কাশ্মীর; দ্যা হ্যাভেন অব আর্থ

Share on Facebook

ভূ-স্বর্গ কাশ্মীর দেখবো বলে অপেক্ষা করছি অনেকদিন। সাধ ও সাধ্যের মধ্যে থাকলেও সময় যেনো ধরাই দিচ্ছিলো না কোনোভাবে। এ জীবনে কি আর কাশ্মীর দেখা হবে না! কাশ্মীরের ডাল লেকে শিকারা ভ্রমণ করা ছাড়া জীবন যেনো পানসে হয়ে যাচ্ছিলো দিন দিন। তাই এবার আটঘাট বেঁধেই কাশ্মীর ভ্রমণের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উদ্যোগী হলাম। যেন পরীটা কোনোভাবেই কল্পনাকে ছেড়ে উড়ে যেতে না পারে। ভারতের ট্যুরিস্ট ভিসা আগেই নেয়া ছিলো। একদিন অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যায় কম্পিউটারে বসেই পরিবারের সবার জন্য বিমানের টিকেট ইস্যু করলাম। এরপর শ্রীনগরের হোটেল আর একদিনের জন্য হাউসবোটও বুকিং কনফার্ম করলাম ঘরে বসেই।

কাশ্মীর মূলত হিমালয়ান পর্বতমালার দুটি রেঞ্জের মধ্যবর্তী একটি উপত্যকা। ১৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ আর ৩২ কিলোমিটার প্রস্থের এ উপত্যকার একপাশে হিমালয়ের মাঝারি পর্বতমালা আর  অন্য পাশে সুউচ্চ পর্বতমালা। মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে ঝিলাম (জেহলাম) নদী। ভৌগোলিকভাবে তিন ভাগে ভাগ করা হয়, সেন্ট্রাল, নর্থ ও সাউথ। দক্ষিণে অনন্তনাগ (স্থানীয়ভাবে বলে ইসলামাবাদ), সোপিয়ান, কুলগাম ও পুলওয়ামা; মধ্যখানে বাডগাম ও গ্যান্ডারবাল ও শ্রীনগর এবং উত্তরে বারামুলা, বান্ডিপুরা ও কপুওয়ারা। এই দশটি প্রশাসনিক জেলায় বিভক্ত।

আল্লাহ্‌র নামে ২ অক্টোবর সমস্ত উৎকণ্ঠা ও উত্তেজনা বুকে নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়লাম। ঢাকা থেকে ইন্ডিগো এয়ারের সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিটের ফ্লাইটে কোলকাতা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম স্থানীয় সময় রাত প্রায় আটটায়। আমাদের পরবর্তী ফ্লাইট ভোর ৪টা ৫৫ মিনিটে। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা সেরে দুটো রিটায়ার রুম ভাড়া করে রাতভর চললো একটু ঘুমানোর ব্যার্থ চেষ্টা। রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরী?

অবশেষে সকাল ৯টা ১০ মিনিটে আমাদের বিমান আকাশ থেকে শ্রীনগর বিমান বন্দরের রানওয়ে ছোঁয়ার মধ্যে দিয়ে শেষ হলো অপেক্ষার পালা। ভ্রমণজনিত ও রাতে না ঘুমানোর ক্লান্তি নিয়ে বিমান বন্দর থেকে বাইরে এসে গাড়িতে উঠলাম। আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানাতে অপেক্ষায় ছিল হাউজবোটের মালিক ও গাইড ইউনুস আহমেদ। গাড়ি ছুটে চলেছে হাউসবোট ‘সিটি অব কাশ্মীর’ এর উদ্দেশ্যে। দারুন সুন্দর গোছানো একটা ছোট্টশহর কাশ্মীরের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে ক্লান্তি যেনো কখন উধাও হয়ে গেল।

ভুস্বর্গে প্রথমদিনঃ ভ্রমণজনিত ক্লান্তি দূরে ঠেলে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম পরিমহল, চশমাশাহী, আর শালিমারবাগ দেখতে। পরিমহল, চশমাশাহী ও শালিমারবাগ দেখতে পরিপাটি সুন্দর। অনেক সুন্দর সুন্দর ফুল আর ঝর্ণা দিয়ে সাজানো বাগান, চারপাশে বিশাল বিশাল পাহাড়। ফেরার পথে আমার একটা কার্পেট কারখানা দেখতে যাই। এখানে অনেকরকম কার্পেট, শাল, জামা-কাপড় আরো অনেক সামগ্রী সাশ্রয়ী মূল্যে বিক্রি হয়। আমরা অবশ্য কোনো কার্পেট কিনি নাই। হাউজবোটে ফিরে স্বর্গীয় একটা ঘুমের মধ্যে দিয়ে উদযাপন করা হলো আমাদের প্রথম রাত ভূ-স্বর্গ কাশ্মীরে।

আমাদের দ্বিতীয় দিনের ভ্রমণ পরিকল্পনায় ছিল বিখ্যাত হজরত বাল মসজিদ, কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয় ও মুঘল গার্ডেন দেখা। এই সবগুলো স্থাপনাই অনেক সুন্দর ও মনোমুগদ্ধকর। হজরত বাল মসজিদটা অনেকটা তাজমহলের আদলে তৈরী। এখানে অনেক কবুতর আছে। বিকালবেলা শ্রীনগরের ডাল লেকে আমাদের সেই কাঙ্ক্ষিত শিকারা ভ্রমণ। শিকারা হলো এক বিশেষ ধরণের নৌকা যেখানে সিংহাসনের মতো আসন পাতা থাকে। সেখানে বসলে আরোহীদের রাজা-রানীর মতোই মনে হয়। লেকের মাঝেই ছোট ছোট নৌকায় স্থানীয়রা বিভিন্ন প্রকার খাবার, ফলমূল, গহনা ইত্যাদি ফেরি করে বিক্রি করে। তাছাড়া লেকের পাশদিয়ে ভাসমান কিন্তু স্থায়ী অনেক দোকানপাট ও রয়েছে।

তৃতীয় দিন আমরা বেড়িয়ে পরি বিখ্যাত পাহেলগাম দর্শনে। পাহেলগামে দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে আরু ভ্যালি, বেতাব ভ্যালি, বাইসরণ ভ্যালি অন্যতম। আরু ও বেতাব ভ্যালিতে যেতে হলে আলাদা করে স্থানীয় ইউনিয়নের গাড়ি ভাড়া করতে হবে। আর বাইসরণ ভ্যালি যা মিনি সুইজারল্যান্ড নাম পরিচিত সেখানে যেতে হলে আপনাকে ঘোড়া ভাড়া করে যেতে হবে।

ঘোড়ায় করে বাইসরণ ভ্যালি ছাড়া অন্য ভ্যালিগুলোতে না গেলেও চলবে কারণ বাইসরণ ভ্যালির সৌন্দর্যের কাছে অন্য ভ্যালিগুলোর সৌন্দর্য কিছুই না। কিন্তু স্থানীয় ঘোড়াওয়ালারা আপনাকে অন্য আরো কয়েক জায়গায় যাওয়ার জন্য প্ররোচিত করতে থাকবে। শুধু বাইসরণ ভ্যালিতে গেলে খরচ ও ঝুঁকি অনেক কমে যায়। পাহেলগাম যাবার পথে প্রচুর আপেলবাগান দেখতে পাবেন। আমরা এখানকার একটা বাগানে টাটকা আপেল ও আপেলের জুস প্রাণ ভ’রে পান করেছি।

এতোদিনে কাশ্মীরের উথাল-পাথাল সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পরেছি। চতুর্থ দিনের ভ্রমণ পরিকল্পনা অনুযায়ী চলে যাই গুলমার্গ। পাহাড়ের গা বেয়ে গাড়িচলা পথটি ঘুরে ঘুরে উপরে উঠে গেছে। গুলমার্গ পৌঁছার পর ওখানকার স্থানীয় দালালরা আপনাকে ঘোড়ায় চড়ে কেবল কারের গোড়া পর্যন্ত যেতে চাপাচাপি করবে। ঘোড়া নেয়ার পর কিছুদূর গিয়েই বলবে আপনি তো একা যেতে পারবেন না, একজন গাইড নেন। এভাবে ঘোড়া আর গাইড মিলিয়ে আপনার ১২০০ রুপি চলে যাবে। আমরা অবশ্য গাড়ি থেকে নেমে হেঁটেই গিয়েছিলাম কেবল কারের গোড়া পর্যন্ত।

কেবল কার চলে দুটি ধাপে, প্রথম ধাপ গুলমার্গ থেকে কঙ্গডোর (১০১৬৭ফুট) পর্যন্ত আর দ্বিতীয় ধাপ কঙ্গডোর থেকে অপরথ (১৩০৫৪ফুট) পর্যন্ত। প্রথম ধাপ পর্যন্ত টিকেটের দাম ৭৪০ রুপি আর দ্বিতীয় ধাপ পর্যন্ত টিকেটের দাম ১৬৯০ রুপি। অক্টোবরে প্রথম ধাপে কোনো কোনো বরফ বা তুষার ছিলো না তাই যারা এরকম সময়ে কেবল কারে চড়ে শুধুমাত্র প্রথম ধাপ পর্যন্ত যেতে চান তাদের আলাদা পোশাক যেমন গামবুট বা জ্যাকেট ভাড়া করার কোনো দরকার হয় না। তবে যারা দ্বিতীয় ধাপ পর্যন্ত যেতে চান তারা আলাদা পোশাক ভাড়া করতে পারেন। কারণ দ্বিতীয় ধাপে কিছু তুষার ছিলো। কেবল কারগুলো ভূমি থেকে অনেক উপর দিয়ে চলে, মাঝেমাঝে কি কারণে যেন থেমে যাচ্ছিলো। দ্বিতীয় ধাপের কারগুলো লাল রঙের। ওগুলো আরো উপর দিয়ে প্রায় খাড়া ভাবে উঠে যায়।কেবল কার থেকে নামার পর পাহাড়ের উপর শুভ্র তুষারের স্তূপ থেকে আমার পুত্র-কন্যা আনন্দে ছুটোছুটি শুরু করলো।এবং স্বাভাবিকভাবে দুয়েকটা আলতো আছাড়ও খেলো।

আমাদের কাশ্মীর ভ্রমণের শেষ দিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী বেড়িয়ে পরি সোনমার্গের উদ্দেশ্যে। এখানেই সালমান খানের বিখ্যাত সিনেমা বাজরাঙ্গি ভাইজানের শুটিং হয়েছিলো। সোনমার্গের মূল আকর্ষন বালতাল ভ্যালি ও খাজিয়ার গ্লসিয়ার। গাড়ি থেকে নেমে আমার পুত্র কন্যা আর আমি ঘোড়ায় চেপে বালতাল ভ্যালি ও থাজিয়ার গ্লসিয়ার ঘুরে আসলাম আরামসে। এখানে ঘোড়া চলার রাস্তাটা অনেক সুন্দর। বাজরাঙ্গি ভাইজানের শুটিং স্পট দেখে মনে হলো জায়গাটা ছবির চেয়েও সুন্দর। মনে হলো এতো সুন্দর একটা জায়গা দেখার সুপ্ত বাসনা নিয়েই অপেক্ষায় ছিলাম বহুদিন।

থরে থরে সাজানো পাহাড়, পাহাড়ের উপর শ্বেতশুভ্র তুষার, ঘন সবুজ পাইনবন আর পাথুরে ঝর্ণা দেখে নয়ন-মন সার্থক করে ফিরে এলাম। এখান থেকে আমার আহ্লাদী কন্যা কিছু পাথর সুভেনির হিসাবে নিয়ে এসেছে। এই কাশ্মীরকেই মোগল বাদশাহ জাহাঙ্গীর প্রথম তুলনা করেছিলেন স্বর্গের সঙ্গে। কাশ্মীরের তৃণভূমিতে মৃত্যুবরণ করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তিনি ফার্সি ভাষায় বলেছিলেন, ‘আগার ফেরদৌস বে-রোহী যামীন আস্ত্। হামীন আস্ত্, হামীন আস্ত্, হামীন আস্ত্। যদি পৃথিবীতে কোনো বেহেশত থেকে থাকে, তাহলে তা এখানে, এখানে, এখানে।

 

লেখকঃ মুস্তাফিজ রহমান

Leave a Reply