পর্যটন শিল্পের বিকাশে বাংলাদেশ এভিয়েশন এন্ড ট্যুরিজম মিডিয়া ফোরামের প্রস্তাবনা

Share on Facebook

পৃথিবীতে প্রকৃতির অফুরন্ত সম্ভার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কত নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, সাগর-মহাসাগর, বন-বনানী সৌন্দর্যের অপরূপ ডালি সাজিয়ে রেখেছে প্রকৃতি। মানুষ অসীম আনন্দ আর অপার আগ্রহ নিয়ে এ নৈসর্গিক সৌন্দর্যকে অবলোকন করার জন্য দেশ ভ্রমণে ছুটে চলছে। এ যেন এক দূরন্ত নেশা। এর মাঝে যে রোমাঞ্চ রয়েছে তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। জীবনের আনন্দকে পরিপূর্ণরূপে উপভোগের জন্য, জীবন ও জগতকে জানার জন্য এবং বিশ^ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশ ভ্রমণ অপরিহার্য। দেশ ভ্রমণ না করলে প্রকৃতির অফুরন্ত সৌন্দর্য আমাদের দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যায়। মনকে প্রশস্ত করার জন্য আর সত্যিকারের জ্ঞান ও আনন্দ লাভের জন্য দেশ ভ্রমণের বিকল্প নেই। তবে মানুষ তার সহজাত প্রবৃত্তির জন্যই শুধু দেশ ভ্রমণ করে না। সভ্যতা এবং সংস্কৃতির ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো চাক্ষুষ দেখার জন্য মানুষের মন উন্মুখ থাকে। তাইতো সে ভৌগলিক ও ঐতিহাসিক তথ্যগুলোকে বাস্তবে দেখার জন্য দেশ ভ্রমণে ছুটে যায়। ভৌগলিক স্থানগুলোকে চাক্ষুষ দেখলে তার জ্ঞানের পরিপূর্ণতা আসে আর ঐতিহাসিক স্থানগুলো দেখলে ইতিহাসের সোনালী পৃষ্ঠাগুলো তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। অতীতের কাহিনীগুলো যেন জীবন্ত হয়ে ধরা দেয় তার চোখে। দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা মানুষের হৃদয়কে প্রচণ্ডভাবে আলোড়িত করে। মানব চরিত্রের এ বৈশিষ্ট আধুনিক বিশ্বে পর্যটনকে একটি শিল্পরূপ দিয়েছে। তাই আধুনিক বিশ্বে দেশ ভ্রমণকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে পর্যটন ও এর সঙ্গে সম্পর্কিত সেবা সেক্টর একক বৃহত্তম শিল্প হিসেবে অন্য সব কিছুকে অতিক্রম করে গেছে। সর্বাধিক মূলধন বিনিয়োগ ও সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে এ খাতেই পৃথিবীর সর্বাধিক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ দু’ভাবেই পৃথিবীর বেকার সমস্যা সবচেয়ে দ্রুত সমাধান হচ্ছে পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর আমাদের এই বাংলাদেশে। এদেশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য পর্যটন কেন্দ্র। কক্সবাজারে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, সুন্দরবনের মায়াময় সবুজ, সাগরকন্যা কুয়াকাটা, মাধবকুণ্ডের নৈসর্গিক দৃশ্য, লালমাই পাহাড়ের সুদৃশ্য বনরাজি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় বস্তু। বাংলাদেশের এসব মনোলোভা প্রাকৃতিক দৃশ্য ও নানা নিদর্শনকে সামনে রেখে পর্যটনকে বিকশিত করে এক দারুন সম্ভানাময় ও লাভজনক শিল্পে রূপান্তর করা সম্ভব। অথচ বাংলাদেশ আজও পর্যটনকে পরিপূর্ণ শিল্পরূপে গড়ে তোলার কোনো ভিত্তি গড়ে তুলতে পারেনি। বিশ্ব প্রেক্ষাপট বাদ দিলেও শুধু দক্ষিণ এশীয় পটভূমিতে বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের অবস্থা অত্যন্ত নড়বড়ে। ভারতে যেখানে এক বছওে পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ২৩ লাখ, নেপালে ৪ লাখ, সেখানে বাংলাদেশে বছরে যে পরিমাণে পর্যটক আসে তা হতাশাব্যঞ্জক। পর্যটনের ক্ষেত্রে আমরা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ শ্রীলঙ্কা ও ধর্মীয় বিধিনিষেধের দেশ ইরানের চেয়েও পিছিয়ে রয়েছি। এ পরিসংখ্যান থেকে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের দৈন্যদশা সহজেই অনুমান করা যায়। অথচ বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পকে গড়ে তোলার জন্য দর্শনীয় স্থানের অভাব নেই। এদেশের নদীবিধৌত সবুজ প্রকৃতি, পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, কোরাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসভূমি সুন্দরবন, দক্ষিণ-পশ্চিমের পাহাড়িয়া অঞ্চল, কুমিল্লার ময়নামতি, ঈশা খাঁর রাজধানী সোনারগাঁও, সিলেট অঞ্চলের পাহাড়ঘেরা নয়নাভিরাম চা বাগান পর্যটনের জন্য দারুণ সম্ভাবনাময় স্পট। এছাড়া আমাদের দেশে রয়েছে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পর্যটকদের দর্শনীয় স্থান ময়নামতি, পাহাড়পুর ও মহাস্থানগড়ের মতো সমৃদ্ধ ও সুপ্রাচীন কীর্তি যা বিশে^র আর কোথাও নেই। দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে এসব দর্শনীয় স্থানের উপস্থাপন ও সেসব জায়গায় ভ্রমণের জন্য উৎসাহিত করছে দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া। বিশেষ করে এভিয়েশন ও ট্যুরিজম বিষয়ক পত্রপত্রিকা ও মিডিয়াগুলো পর্যটন শিল্পের বিকাশে সরকারের সহযোগি হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যদিও এসব মিডিয়া ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মিডিয়াকর্মীরা তাদের দায়িত্ব পালনে নানামুখী সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এসব সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা থেকে উত্তরণ কোনো মিডিয়ার একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই এভিয়েশন ও ট্যুরিজম বিষয়ক মিডিয়া ও এর কর্মীদের যাবতীয় সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজে বের করা ও বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে কার্যকর ভূমিকা পালনের প্রত্যয়ে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ এভিয়েশন এ্যাণ্ড ট্যুরিজম মিডিয়া ফোরাম (বিএটিএমএফ)। ফোরামের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই দেশের এভিয়েশন ও ট্যুরিজম রিলেটেড পত্র-পত্রিকা ও অনলাইন মিডিয়াগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে সমন্বিতভাবে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে।
দেশের পর্যটন শিল্পের প্রচার, প্রসার ও বিকাশে ফোরামের পক্ষ থেকে ১১টি প্রস্তাবনা তুলে ধরছে :
এক : বাংলাদেশের পর্যটনকে শিল্পরূপে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান এবং পাশাপাশি এর জন্য একটি সুপরিকল্পিত ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
দুই : পর্যটন খাতের উন্নয়নের জন্য একটি শক্তিশালী ট্যুরিজম কাউন্সিল গঠন করতে হবে।
তিন : ব্যক্তি মালিকানায় ট্যুরিজম শিল্প ও সেবা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যগুলো দূর করতে হবে।
চার : বেসরকারী উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে প্রণোদনা-ব্যাংকঋণ প্রদান করতে হবে।
পাঁচ : ট্যুরিজম সংশ্লিষ্ট সরকারী-বেসরকারী উদ্যোক্তা ও শ্রমিক-কর্মচারী সকলের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
ছয় : পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও প্রসারের জন্য বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় সরকারী উদ্যোগে পর্যটন আকর্ষণ সমূহের প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কেননা, পর্যটন শিল্পের পণ্য সমূহকে জনগণের কাছে পরিচিত করা এবং উক্ত পণ্যের বাজার সৃষ্টির প্রধান উপায় হচ্ছে প্রচার বা বিজ্ঞাপন।
সাত : দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ট্যুরিজম শিক্ষা কোর্স চালু ও স্টাডি ট্যুরের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে ছাত্র-ছাত্রীরা নির্মল বিনোদনের পাশাপাশি দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যসমৃদ্ধ নিদর্শনসমূহ চাক্ষুষ দেখার মাধ্যমে জ্ঞানভিত্তিক সুশৃঙ্খল জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়।
আট : টেকসই পর্যটন শিল্প গড়ে তুলতে যুব পর্যটন ও গ্রামীণ পর্যটন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই, দেশে প্রয়োজনীয় যুব পর্যটন ও গ্রামীণ পর্যটন অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে।
নয় : দেশে একটি স্বতন্ত্র ট্যুরিজম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
দশ : পর্যটন অর্থনীতি গড়ে তোলা এবং ট্যুরিজম ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা চালু করতে হবে।
এগার : দেশের এভিয়েশন ও ট্যুরিজম বিষয়ক মিডিয়া ও এর কর্মীদের যাবতীয় সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এক কথায় বলা যায়, পযটনশিল্প বিকাশে বাংলাদেশ অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ; যেমন-সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যাণ্ড, শ্রীলঙ্কা, ভারত ও ভুটান পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে বার্ষিক আয় করছে কোটি কোটি ডলার। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি ও মিডিয়ার যুগ হওয়ার পরও আমরা পর্যটন স্পটগুলোকে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে তুলে ধরতে পারছি না। এক্ষেত্রে দেশের প্রিন্ট মিডিয়া, অনলাইন মিডিয়া ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ^ব্যাপী তুলে ধরতে হবে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকে। পাশাপাশি দেশের প্রতিটি পর্যটন স্পট সম্পর্কে ডিজিটাল ইনফরমেশন প্রদান করতে পারলে পর্যটকদের কাছে স্থান নির্বাচনের পূর্বপ্রস্তুুতিসহ পরিবহন, হোটেল-মোটেল বুকিং দেয়া সহজতর হবে। পর্যটকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা অত্যন্ত জরুরী। এক্ষেত্রে দেশের সকল বিমানবন্দর, রেল স্টেশন, গুরুত্বপূর্ণ বাসস্ট্যাণ্ড এবং দর্শনীয় স্থান সমূহে ট্যুরিস্ট পুলিশফাঁড়ি স্থাপন করতে হবে। করোনা পরবর্তী আর্থিক ক্ষতি থেকে উত্তরণের জন্য এখনই সম্মিলিত প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে।
বর্তমান বিশ্ব ও দেশীয় প্রেক্ষাপটে পর্যটনকে আর খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর আমাদের এই বাংলাদেশের উন্নয়নে পর্যটনশিল্প অন্যতম প্রধান ভূমিকা রাখতে পারে। বিশে^র অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও পর্যটনশিল্প বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশে বর্তমানে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পকে বিকশিত করার জন্য দেশের মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি ও তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আমাদের দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে আরো আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলতে হবে এবং এগুলো সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার-প্রচারনা চালাতে হবে। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে দেশের এভিয়েশন ও ট্যুরিজম রিলেটেড মিডিয়াগুলো এবং এসব মিডিয়ার যাবতীয় সমস্যা নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বদ্ধপরিকর বাংলাদেশ এভিয়েশন এ্যাণ্ড ট্যুরিজম মিডিয়া ফোরাম (বিএটিএমএফ)।
পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের দেশের জাতীয় উন্নয়ন ও অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে একমাত্র পর্যটনশিল্পই পালন করতে পারে অন্যতম প্রধান ভূমিকা। তাই করোনা পরবর্তী পর্যটন শিল্পের বিকাশে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে কালক্ষেপণের কোনো অবকাশ নেই।

কাজী রহিম শাহরিয়ার
প্রতিষ্ঠাতা ও আহবায়ক, বাংলাদেশ এভিয়েশন এ্যাণ্ড ট্যুরিজম মিডিয়া ফোরাম (বিএটিএমএফ)
সম্পাদক ও প্রকাশক, দি ম্যাসেজ বাংলাদেশ।

Leave a Reply