দ্বীপ ভিত্তিক পর্যটনে সোনালী ভবিষ্যৎ

Share on Facebook

প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ একটি বৃহত্তম ব-দ্বীপ। যার বুক জুড়ে জেগে রয়েছে অসংখ্য ছোট ছোট দ্বীপ। প্রত্যেকটি দ্বীপের মাঝেই লুকিয়ে রয়েছে কতো শত পর্যটন সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনাগুলোকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে শুধুমাত্র পর্যটন শিল্পের উপর ভর করেই বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে অন্যতম সমৃদ্ধ একটি দেশ। দ্বীপ ভিত্তিক পর্যটন নিয়ে নতুন ভাবনা এখন সময়ের দাবি।

মৌসুমে সবচেয়ে বেশি পর্যটক ভ্রমণে যায় সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপ। নীলাভ স্বচ্ছ জল, শত শত নাড়িকেল গাছের সারি, সামুদ্রিক মাছ, সামুদ্রিক প্রবাল আর ছেঁড়া দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের প্রধান আকর্ষণ। বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ স্থান হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে ছেঁড়া দ্বীপের নাম। সেন্ট মার্টিন ও ছেঁড়া দ্বীপের জাদুকরা সৌন্দর্যে বরাবরই মুগ্ধ পর্যটক।

বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি পর্যটন সম্ভাবনাময় দ্বীপ আছে যেগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে দ্বীপ ভিক্তিক পর্যটন শিল্প। মালদ্বীপের দ্বীপাঞ্চলগুলোর আদলে সাজানো যেতে পারে বাংলাদেশেরও দ্বীপাঞ্চলগুলোকে।

সেন্ট মার্টিন ও ছেঁড়া দ্বীপের বাইরেও বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড, মহেশখালী দ্বীপ, সোনাদিয়া দ্বীপ, কুতুবদিয়া দ্বীপ, নিঝুম দ্বীপ, সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপ, শাহপরীর দ্বীপ, মনপুরা দ্বীপসহ আরও বেশকিছু দ্বীপকে জনপ্রিয় পর্যটক গন্তব্য হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত দ্বীপের নাম বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড। সুন্দরবন উপকূলে দুবলার চর-হিরন পয়েন্ট থেকে ১০ নটিক্যাল মাইল দূরে বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে উঠা দ্বীপটির পর্যটন সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল। এ দ্বীপের প্রধান আকর্ষণ লাল কাঁকড়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. শহীদুল ইসলাম দ্বীপটি নিয়ে গবেষণা করে জানিয়েছেন, এখানে কোনো চোরাবালির চিহ্ন পাওয়া যায়নি। চোরাবালি ঝুঁকি মুক্ত প্রায় নয় কিলোমিটার দীর্ঘ এই সৈকতে ঘুরে বেড়ায় অসংখ্য লাল কাঁকড়া যা পর্যটকদের সহজেই বিমোহিত করবে।

নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলায় বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে উঠা এক খন্ড সম্ভাবনার নাম নিঝুম দ্বীপ। বল্লার চর, কামলার চর, চর ওসমান ও চর মুরি এই চারটি চরের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা নিঝুম দ্বীপের প্রত্যেকটা অংশের রয়েছে পর্যটনের অমিত সম্ভাবনা। নিঝুম দ্বীপে যাওয়ার পথে দেখা মেলে কালা মহিষের চর, কবিরের চর, চৌধুরীর দ্বীপসহ কতো সৌন্দর্য। ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট আর চিত্রা হরিণ দ্বীপটিকে অন্যান্য দ্বীপ থেকে স্বতন্ত্র করে রেখেছে। ২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকার নিঝুম দ্বীপের প্রায় ৯০৫০ একর জায়গা জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষনা করেছে। প্রকৃতি প্রেমিদের নজরে আসায় প্রতি বছর পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে নিঝুম দ্বীপের পর্যটন সম্ভাবনা সময়ের সাথে সাথে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে।

মহেশখালী দ্বীপ কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়িয়া দ্বীপ। এটি মহেশখালী উপজেলা নামেও পরিচিত। দ্বীপটি হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান তিন ধর্মের লোকের কাছেই সমান গুরুত্বপূর্ণ। আদিনাথ পাহাড়ের চূড়ায় আদিনাথ মন্দির, পাহাড়ের পাদদেশে গ্রামের মাঝে বৌদ্ধ মন্দির, সারি সারি পানের বরজ়, বার্মিজ মার্কেট, শুটকির বাজার আরো হরেক রকমের জিনিষ চোখে পড়বে বঙ্গোপসাগরের গভীরে অবস্থিত এই দ্বীপটিতে।দিন দিন এখানে পর্যটকদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এখন প্রয়োজন শুধু পর্যটকবান্ধব কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা।

সোনাদিয়া দ্বীপ কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার অন্তর্গত কুতুবজোমে অবস্থিত। জীববৈচিত্রে সমৃদ্ধ এই দ্বীপে পৃথিবীর কিছু দুর্লভ পাখির দেখা পাওয়া যায় যা অন্য কোথাও দেখা যায় না। প্রায় নয় বর্গকিলোমিটারের এই দ্বীপের তিন দিকেই সমুদ্র সৈকত। মাঝে মাঝে ছোট বড় খাল বিশিষ্ট প্যারাবন, উপকূলীয় বনভূমি, বিচিত্র প্রজাতির জলচর পাখি দ্বীপটিকে পর্যটকদের কাছে করে তুলেছে অতুলনীয়। এখানে গড়ে উঠেছে দেশের সবথেকে বড় শুটকি মাছ উৎপাদন কেন্দ্র।বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে গড়ে তোলা হচ্ছে সোনাদিয়া ট্যুরিজম পার্ক যা এখানকার পর্যটনে নতুন মাত্রা যোগ কবরে।

কক্সবাজার জেলার আরও একটি উপজেলার নাম কুতুবদিয়া, যেটি কুতুবদিয়া দ্বীপ নামে পর্যটকদের বেশি জনপ্রিয়। প্রায় ২১৬ বর্গ কিলোমিটারের এই দ্বীপে যে স্থান গুলোতে ভ্রমণ পিপাসুদের আনাগুনা লক্ষ্য করা যায়- বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প (বায়ুকল), কুতুব শরীফ দরবার, কুতুব আউলিয়ার মাজার, বড়ঘোপ সমুদ্র সৈকত, প্রাকৃতিক উপায়ে লবণ তৈরির মাঠ, কুতুবদিয়া বাতিঘর, বড়ঘোপ সরকারি স্টেডিয়াম, কালারমার মসজিদ, ফকিরা মসজিদ, ধুরুং স্টেডিয়াম, প্রাচীন দীঘির পাড় ইত্যাদি।

ভোলা জেলার মনপুরা উপজেলায় মেঘনা নদীর মোহনায় বঙ্গোপসাগরের এক অংশ জুড়ে মনপুরা দ্বীপের অবস্থান। প্রায় ৩৭৩ বর্গ কিলোমিটারের এই দ্বীপটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দ্বীপ। বনবিভাগের প্রচেষ্টায় এখানকার দশটি চরে বনায়ন কর্মসূচি পরিচালনা করা হচ্ছে। যেটি ভ্রমণ পিপাসুদের মানুষের নজরে আসতে শুরু করেছে। জীববৈচিত্র ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখি এখানকার পর্যটন আকষণ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে মনপুরা হতে পারে দেশের অন্যতম প্রধান পর্যটন কেন্দ্র।

শাহপরীর দ্বীপ-টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের কয়েকটি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত এই দ্বীপ। এটি বাংলাদেশের স্থলভাগের একেবারের দক্ষিণ সীমান্ত এরপর বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউ আর বিস্তৃত জলরাশি। এখনকার স্থানীয়দের প্রধান পেশা মাছ শিকার ও লবণ চাষ। নয়নাভিরাম সাবরাং পর্যটক আকর্ষণের সব রুপ লাবণ্য নিয়ে বসে আছে।

বাংলাদেশের দ্বীপ অঞ্চলগুলোর সৌন্দর্য প্রাকৃতিগত ভাবেই বৈচিত্রময়। এখানকার প্রত্যেকটা দ্বীপ আলাদা সৌন্দর্য আলাদা আবেদন নিয়ে দখল করে আছে পর্যটন মানচিত্র। যথাযথ পরিকল্পনা করে দ্বীপ ভিত্তিক পর্যটন ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারলে, পর্যটনই হবে দেশের টেকসই উন্নয়নের প্রধানতম হাতিয়ার।

মোঃ সাইফুল্লার রাব্বী,
প্রভাষক, ট্যুরিজম এ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ,ড্যাফোডিল ইনিস্টিউট অব আইটি।
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান – বাংলাদেশ সোসাইটি ফর ট্যুরিজম ইনোভেশন – বিএসটিআই

Leave a Reply