ডায় জন্ম নিয়েছেন। কিন্তু তিনি ‘কখনও উগান্ডার নাগরিক ছিলেন না’। ফলে ইলাকে আবারও একজন রাষ্ট্রহীন নারী হিসেবে ভারতে নাগরিকত্ব পেতে আবেদন করার পরামর্শ দেওয়া হয়।

২০১৯ সালে আবার ভারতের নাগরিকত্ব পেতে আবেদন করেন ইলা। কিন্তু তার সেই আবেদনও বাতিল হয়ে যায়। বলা হয়, যেহেতু তিনি বৈধ ভিসা বা পাসপোর্ট ছাড়া দীর্ঘদিন ভারতে বসবাস করছেন, তাই তিনি ভারতের নাগরিকত্ব আইনে (১৯৫৫) নাগরিকত্ব পেতে যেসব শর্ত দেওয়া আছে সেগুলো পূরণ করতে পারেননি।

প্রচণ্ড হতাশ হয়ে ২০২২ সালে বোম্বে হাই কোর্টে পিটিশন করেন ইলা। ক্ষোভ উগরে তিনি বিবিসি-কে বলেন, ‘‘আমার স্বামী ভারতীয়, সন্তানরা ভারতীয়, নাতি-নাতনি ভারতীয়, এমনকী আধার কার্ডসহ সরকারি বাকি সব কাগজপত্র আমার আছে। অথচ এতসব কিছুও যথেষ্ট নয়।”

মুম্বাই হাই কোর্ট আগামী মাসে ইলার আবেদন গ্রহণ করতে পারে। পাসপোর্টের অভাবে ভারতের বাইরে পারিবারিক কোনও অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি ইলা। এখন তিনি ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার আশায় বুক বেঁধে আছেন। যেখানে তার জীবনের প্রায় পুরোটা সময় কেটেছে।

Leave a Reply