সুলতান গিয়াস উদ্দিন আযম শাহ ঘুমিয়ে আছেন শাহচিল্লাপুর

Share on Facebook

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার একটি গ্রামের নাম শাহচিল্লাপুর। নামটি সাধারণ মানুষের জানা না-ও থাকতে পারে। তবে যাঁদের আগ্রহ ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে, তাঁদের কাছে নামটি অজানা থাকার কথা নয়। এর কারণ একটিই, বাংলার স্বাধীন সুলতান গিয়াস উদ্দিন আযম শাহ। প্রথম ইলিয়াস শাহী বংশের এ সুলতানের সমাধি এই গ্রামেই।

গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ ছিলেন প্রথম ইলিয়াস শাহি রাজবংশের তৃতীয় সুলতান। তিনি তৎকালীন বাংলার সুপরিচিত সুলতানদের অন্যতম ছিলেন। তার প্রকৃত নাম আজম শাহ। সিংহাসন আরোহণের পর তিনি গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ নাম ধারণ করেন। পিতা সুলতান সিকান্দার শাহ ও পিতামহ ছিলেন সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ। মধ্যযুগে বাংলার প্রথম স্বাধীন রাজবংশ ইলিয়াস শাহী রাজবংশ। এই রাজবংশ চৌদ্দ ও পনের শতকে বাংলা শাসন করেছে। এর আগে বাংলা দিল্লির শাসনাধীন ছিল। এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ। তিনি বাংলাকে দিল্লির অধীন থেকে মুক্ত করে বাংলায় সুলতানী শাসন কায়েম করেন। ইলিয়াস শাহী রাজবংশের প্রথম রাজধানী ছিল পান্ডুয়ায়। পান্ডুয়া একশ বছর সুলতানী রাজধানী ছিল। এর পর ১৪৫৩ সালে ইলিয়াস শাহী বংশের অষ্টম সুলতান নাসির উদ্দিন লখনৌতে রাজধানী স্থাপন করেন।

তিনি যুদ্ধর চেয়ে মিত্রতা ও কূটনীতির মাধ্যমে রাজ্যকে সমৃদ্ধ করতে বেশি আগ্রহী ছিলেন। তিনি চীনের মিং সাম্রাজ্যের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন, পারস্যের শীর্ষস্থানীয় চিন্তাবিদদের সাথে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন এবং আসামকে জয় করেছিলেন।শাসনের প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি কামরূপের বিরুদ্ধে একটি সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। তবে অঞ্চল জয়ের চেয়ে শাসন সুসংহত করার প্রতি তার মনোনিবেশ বেশি ছিল। জৌনপুরের খাজা জাহানের নিকট তিনি দূত ও উপহার প্রেরণ করেন। সমকালীন চৈনিক সম্রাট ইয়ং লির সাথে তার সুসম্পর্ক ছিল। ১৪০৫, ১৪০৮ ও ১৪০৯ সালে তিনি চীনে দূত প্রেরণ করেন। ইয়ং লিও তার কাছে দূত ও উপহার পাঠান।

সুলতানের সমাধি

পিতা ও পিতামহের মতো গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ আলেম, সুফিদের ও পন্ডিত ও কবিদের ভক্তি-শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে শেখ আলাউল হক ও নূর কুতুব আলম খুব বিখ্যাত ছিলেন। পারস্যের কবি হাফিজের সাথে তার পত্রবিনিময় হত। বাঙালি মুসলিম কবি শাহ মুহম্মদ সগীর তার বিখ্যাত রচনা ইউসুফ জুলেখা এ সময়ে সম্পন্ন করেন। এসময় কৃত্তিবাসের রামায়ণ বাংলায় অনুবাদ করা হয়।

কবি হাফিজকে বাংলায় নিমন্ত্রন করার জবাবে তিনি সুলতানকে একটি গজল রচনা করে পাঠান।

“শক্কর শিকন শওন্দ হমাঃ তূতিয়ানে হিন্দ।

যী কন্দে ফারসী কেঃ ব-বঙ্গালাঃ মী রওদ॥

হাফিয যে শওকে মজ্‌লিসে সুলতানে গিয়াস্‌দীন।

গাফিল ম-শও কেঃ কারে তূ আয নালাঃ মী রওদ॥”

ভারতের তোতা হবে মিষ্টি-মুখো সকল-ই,

ফারসীর মিছরী যবে বাঙ্গালায় চলিছে।

হে হাফিয! গিয়াসুদ্দীন শাহের সভার বাসনা

ছেড়ো না, কাজ তোমারি কাঁদা-কাটায় চলিছে।

১৪১১ সালে গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে ইলিয়াস শাহী বংশের এক গৌরবোজ্জল অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে।

সুলতানের সমাধি

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার একটি গ্রামের নাম শাহচিল্লাপুর গ্রামেই তাঁর সমাধি। ১৯২০ সালের ২২ নভেম্বর গিয়াস উদ্দিনের সমাধিকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পুরাকীর্তির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে সরকার। সর্বশেষ ১৯৮৫ সালে এ সমাধির সংস্কারকাজ করে সরকার। সমাধিটি কষ্টিপাথরে নির্মিত। এটি ১০ ফুট লম্বা, ৫ ফুট চওড়া ও ৩ ফুট উঁচু। সমাধির ৩ ফুট উচ্চতার খিলানের ওপর আরও দেড় ফুট উচ্চতায় ৭ ফুট লম্বা অর্ধবৃত্তাকার কষ্টিপাথরে ঢাকা। মূল সমাধির কার্নিশে রয়েছে সূক্ষ্ম কারুকাজ খচিত অলংকার। দুই পাশে রয়েছে তিনটি করে তিন খাঁজবিশিষ্ট খিলান। খাঁজের মধ্যে রয়েছে প্রলম্বিত শিকল ও ঝুলন্ত ঘণ্টার নকশা।

কিভাবে যাবেন- ঢাকার গুলিস্তান থেকে বাসে করে ঢাকা-চট্রগ্রাম জাতীয় মহাসড়কের মোগরাপাড়া চৌরাস্তা নেমে অতপর সি.এন.জি/রিক্সায় ৩০ টাকা ভাড়ায় শাহচিল্লাপুর গ্রামে সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ মাজারে যাওয়া যায়।

 

লেখকঃ এ বি এম শিবলী

Leave a Reply