পর্যটন শিল্প ঘুরে দাঁড়াতে করোনা পরবর্তী করণীয়

Share on Facebook

বাংলাদেশ পর্যটন সম্ভাবনায় সমৃদ্ধ একটি দেশ। প্রকৃতি মায়ের অসীম আশীর্বাদপুষ্ট দেশের প্রকৃতি। এজন্যই আমাদের দেশ এতো বৈচিত্র্যময়। বাংলাদেশে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম নিরবচ্ছিন্ন বালিকাময় সমুদ্রসৈকত। সবুজের সমারোহ নিয়ে মাথা উঁচু করে পাহাড়গুলো দাঁড়িয়ে আছে পুরো পার্বত্য এলাকা জুড়ে। বৈচিত্র্যময় এই দেশের বাতাসে রয়েছে ভেজা মাটির গন্ধ। বাংলাদেশের পুরো শরীর জুড়ে ছড়িয়ে আছে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শেকড়। সব মিলিয়ে আমাদের দেশটি যেকোনো পর্যটকের কাছেই আকর্ষণীয়তম একটি দেশ হিসেবে পরিচিত।

বিগত বছরগুলোতে দেশজুড়ে দেশি বিদেশি পর্যটকের আনাগোনা বাড়ছিলো ফলে দেশের পর্যটন খাতও হয়ে উঠছিল স্বমহিমায় উজ্জ্বল। পূর্বের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গত বছরে দেশের বার্ষিক আয়ে পর্যটনখাতের অবদান ৪.৭ শতাংশ। ঠিক এমন সময় পুরো বিশ্ব জুড়ে শুরু হল করোনাভাইরাস জনিত এক মহাসংকট। লাগামহীনভাবে বেড়েই চলছিলো এই ভাইরাসের সংক্রমণ। তাই বিশ্বের প্রত্যেকটা দেশ নিজেদেরকে রক্ষার জন্য লকডাউন করতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। আজ প্রায় দুই মাস যাবত পুরো দেশ থমকে আছে। ফলে সারা পৃথীবির মতোই বাংলাদেশেরও পর্যটনের অবস্থা শোচনীয়তম।

অনলাইন ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল “পর্যটনিয়ায়” প্রকাশিত প্রভাষক,জনাব মোঃ সাইফুল্লার রাব্বীর “পর্যটন ও প্রকৃতিতে করোনার প্রভাব” শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে নিচের তথ্যগুলো তুলে ধরছি- “IATA এর হিসাব অনুযায়ী এভিয়েশন খাতে জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত আর্থিক ক্ষতির পরিমান ২৫২ বিলিয়ন ইউএস ডলার।বেশিরভাগ ক্ষতি হতে পারে এশিয়া পেসিফিক অঞ্চলে। ট্যুর অপারেটর এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-টোয়াবের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ পর্যটন খাতে ৫৭০০ কোটি টাকা ক্ষতি হতে পারে। অন্য দিকে ট্রাভেল এজেন্সিদের সবচেয়ে বড় সংগঠন এসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্সস অব বাংলাদেশ- আটাবের হিসাব অনুযায়ী করোনার প্রভাবে জুন অব্দি ট্রাভেল এজেন্সি ও ট্যুরিজম খাতে সম্ভাব্য সম্মিলিত ব্যবসায়িক ক্ষতি ১২০০০ কোটি টাকা এবং এই খাতে চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে প্রায় ৪ লাখ শ্রমজীবী। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ও অন্য হোটেলগুলো সব মিলিয়ে তিন হাজার কোটি টাকা ক্ষতির মুখোমুখি হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল হোটেল এ্যাসোসিয়েশন। TRIAB এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ রিসোর্ট ইন্ডাস্ট্রিতে তাদের বিনিয়োগ ৫০০০ কোটি টাকা এবং এখানে সরাসরি কাজে নিযুক্ত আছেন ৩.৫ লাখ কর্মী। করোনার প্রভাবে রিসোর্টগুলো রয়েছে ব্যাপক ক্ষতির মধ্যে এবং কর্মীরাও আছেন কাজ হারানোর ঝুকিতে।”

এইসব ক্ষতি কাটিয়ে উঠে সুদিন ফিরিয়ে আনতে হবে পর্যটন শিল্পে। ১৮ লক্ষ মানুষের জীবন জীবিকার প্রশ্ন জড়িয়ে আছে এই শিল্পে। এই শিল্পের গতিশীলতার উপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের উন্নয়ন। পর্যটন শিল্পের গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে আমাদের করনীয় বিষয়ে কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরা হলো-

পর্যটন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখাতে হবেঃ দীর্ঘদিন যাবত পুরো বিশ্ব লকডাউন থাকার কারনে বেশির ভাগ পর্যটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে। আয় না থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন দিতে পারছে না। অনেক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কর্মী ছাটাই করেও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কষ্টকর হয়ে পরছে। অতএব পর্যটন শিল্পে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রথম লক্ষ হওয়া উচিত এই প্রতিষ্ঠানগুলো যেন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে সেই ব্যবস্থা করা। এক্ষেত্রে ব্যাংকিং খাতকে এগিয়ে এসে প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিসর বিবেচনা করে তাদেরকে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

দক্ষ কর্মীদের ধরে রাখতে হবেঃ যেহেতু দীর্ঘদিন আয় না থাকার কারনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে তাদের কর্মী ছাটাই করতে হচ্ছে অথবা কর্মীদেরকে বিনা বেতনে রাখতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভাবতে হবে উন্নয়নের চালিকাশক্তি হল দক্ষ মানবসম্পদ। অতএব প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিৎ অধিক দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীদের যাতে ধরে রাখা যাতে করে চলমান সংকট মোকাবেলা করা তুলনামূলক সহজ হয়।

লকডাউন পরবর্তী সময়ে সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে ভ্রমনে উদ্বুদ্ধ করণঃ দীর্ঘদিন গৃহবন্দি থাকার একঘেয়েমি কাটিয়ে উঠতে অনেকেই হাওয়া বদলের জন্য ভ্রমনে বের হবেন। কিন্তু সেই সময়ে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থাকবে না এমনটা নাও হতে পারে। অতএব তখনও করোনার ঝুঁকি এড়াতে পর্যটকদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ভ্রমনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

নতুন গন্তব্য খুঁজে বের করতে হবেঃ আমাদের ট্যুরিজ্‌ম মার্কেটিং এ নতুন গন্তব্য সংযুক্ত করতে হবে। গতানুগতিক মার্কেটিং ব্যবস্থায় শুধুমাত্র দেশের বিখ্যাত বা জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যগুলোকেই পর্যটকদের নিকট উপস্থাপন করা হচ্ছে। কিন্তু দেশের বিভিন্ন জেলায় এমন কিছু জায়গা রয়েছে যা ক্ষেত্র বিশেষে অন্যান্য পর্যটনগুলোর তুলনায় আরও বেশি সুন্দর। এইসকল জায়গাগুলোকে খুঁজে বের করতে হবে। নতুন এরকম গন্তব্যগুলোকে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করতে হবে। এছাড়াও ইতোমধ্যে জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যগুলো দীর্ঘদিন জনশূন্য থাকায় নতুন করে অপরূপ সুন্দর রুপে আবির্ভূত হয়েছে। নতুন পুরাতনের সংমিশ্রণে আমাদের পর্যটনকেন্দ্র গুলোকে আধুনিক উপায়ে উপস্থাপন করতে পারলে পর্যটন শিল্প দ্রুতই আবার সচল হয়ে উঠবে।

উপমহাদেশ ভিত্তিক সহযোগিতা জোরদার করতে হবেঃ বাংলাদেশের পর্যটন কর্তৃপক্ষকে দক্ষিন এশিয়ার অন্য সকল দেশের সঙ্গে আলোচনায় বসে উপমহাদেশের সব দেশগুলো পরস্পর পরস্পরকে কীরূপ পর্যটনভিত্তিক সহযোগিতা করতে পারে সে বিষয়ে চুক্তি প্রনয়ন করতে হবে। তাহলে পরস্পর পরস্পরের সহযোগিতা দ্বারা উপমহাদেশের প্রতিটি দেশই উপকৃত হবে।

পর্যটন বিষয়ক গবেষণার উপর জোর দিতে হবেঃ পর্যটনের যেসকল সাবসেক্টর রয়েছে যেমন হোটেল, ট্যুর অপারেটর, ট্রাভেল এজেন্সি, এয়ারলাইন্স ইত্যাদি প্রতিটি সাবসেক্টরে আলাদা আলাদা গবেষণা দল গঠন করতে হবে এবং গবেষণা থেকে পাওয়া ফলাফলের ভিক্তিতে নতুন পরিকল্পনা প্রনয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।

টেকসই পর্যটন গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করতে হবেঃ দেশের প্রতিটি ডেস্টিনেশন দীর্ঘদিন যাবত জনশূন্য থাকার কারনে সেগুলো ছিল সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত। ফলে প্রকৃতি নিজের মত করে এক আশ্চর্য সুন্দর রূপ ধারন করছে। যেমন কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে গোলাপি ডলফিনের দেখা মিলছে যা বিগত ৩০ বছরে দেখা যায়নি, প্রতিটি শহর পরিষ্কার এক মনোরম রূপ নিয়েছে। এগুলোকে উদাহরণস্বরূপ ব্যবহার করে মানুষকে টেকসই পর্যটন গড়ে তুলতে উৎসাহিত করতে হবে। তাছাড়াও ভবিষ্যতে কোন সংকটময় পরিস্থিতি সামলাতে পর্যটন খাতের উন্নতি সাধনের জন্য টেকসই পর্যটন গড়ে তোলা খুবই জরুরি। অতএব পর্যটনের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে টেকসই পর্যটন গড়ার লক্ষে কাজ করতে হবে।

ইতোমধ্যে পর্যটন শিল্পের যে ক্ষতি হয়েছে বা যে ক্ষতি হচ্ছে তা পূরণ করা সম্ভব নয়। আগামী দিনগুলোতে যেন ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কমিয়ে আনা যায় সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। কোনো সন্দেহ নাই কাজগুলো করতে সময় লাগবে বেশ খানিকটা। তবে হতাশ হয়ে বসে না থেকে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। সর্বপরি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বাড়িয়ে দিয়ে পর্যটন খাতের বর্তমান সংকট উত্তরণে সচেষ্ট হতে হবে।

এস এম গোলাম রাফাত
দ্বিতীয় বর্ষ, ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ড্যাফোডিল ইনস্টিটিউট অফ আইটি।

Leave a Reply