ট্যুরিজম ব্যাংকিংয়ের প্রস্তাবিত রূপরেখা

Share on Facebook

ট্যুরিজম ব্যাংকিং একটি উদ্ভাবনীমূলক ব্যাংকিং কর্মকান্ড যা যুগের চাহিদা পূরণের জন্য এখন আমাদের কড়া নাড়ছে। Global জিডিপিতে এর অবদান ১০%, মোট কর্মসংস্থানের ১০% ব্যবস্থা করে দিয়েছে পর্যটন এবং সারা স্বল্পোন্নত দেশগুলির রপ্তানি আয়ের মোট ৬% আসে পর্যটন থেকে। বাংলাদেশের পর্যটন ২০১৯ সালে জিডিপিতে ৭৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকার অবদান রেখেছে, সাড়ে ১৮ লক্ষ কর্মীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে এবং বিদেশি পর্যটকদের কাছ থেকে আমাদের নস্ট্রো হিসাবে (Nostro Account) যোগ করেছে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকার সমমুল্যের বৈদেশিক মুদ্রা। তাই আজকের দিনে এই ধরণের ব্যাংকিংকে আমরা স্বাগত জানাতে চাই। বলা বাহুল্য যে, বাংলাদেশে এইজন্য নতুন কোন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন নেই। ইসলামী ব্যাংকিং এবং এসএমই ব্যাংকিংয়ের মতো প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে একটি আলাদা উইং থাকলেই যথেষ্ট।

ব্যাংকিং বলতে আমানত সংগ্রহ করা এবং উক্ত আমানত থেকে ঋণ ও অগ্রিম প্রদান করার কার্যক্রমকে বুঝায়। ব্যাংকিংয়ের সংজ্ঞা এতো ছোট হলেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এর অবদান অনেক ব্যাপক। তাই আধুনিক কালে কোন সভ্য, সৃজনশীল এবং অগ্রসর জাতি-গোষ্ঠী ব্যাংকিং ছাড়া চলতে পারে না। জীবনধারার প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে ব্যাংকিংয়ের কোন কোন সেবা তো লাগেই। রেমিট্যান্স, আমাদানি, রপ্তানিসহ অন্য যে কোন সেবা হলো ব্যাংকের সহযোগী সেবা। বাণিজ্যের ভাষায় ট্যুরিজম একটি কমার্স যেখানে ট্রেডিং, ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট এবং ইনভেস্টমেন্ট হয়। অর্থনীবিদগণ পরিমাপ করে একে পৃথিবীর ৩য় বৃহত্তম শিল্প হিসেবেও স্বীকৃতি দিয়েছেন। এই অবস্থায় একটি বিশেষায়িত ব্যাংকিংয়ের চিন্তাকে কোনভাবেই খাটো করে দেখার সুযোগ নাই। বরং আমরা এতোদিন কেন ট্যুরিজম ব্যাংকিং সৃষ্টির উপর গুরুত্ব আরোপ করি নাই, সেটাই প্রশ্ন সাপেক্ষ।

ট্যুরিজম ব্যাংকিংয়ের প্রয়োজনীয়তা:
ট্যুরিজমে ব্যাংকিং সমসাময়িক পর্যটনে বহুমাত্রিক প্রয়োজনীয়তার সৃষ্টি করেছে। এর উজ্জ্বল প্রমাণ মেলে নেপালের ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের দিকে নজর দিলে। ২০০৯ সালে এই ব্যাংকটি নেপালের পর্যটন খাতকে অর্থনৈতিক বিশেষ খাত হিসেবে ফোকাস করে এর অবকাঠামো গড়ে তোলাসহ অন্যান্য কারিগরি ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের উদ্দেশ্যে স্থাপিত হয়। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ট্যুরিজম ফাউন্ডেশন ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের যৌথ উদ্যোগে একই বিশ^বিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে বাংলাদেশে ট্যুরিজম ব্যাংকিংয়ের প্রয়োজনীয়তা শীর্ষক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত কনফারেন্সে ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. পুষ্পরাজ কান্দেল তাঁর বক্তব্যে বলেন যে, এই ব্যাংকের প্রধান লক্ষ্য ছিলো পর্যটনকে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করার মাধ্যমে নেপালের দারিদ্র্য বিমোচন করা। এই বক্তব্য থেকে নেপালের মতো বাংলাদেশের পর্যটনের ক্ষেত্রেও ট্যুরিজম ব্যাংকিংয়ের প্রয়োজনীয়তা সমন্বন্ধে অনুধাবন করতে পারি। উক্ত কনফারেন্সে আরো উপস্থিত ছিলেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী জনাব আবদুল মান্নান, ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মি. মনোজ খাদকা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর জনাব আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী। কনফারেন্সে ট্যুরিজম ব্যাংকিংয়ের বহুবিধ বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। যার ভিত্তিতে বাংলাদেশে নিচের প্রয়োজনীয়তাগুলিকে চিহ্নিত করা যায়।

সাধারণ প্রয়োজনীয়তা-
– ব্যাংক ব্যবসায় বহুমুখিতা সৃষ্টির মাধ্যমে আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রবর্তন করা।
– পর্যটনের মতো বৃহৎ খাতের জন্য বিশেষ ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করা।
– ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ট্যুরিজম বিষয়ে নতুন নতুন প্রডাক্ট লাইন তৈরি করা।

বিশেষায়িত প্রয়োজনীয়তা-
– ট্যুরিজম ট্রেড এন্ড কমার্সের জন্য বিশেষ ধরণের ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করা।
– ট্যুরিজমে শিল্পঋণ ও ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বিতরণের আওতায় আনা।
– ট্যুরিজম এসএমইকে উৎসাহ প্রদানের জন্য রেয়াতি হারে ঋণদান করা।
– ট্যুরিজমের কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপখাতকে রিফাইন্যান্সিংয়ের আওতায় আনা।
– ঋণদানের ক্ষেত্রে প্রাথমিক জামানত গ্রহণের নীতি অনুসরণ করা।
– বাস্তব কারণ বিবেচনা করে Repayment Schedule নির্ধারণ পলিসি তৈরি করা।

ট্যুরিজম ব্যাংকিং পরিচালনা:
এই ধরণের উদ্ভাবনীমূলক ব্যাংকিং পরিচালনার জন্য প্রথাগত নিয়ম ভেঙ্গে সৃজনশীল ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। গণমুখী ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করতে না পারলে দেশের অর্থ-বাণিজ্য ও শিল্পখাত এর প্রকৃত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। ফলে ট্যুরিজমের মতো প্রগতিশীল এবং অবদানমুখী একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজারে মাথা উচুঁ করে দাঁড়াতে পারবে না। আবার বাংলাদেশ ব্যাংককেও কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, দেশটাকে গড়তে হলে সকলকেই তার স্থান থেকে সাধ্যমতো অবদান রাখতে হবে।

ক) বাংলাদেশ ব্যাংককে ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (CRR) অন্তত ০.৫% ছাড় দিতে হবে।
খ) ব্যাংকগুলি ডিপোজিট ব্যাংকিংকে উৎসাহিত করার জন্য সুদের হার ০.৫% বেশি ধার্য করতে হবে।
গ) ট্যুরিজম বিষয়ে গ্র্যাজুয়েট এবং পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট যুবাদেরকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে।
ঘ) প্রডাক্ট লাইন উন্নয়ন, ঋণের মেয়াদ নির্ধারণ, ঋণদান নীতি প্রণয়ন, পরিচালনা কাঠামো নির্ধারণ এবং প্রাথমিক মনিটরিংয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ট্যুরিজমে অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গকে কনসালটেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিতে পারে।

ট্যুরিজম ব্যাংকিংয়ের রূপরেখা:
সাধারণ ব্যাংকিং কার্যক্রমের মতো ট্যুরিজম ব্যাংকিংয়ে ট্যুরিজমের নানান উপখাত থেকে আমানত সংগ্রহ এবং বিভিন্ন উপখাতে ঋণ ও অগ্রিম ব্যবস্থা চালু করার মধ্য দিয়ে এই ধরণের ব্যংকিংয়ের সূচনা হতে পারে। সাথে ডলার এনডোর্সমেন্ট, ট্রাভেল ট্যাক্স আদায়, ট্রাভেল এজেন্সির মতো এয়ারলাইন্সের টিকিট বিক্রয়, হোটেল বুকিং, অন্য ট্যুর অপারেটরের পক্ষে প্যাকেজ ট্যুরে ব্ক্রিয় এবং ভ্রমণবিমার পলিসি বিক্রয় ইত্যাদি ট্যুরিজম ব্যাংকিংয়ের বিবিধ সেবা হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। ট্যুরিজম ব্যাংকিং সম্বন্ধে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-

ক) আমানত ব্যাংকিং (Deposit Banking):
– ট্যুরিজম সেভিংস ব্যাংক একাউন্ট: ট্যুরিজম ব্যবসা, চাকুরি বা অন্য যে কোন কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ এবং তাদের স্পাউস (Spouse) ও পুত্র/কন্যারা এই হিসাব খুলতে পারেন।
– ট্যুরিজম কারেন্ট ডিপোজিট একাউন্ট: ট্যুরিজমের যে কোন উপখাতের (হোটেলসহ যে কোন পর্যটন আবাসন, রেস্টুরেন্টসহ যে কোন কালিনারি কার্যক্রম, ক্যাটারিং ও খাদ্য সরবরাহ ব্যবসা, রেন্ট-এ-কার, রাইড শেয়ারিং, বাস, ট্রেনসহ সকল পর্যটন পরিবহন, ট্যুর গাইড, ল্যান্ড অপারেটর, ট্যুর অপারেটর, ট্রাভেল এজেন্ট, থিমপার্ক, এমিউজমেন্ট পার্কসহ যে কোন ধরণের পর্যটন বিনোদন প্রতিষ্ঠান, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান, মেলা ইত্যাদি) ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা এই ধরণের একাউন্ট খুলেতে পারেন।
– সর্ট টার্ম ডিপোজিট একাউন্ট (STD A/C): ব্যাংকিং নীতি ও বিবেচনায় ট্যুরিজম কিছু ব্যবসায়ের জন্য সঞ্চয়ী হিসাবের চেয়ে কম সুদহারে এই ধরণের আমানত ব্যবস্থা চালু করা যায়।
– ফিক্সড ডিপোজিট রিসিপ্ট একাউন্ট ( FRD A/C): সাধারণ এফডিআর-এর চেয়ে ০.৫% বেশি সুদহারে ট্যুরিজম ব্যবসায় বা ব্যবসায়ীদের জন্য এই ধরণের হিসাব প্রবর্তন করা যেতে পারে।

খ) ঋণ ও অগ্রিম (Loans and Advances):
– পর্যটন আবাসন ঋণ: হোটেল, মোটেল, বোটেল, রিসোর্ট, হোমেস্টে, কটেজ, ট্রিহাউজ, টাইম শেয়ার, সেনেটারিয়াম, তাঁবু, বাংলো, রিক্রিয়েশনাল রিসোর্ট, আয়ুর্বেদিক রিসোর্ট, ইয়ুথ হোস্টেলসহ বাংলাদেশে প্রযোজ্য যে কোন পর্যটন আবাসনের জন্য এই ধরণের স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি ঋণ চালু করা যেতে পারে।
– খাদ্য ও পানীয় ঋণ: দেশিয় ও বিদেশি যে কোন খাবারের রেস্টুরেন্ট, ক্যাটারিং, ক্যাফে, ফাস্ট ফুডসহ পানীয়, ফুড প্রসেসিং এন্ড প্যাকেজিং ইত্যাদিকে এই ধরণের ঋণ কার্যক্রমের আওতায় আনা যায়।
– পর্যটন পরিবহণ ঋণ: রেন্ট-এ-কার, রাইড শেয়ারিং, ট্যুরিস্ট মোটরযান (অটোরিক্সা, মিনি বাস, মাইক্রো বাস, বাস), নন-মোটরযান (ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা, বাইসাইকেল, রিক্সা ভ্যান), নৌপরিবহন (স্পিড বোট, ট্যুরিস্ট রিভার ও মেরিন ভ্যাসেল, স্টিমার, ক্রুজশীপ, নৌকা), আকাশযান (হেলিকপ্টারসহ যে কোন আকাশযান) ইত্যাদি যে কোন যানবাহনকে এই ধরণের ঋণের আওতায় আনা যেতে পারে।
– বিনোদন ঋণ: পার্ক ও উদ্যান (থিমপার্ক, এমিউজমেন্ট পার্ক, শিশু পার্ক, ওয়াটার পার্ক, হেরিটেজ পার্ক, অরচার্ড পার্ক, গ্রীণ পার্ক ইত্যাদি), থিয়েটার, সিনেমা, চিড়িয়াখানা, গলফ কোর্স, ওয়াটার স্পোর্টস ইক্যুইপমেন্ট, হট এয়ার বেলুন, প্যারাগøাইডিং ইক্যুইপমেন্ট ইত্যাদি পর্যটন কার্যক্রমে ব্যবহৃত হয় এমন সকল যান্ত্রিক, অযান্ত্রিক এবং ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ক্রয়, মেরামত ও ব্যবস্থাপনার জন্য এই ঋণের প্রবর্তন করা যেতে পারে।
– সুভেনির এন্ড গিফট ঋণ: পর্যটকদের জন্য হস্তশিল্প, কারখানায় উৎপাদিত পণ্যসহ ছোটখাট যে কোন প্রকার সুভেনির উৎপাদন, প্রমোশন ও বিক্রয় এবং ট্যুরিজম গিফট সপ স্থাপনের জন্য এই ঋণের প্রবর্তন করা যায়।
– ট্যুরিজম প্রশিক্ষণ ঋণ: ট্যুরিজমের প্রত্যেকটি উপখাতের কর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন, সেটেলাইট ট্রেনিং সেন্টার পরিচালনা ইত্যাদির জন্য এই ঋণ চালু করা যেতে পারে।
– ট্যুরিজম মিডিয়া এন্ড পাবলিকেশনস্ ঋণ: ট্যুরিজম দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা, বই, জার্নাল, বুলেটিন, অনলাইন ট্যুরিজম পত্রিকা, ট্যুরিজম বিষয়ে ডকুমেন্টারি, ড্রামা ও ট্যুরিজম সিনেমা তৈরি ইত্যাদির জন্য এই ধরণের ঋণের সূচনা হওয়া দরকার।
– ট্রাভেল লোন: যে সকল ভ্রমণকারীরা দেশের ভিতরে অথবা বাইরে যেতে ইচ্ছুক তাদের ও তাদের স্পাউসদের জন্য ট্রাভেলার্স লোন প্রবর্তন করা যেতে পারে।

– বিবিধ ঋণ: ট্যুর অপারেটর, ট্রাভেল এজেন্সি, প্রতিবন্ধীদের জন্য পর্যটন উদ্যোক্তা ঋণ, পর্যটন গ্রাম স্থাপন, একুয়ারিয়াম, হার্বেরিয়াম স্থাপন, কালাচারাল শো, এক্সিবিশন হল ইত্যাদি বহু ধরণের সৃজনশীল কার্যক্রমে ঋণ ব্যবস্থা চালু করার জন্য ব্যাংকগুলিকে উদার ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

গ) শিল্পঋণ (Industrial Credit):
পর্যটন পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম শিল্পখাত। তাই গুরুত্বের সাথে এই খাতে শিল্পঋণ চালু করার জন্য ব্যাংকগুলিকে এগিয়ে আসতে হবে। এই ক্ষেত্রেও ব্যাংকগুলির উদার ও সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি একান্ত প্রয়োজন।

পর্যটন আবাসন যেমন হোটেল নির্মাণ, খাদ্য ও পানীয়ের বড় রেস্টেুরেন্ট স্থাপন, এমিউজমেন্ট ও থিমপার্ক, বড় উদ্যান স্থাপন ও আন্তর্জাতিক মানের বিনোদন কেন্দ্র স্থাপন, বড় আকারে স্যুভেনির তৈরির শিল্পকারখানা ইত্যাদির ক্ষেত্রে শিল্পঋণ প্রদান করা যেতে পারে। তবে অন্য ঋণের চেয়ে ঋণ : সহ-জামানত হার ১০-২০ ভাগ হ্রাস করে Minimum সহ-জামানত হার নির্ধারণ করলে এই ধরণের ঋণ পর্যটন শিল্পে বিশেষ প্রণোদনা যোগাবে।

ঘ) বিবিধ সেবা (Miscellaneous Service):
ট্যুরিজম ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নিচের সেবাসমূহ প্রদান করলে একদিকে যেমন ব্যাংকের আয় বাড়বে, অন্যদিকে পর্যটকরা একই স্থান থেকে প্রয়োজনীয় সেবাগুলি সহজেই ও বিশ^স্ততার সাথে পেতে পারবেন।
– ট্রাভেল এজেন্সির দায়িত্ব পালন: এয়ারলাইন্স, বাস, স্টিমার, ট্রেন ইত্যাদির টিকেট বিক্রয়, হোটেল বুকিং, অন্য ট্যুর অপারেটরের পক্ষে ট্যুরের প্যাকেজ বিক্রয় ইত্যাদি।
– ট্রাভেল বিমার পলিসি বিক্রয়: দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের নিকট সরকারি ও বেসরকারি বিমা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ভ্রমণবিমার পলিসি বিক্রয়।
– অন্যান্য সেবা: পাসপোর্টের ফি সংগ্রহ, অনুমোদিত ভিসা প্রসেসিং কার্যক্রম পরিচালনা, ডলার এনডোর্সমেন্ট, বৈদেশিক মুদ্রা বেচাকেনা ইত্যাদি।

ঋণের সিকিউরিটি:
ক) ট্রেড বডির সদস্যদেরকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে পর্যটনঋণ প্রদান করা উচিত। সংশ্লিষ্ট ট্রেড বডির সদস্য সার্টিফিকেট জমা নেওয়া যেতে পারে।
খ) প্রাইমারি সিকিউরিটি এবং গ্যারান্টিকে প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে। আতœীয়স্বজন ছাড়াও সংশ্লিষ্ট ট্রেড বডির অফিস বিয়ারারগণের ব্যক্তিগত গ্যারান্টি গ্রহণ করলে সিকিউরিটি গ্রহণ সহজতর ও নিরাপত্তা ইস্যু রক্ষিত হয়।
গ) সহজামানতের ক্ষেত্রে সহনীয় পরিমাণ ও উপযুক্ত ৩য় পার্টির স্থাবর কিংবা অস্থাবর সম্পত্তিকে বিবেচনা করা যায়।

পরিশোধ সূচি:
ক) সকল ঋণের ক্ষেত্রে সম্মত Minimum গ্রেস পিরিয়ড সৃষ্টি করা বাঞ্ছনীয়।
খ) ব্যবসার ধরণ এবং সিজন বুঝে পরিশোধ সুচি নির্ধারণ করা উচিত। কেননা, পর্যটন ব্যবসায় উপর ঋতুর প্রভাব দৃশ্যমান।

সুদের হার:
ক) রিফাইন্যান্সিং ঋণের সুদহার বার্ষিক ৪%-এর বেশি হওয়া উচিত না।
খ) অন্যান্য ঋণে ও অগ্রিমের ক্ষেত্রে কস্ট অব ফান্ডের সাথে সর্বোচ্চ ৪% যোগ করে সুদহার নির্ধারণ করা উচিত।

গ্রাহক মনোনয়ন:
ক) প্রকৃত ব্যবসায়ী। তবে সংশ্লিষ্ট ট্রেড বডি / চেম্বারের মেম্বারদেরকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে মনোনয়ন দেওয়া যেতে পারে। এতে গ্রাহক চিহ্নিতকরণ, তার মান নির্ধারণ ও অভিজ্ঞতা যাচাই নির্ভরযোগ্যভাবে করা যায়।
খ) ব্যবসায়ের অভিজ্ঞতা।
গ) কণঈ এবং ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্ক।
ঘ) লেনদেন চিত্র।
ঙ) জামানত দেওয়ার সক্ষমতা।

ঋণ প্রদানের অর্থের উৎস:
আগামী দিনে ব্যাংকগুলি নানাবিধ জাতীয় ও বৈশি^ক কারণে আমানত সংকটে ভুগতে পারে। তাই ট্যুরিজম ডিপোজিট ব্যাংকিং থেকে প্রাপ্ত অর্থই ট্যুরিজম ঋণ ও অগ্রিমের অর্থের প্রধানতম উৎস হিসেবে কাজ করতে হবে। তবে ঋণ প্রবাহের গতিবিধি পর্যালোচনা করে আমানত সংগ্রহের নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে অথবা ব্যাংকের সাধারণ আমানতের অর্থ ব্যবহার করতে হবে।

উপসংহার:
বাংলাদেশের ব্যাংকিংয়ে গতিশীলতা আনা এবং প্রগতিশীল ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে এই ধরণের ব্যাংকিং চালু করার গুরুত্ব অপরিসীম। ট্যুরিজম ব্যাংকিং কেবল অভ্যন্তরীণ জিডিপিতে অবদানের জন্যই সহযোগিতা করবে না। বরং ব্যালেন্স অব ট্রেড এবং ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ঘাটতি পূরণেও বিশাল অবদান রাখবে। নেপাল যেমন ট্যুরিজম ডেলেপমেন্ট ব্যাংক স্থাপন করে পৃথিবীতে এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। আমরাও চাই বাংলাদেশের ব্যাংকগুলিতে ট্যুরিজম ব্যাংকিং চালু করে আরেকটি উদাহরণ সৃষ্টি করতে। কারণ, ট্যুরিজম ব্যাংকিং নামে স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যাংকিং ব্যবস্থা এখনো কোথাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে আমাদের জানা নাই। তাই আশা করতে চাই, ব্যাংকিং ব্যবস্থার এই উদ্ভাবন পৃথিবীর পর্যটনকে নতুন পথের সন্ধান দিবে।

লেখক: আহ্বায়ক, ‘সম্মিলিত পর্যটন জোট’ এবং সভাপতি, বাংলাদেশ ট্যুরিজম ফাউন্ডেশন

Leave a Reply