দেশের সম্পদ বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও প্রকৃতি সংরক্ষণে পর্যটন ভূমিকা রাখেঃ স্বপন

Share on Facebook

গতকাল ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। দিবসটি কেন্দ্র করে গতকাল রাত ৮ টায় ওয়েবেনিয়ার এর আয়োজন করা হয়। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় প্রকৃতিকে বাঁচানোর এখনই সময়। এর সাথে মিলিয়ে সম্মিলিত পর্যটন জোটের গতকালের আলোচনার বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছিলো প্রকৃতি রক্ষায় পর্যটনের অনুশীলন।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জয়পুরহাট-২ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য ও সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাবেদ আহমেদ এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. এ কে এম রফিক আহাম্মদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আতিক রহমান, হালদা নদী গবেষক প্রফেসর ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া, ভারতের অরুণাচল রাজ্য সরকারের গ্রাম পর্যটনের উপদেষ্টা রাজ বসু এবং কমিউনিটি পর্যটন বিশেষজ্ঞ শহীদ হোসেন শামীম। অনলাইন এই সভায় ভারত ও বাংলাদেশের অনেক পর্যটন বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, গবেষক ও পর্যটন নেতা অংশগ্রহণ করেন।

অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন সম্মিলিত পর্যটন জোটের আহবায়ক ও বাংলাদেশ ট্যুরিজম ফাউন্ডেশনের সভাপতি মোখলেছুর রহমান। শুরুতেই শুভেচ্ছা দেন ডাহুকের সমন্বয়কারী রেজা শাওন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন যে, পর্যটন একটি দেশের সম্পদ বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও প্রকৃতি সংরক্ষণে ভূমিকা রাখে। আমাদের দেশে পর্যটনের নামে ক্রাউড সৃষ্টি হয় বলে এর নেতিবাচক দিকগুলি আমাদের গোচরীভূত হয়। তাই কমিউনিটিভিত্তিক পর্যটন উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। তবে এইজন্য অবশ্যই রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, কম লাভের এই কর্মকান্ড বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের দিয়ে সম্ভব নয়। তিনি তাঁর নির্বাচন এলাকায় প্রতিশ্রুতিশীল তরুণদেরকে নিয়ে সুশোভিত সবুজায়নের মাধ্যমে জোনভিত্তিক পর্যটনের একটি মডেল তৈরির কাজ করছেন বলে জানান। প্রধান অতিথি ট্যুরিজম মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে দেশীয় বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ মানুষের মত গ্রহণ করে তার আলোকে বিদেশিদেরকে দিয়ে তা তৈরি করার জন্য বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রতি আহবান জানান।

আলোচকদের মধ্য থেকে জনাব শহীদ হোসেন শামীম বলেন, ঐতিহ্য ও প্রকৃতির সমন্বয়ে এবং সামাজিক সংযুক্তির মাধ্যমে সুনির্দিষ্টভাবে কারিগরি জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে এদেশে দায়িত্বশীল পর্যটন গড়ে তুলতে হবে। একাজে উদ্যমী তরুণদেরকে কাজে লাগাতে হবে যেন পর্যটকরা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নিকট থেকে প্রকৃত অভিজ্ঞতা গ্রহণ করতে পারে। তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন যে, পর্যটনে জিরো কার্বনের অনুশীলন করা এবং আঞ্চলিক পর্যটকদের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া আমাদের বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।

ভারতের পর্যটন বিশেষজ্ঞ রাজ বসু বলেন, কেবল অর্থনীতির মাপকাঠিতে পর্যটন কিংবা আমাদের উন্নয়নের পরিমাপ করলে চলবে না। প্রকৃতি ও পর্যটনকে একসাথে করে এশিয়ার দেশগুলিকে উন্নয়ন কাঠামো সৃষ্টি করতে হবে, যার মূল উপাদান হবে বন, পানি, শস্য, জনজীবনের শিল্পজ্ঞান এবং চিরায়ত খাদ্য প্রথা। গ্রাম ও তার মানুষের জীবনধারাকে জীবন্ত শ্রেণিকক্ষ বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পর্যটকদেরকে গ্রামে আহবান জানাতে হবে পয়সার বিনিময়ে সেবা গ্রহণের জন্য নয়, বরং অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য। জয়পুরহাটে গৌতম বুদ্ধের বেণুবন তৈরি এবং তুলশীগঙ্গাকে কেন্দ্র করে ঐতিহ্য পর্যটন সৃষ্টির উপর তাগিদ দেন এই ভারতীয় বিশেষজ্ঞ।

প্রফেসর ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, হালদা আমাদের প্রাকৃতিক জিন ব্যাংক এবং চট্টগ্রামের জীবনরেখা। এই নদী রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউস মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্র যা আমাদের দেশের অর্থনীতিতে ৮০০ কোটি টাকার অবদান রাখে এবং প্রতিদিন চট্টগ্রাম শহরের ৭০ লক্ষ মানুষের জন্য ১৮ কোটি লিটার পানীয় জল সরবরাহ করে। তবে এই নদীকে পর্যটনের জন্য ব্যবহার করা হলে মাছের বাস এবং প্রজনন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরো বলেন যে, পরিবেশ রক্ষায় আমাদের পর্যটকদেরকে সচেতন ও শিক্ষিত করে তোলা অত্যন্ত জরুরি।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আতিক রহমান বলেন, এদেশে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদকে পর্যটনে কাজে লাগিয়ে এর বহুমুখিতা সৃষ্টি করা আবশ্যক। পর্যটনকে তিনি মানুষের অধিকার বলে উল্লেখ করে বলেন, পর্যটকদেরকে শিখিয়ে পর্যটনে আনা যাবে না। বরং শিশুকাল থেকে এই বিষয়ে শিক্ষাদান অত্যন্ত জরুরি। ড. আতিক আরো বলেন, শুধু গার্মেন্টস্ দিয়ে আমাদের চলবে না। পর্যটনের মতো প্রথম সারির বহুমুখী খাতকে শিল্পের মর্যাদা দিয়ে গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জীবন-জীবিকা পরিবর্তনের বিষয়গুলিকে পর্যটনে যুক্ত করতে হবে। গত ৪০ বছরে ৬ লক্ষ প্রজাতি ধংস হয়েছে। তাই জীবন ও জীবিকার সমন্বয় করে পর্যটনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা এখন আমাদের দায়িত্ব।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ড. এ কে এম রফিক আহাম্মদ বলেন, মানুষ প্রকৃতির অংশ। তাই জৈবিক বৈশিষ্ট্যের জন্য মানুষ বনে-বাঁদাড়ে, পাহাড়ে ও পানিতে যায়। অর্থাৎ প্রকৃতির সাথে পর্যটনের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। তবে একথা মনে রাখতে হবে যে, প্রকৃতি বিরুপ হলে আমাদের রক্ষা নাই। তাই পর্যটনকে অর্থনৈতিক, বিনোদন ও শিক্ষা এই ৩ প্রকারে ব্যবহার করতে হবে। তিনি বলেন যে, প্রকৃতিকে নিয়ে পর্যটন পরিচালনায় মানুষের আচরণের মনিটরিং এবং শব্দ ও আলোর সতর্ক প্রয়োগের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। প্রতিটি গন্তব্যের ক্যারিং ক্যাপাসিটি মেনে চলাসহ গণপর্যটনকে পরিহার করার প্রতি তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন। পরিকল্পিত উপায়ে পর্যটন পরিচালনা করা এবং একে শিশুকাল থেকে পাঠ্যে অন্তর্ভূক্ত করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে তিনি মত দেন। আমাদের দেশের ১৩টি সংবেদনশীল পরিবেশ এলাকায় পর্যটন পরিচালনায় সর্বোচ্চ সতর্কতার কথা উল্লেখ করেন।

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব জাবেদ আহমেদ বলেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দাপটে আমরা পর্যটনের অনেক সম্পদ রক্ষা করতে পারি নাই। এখন প্রতিটি গন্তব্যের ক্যারিং ক্যাপাসিটি নির্ধারণ করে এবং পর্যটন পণ্যের বহুমুখিতার মাধ্যমে এই খাতের উৎকর্ষ সাধন করা জরুরি। তিনি পর্যটনকে টেকসই ব্যবস্থাপনার আওতায় আনার জন্য অন্তত ৪-৫টি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। তিনি আরো বলেন, সরকারের গুচ্ছগ্রাম, আদর্শ গ্রাম ইত্যাদিকে একসাথে করতে পারলে এখানে কমিউনিটিভিত্তিক পর্যটন গড়ে তোলা সহজ হবে। করোনাকালে অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক পর্যটনের নতুন সম্ভাবনা রয়েছে বলে তিনি ক্রসবর্ডার পর্যটন নীতি প্রণয়নের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
আলোআনায় আরো অংশ নেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সম্মিলিত পর্যটন জোটের নেতৃবৃন্দ।

Leave a Reply