চিনে নিন কোনটা কোন বাতরোগ

Share on Facebook

জীবনে নানা সময় নানা ধরনের ব্যথা-বেদনা আমাদের পর্যুদস্ত করে। এর একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে হাড় ও অস্থিসন্ধির ব্যথা। ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ কখনো না কখনো হাড়–সন্ধির ব্যথায় কষ্ট পেয়েছেন।

হাড়, সন্ধি বা পেশিসংশ্লিষ্ট ব্যথা–বেদনাকে মোটাদাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায়—মেকানিক্যাল বা যান্ত্রিক ও ইনফ্ল্যামাটোরি বা প্রদাহজনিত।

বসা বা শোয়ার ভুল ভঙ্গি, নিচে বসে বা সামনে ঝুঁকে দীর্ঘ সময় কাজ করা, ল্যাপটপ বা কম্পিউটারে অনেকক্ষণ কাজ করা, ভারী জিনিস ওঠানো বা কোনো কারণে আঘাতপ্রাপ্তির জন্য যে ব্যথা সৃষ্টি হয়, সেটাই যান্ত্রিক ব্যথা। সাধারণত ত্রুটিপূর্ণ ভঙ্গিমা আর পেশি লিগামেন্টের আঘাতই এ ধরনের ব্যথার জন্য দায়ী। যেকোনো বয়সেই এই ব্যথা হতে পারে, তবে বয়স্ক ব্যক্তি, অতিরিক্ত ওজন বা স্থূল ব্যক্তি, অ্যাথলেট বা খেলোয়াড়, একই কাজ দীর্ঘ সময় ধরে করেন, এমন মানুষই ভোগেন বেশি।

৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে এই ধরনের ব্যথা ৬ সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয় না। বিশ্রাম নিলে দ্রুত সেরে যেতে থাকে। এর সঙ্গে জীবনযাত্রার পরিবর্তন, ওজন হ্রাস, বৈজ্ঞানিক উপায়ে শরীরচর্চা, ফিজিওথেরাপি ও কিছু ব্যথানাশক ওষুধে প্রায় পুরোপুরি সেরে ওঠে।

কিন্তু প্রদাহজনিত বা ইনফ্ল্যামাটোরি ব্যথাই মূলত বাতরোগ বা রিউমাটোলজিক্যাল রোগ হিসেবে পরিচিত। বাতরোগ যান্ত্রিক ব্যথার মতো নয়। এটি সাধারণত সারা জীবন ধরেই থাকে, চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। সঠিক চিকিৎসা করা না হলে এ থেকে সন্ধির বিকলাঙ্গতাসহ নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এ ধরনের ব্যথা বরং বিশ্রাম বা নিষ্ক্রিয়তায় বাড়ে, সক্রিয় হলে কমে। এ কারণে এ ধরনের ব্যথার একটি বড় উপসর্গ হলো সকালে ঘুম থেকে উঠে বেশি করে আড়ষ্টতা বোধ করা, হাত–পা বা আঙুলগুলো নড়াচড়া করতে সমস্যা হওয়া। বাতরোগ সঠিকভাবে নির্ণয় করা ও সঠিক চিকিৎসা করা জরুরি। কেননা, এতে কেবল অস্থি বা সন্ধি নয়, দেহের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গেরও ক্ষতি হতে পারে।

এখানে পরিচিত কিছু বাতরোগ সম্পর্কে তথ্য রইল—

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস

এটি দীর্ঘমেয়াদি একটি বাতরোগ। এতে হাতের আঙুলে ও কবজির গিঁটে গিঁটে ব্যথা হয়, ফুলে যেতে পারে হাতের আঙুলের সন্ধি। পরে তা পায়ের আঙুল, গোড়ালি, কনুইসহ অন্যান্য সন্ধিতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটি একটি ইমিউনোলজিক্যাল সমস্যা, মানে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা নিজ অস্থিসন্ধিকে শত্রু মনে করে প্রতিক্রিয়া দেখাতে থাকে। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা না করালে পরে হাত–পায়ের আঙুল এবং সন্ধি বাঁকা ও বিকলাঙ্গ হয়ে যেতে পারে। পুরুষের তুলনায় নারীরাই এ রোগে আক্রান্ত হন বেশি।

অ্যাংকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস

এটি আবার কম বয়সী পুরুষদেরই দেখা যায় বেশি। এটি একধরনের মেরুদণ্ডের প্রদাহ। কোমরব্যথা, ঘাড়–পিঠব্যথা, সকালে জেগে আড়ষ্টতা হলো এর লক্ষণ। এতে মেরুদণ্ডের হাড় ও লিগামেন্ট আক্রান্ত হয়। ক্রমান্বয়ে হাড়গুলো বাঁশের গিঁটের মতো জোড়া লেগে যেতে থাকে। মেরুদণ্ড ছাড়াও এ রোগে চোখ, ফুসফুস, ত্বক ও খাদ্যনালি আক্রান্ত হতে পারে।

অস্টিওআর্থ্রাইটিস

প্রায় প্রতিটি বাড়ির বয়স্ক সদস্যের উঠতে–বসতে ব্যথা, নামাজ পড়তে ব্যথা, টয়লেট ব্যবহারে ব্যথার সম্মুখীন হতে হয়। সাধারণত এর কারণ অস্টিওআর্থ্রাইটিস। আমাদের দেহের যেকোনো দুটি হাড়ের মাঝখানে তরুণাস্থি বা কার্টিলেজ থাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে এ তরুণাস্থির ক্ষয় হয়, পুনর্গঠনও আর আগের মতো হয় না। এই ক্ষয়ের কারণে ব্যথা, সন্ধি নড়াচড়া করতে সমস্যা, কখনো ফোলা হতে পারে। সাধারণত হাঁটু, গোড়ালি, কোমর, কনুই, ঘাড় এবং বড় বড় সন্ধি আক্রান্ত হয় বেশি। স্থূলদেহী নারীদের ভোগান্তি হয় বেশি।

এসএলই বা লুপাস

এসএলই বা লুপাস রোগে পুরুষের তুলনায় নারীদের আক্রান্ত হওয়ার হার ৯ গুণ বেশি। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা ও গিরায় ব্যথা-আড়ষ্টতার পাশাপাশি এই রোগে মুখে ঘা, ত্বকে দাগ, চুল পড়ে যাওয়া, রক্তশূন্যতা, পা ফোলা, শরীরে পানি আসাসহ নানা সমস্যা হয়ে থাকে। নারীদের প্রজননক্ষম বয়সেই এই রোগ দেখা দেয় এবং প্রজননজনিত নানা সমস্যা সৃষ্টি করে। ঠিকমতো চিকিৎসা করা না হলে লুপাসে জীবন সংশয় পর্যন্ত হতে পারে।

গেঁটে বাত

গাউট বা গেঁটে বাতে ৪০–ঊর্ধ্ব পুরুষেরাই বেশি ভোগেন। গিরা বা অস্থিসন্ধিতে ইউরিক অ্যাসিড জমে এ রোগের সৃষ্টি হয়। যদি দেহে অতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড তৈরি ও জমা হয়, কিংবা কিডনি ইউরিক অ্যাসিড বর্জ্য হিসেবে বের করে দিতে না পারে, তখন এ সমস্যা হতে পারে। গেঁটে বাত হলে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি ফুলে লাল হয়ে যায় ও তীব্র ব্যথা হতে থাকে। চিকিৎসা নিলে ৭ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে সেরেও যায়।

শেষ কথা

আলোচিত বাতরোগ ছাড়াও এ রকম এক শর মতো বাতরোগ আছে, যার কারণে সন্ধি বা পেশিতে ব্যথা, ফোলা, আড়ষ্টতা ইত্যাদি উপসর্গ হতে পারে। কিন্তু প্রতিটি বাতরোগের আধুনিক চিকিৎসা আছে এবং চিকিৎসা নিলে সারা জীবন একে সঙ্গী করেই ভালো থাকা সম্ভব। তা না করে অনেকেই দোকান থেকে নিজে নিজে ব্যথানাশক, স্টেরয়েড ইত্যাদি ওষুধ কিনে ব্যথা দমিয়ে রাখেন, যা খুবই ক্ষতিকর। কিডনি অকার্যকারিতা, গ্যাস্ট্রিক আলসার, উচ্চ রক্তচাপ থেকে শুরু করে স্টেরয়েডজনিত হরমোনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। মূল রোগটির চিকিৎসা না করে উপশমকারী ওষুধ সেবনে জটিলতা বৃদ্ধি ছাড়া আর কিছু হয় না। আবার অনেকে দোকান থেকে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি, গ্লুকোস্যামাইনজাতীয় ওষুধের কৌটা কিনে দিনের পর দিন না বুঝে খেতে থাকেন, এতেও স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

মনে রাখবেন, বাতরোগের চিকিৎসা সুনির্দিষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদি। এতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে ব্যথানাশক ওষুধের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের পাশাপাশি রোগ নিয়ন্ত্রক ওষুধের দরকার পড়ে। এ ধরনের ওষুধের নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে বলে আজীবন নানা শারীরিক ও ল্যাবরেটরি পরীক্ষা করে চিকিৎসকের মনিটরিংয়ে থাকতে হবে। পাশাপাশি ওজন নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত শরীরচর্চা ও ব্যায়াম, ফিজিওথেরাপি ইত্যাদিও গুরুত্বপূর্ণ।

ব্যথামুক্ত জীবনযাপন করতে তাই বাতরোগ ও অন্যান্য ব্যথাজনিত রোগের সঠিক চিকিৎসা নিন।

লেখক: বাতরোগ বিশেষজ্ঞবারডেম জেনারেল হাসপাতাল

 

Leave a Reply