পর্যটন গ্রামের সোনালী ভবিষ্যৎ

Share on Facebook

“ছোট গাঁওখানি – ছোট নদী চলে, তারি একপাশ দিয়া,

কালো জল তার মাজিয়াছে কেবা কাকের চক্ষু নিয়া;
ঘাটের কিনারে আছে বাঁধা তরী
পারের খবর টানাটানি করি;
বিনাসুতি মালা গাথিছে নিতুই এপার ওপার দিয়া;
বাঁকা ফাঁদ পেতে টানিয়া আনিছে দুইটি তটের হিয়া।”

জসিম উদ্দিনের এই কবিতাটা পড়লেই চোখের সামনে কেমন ছবির মত সুন্দর একটা গ্রামের দৃশ্য ভেসে উঠে না? হ্যাঁ, আমাদের দেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। সুজলা-সুফলা শস্য শ্যামলা আমাদের এই দেশ বসুন্ধরা। মাঠের পর মাঠ ফসলি জমি, এঁকে-বেঁকে চলেছে অসংখ্য নদী, চারিদিকে সবুজ সবুজ ছোট বড় বিভিন্ন গাছের সারি, বিভিন্ন ধর্মের মানুষ, বিভিন্ন পেশার মানুষ মিলে-মিশে একসঙ্গে বসবাস করি এই ছোট্ট দেশটিতে। এই অপরূপ দৃশ্য দেখলে মন ভরে যায়। মনে হয় যেন স্বর্গের থেকেও সুন্দর আমাদের এই দেশ।

আমাদের দেশ কৃষি প্রধান দেশ। আমাদের দেশ নদী মাতৃক দেশ। আমাদের আছে গ্রাম ভিত্তিক সমাজ ব্যাবস্থা। আমরা অতিথি পরায়ণ এবং আমাদের আছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। এছাড়াও প্রাকৃতিক সম্পদের সম্ভারতো আছেই। একটি দেশের পর্যটন উন্নয়নের জন্য এরচেয়ে বেশী আর কি চাই? প্রতিটা দেশের নিজেস্ব কৃষ্টি সাংস্কৃতি, প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট রয়েছে। একজন পর্যটক সেই ভিন্নতার রস আস্বাদনের জন্যই নানান দেশে ঘুরে বেড়ায়। আর এমন রস বৈচিত্র যে এদেশে প্রচুর আছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের যা দরকার তা হলো রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা, প্রাকৃতিক সম্পদকে পর্যটন পণ্যে রূপান্তর, দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন, সুদূরপ্রসারী টেকসই পরিকল্পনা এবং তার সঠিক বাস্তবায়ন।

সার্কভূক্ত চারটি দেশে অর্থাৎ ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে পর্যটন গ্রাম রয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অরুণাচল ও সিকিমে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অনেকগুলি পর্যটন গ্রাম গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন ১৯৯০ সালে “ওয়ান ভিলেজ ওয়ান ডেস্টিনেশন” নামে প্রচারাভিযান চালিয়েছিলো। তথাপি আমাদের কোন পর্যটন গ্রাম নেই। অথচ বাংলাদেশে আছে প্রায় ৮৭ হাজার গ্রাম।

বাংলাদেশের পর্যটন আকর্ষণের অপার সম্ভাবনা হতে পারে আমাদের গ্রামগুলো। কারণ একটি গ্রাম থেকে আরেকটি গ্রাম আলাদা। কোন কোন গ্রাম নদী কেন্দ্রীক, কোনটা বা পাহাড় কেন্দ্রীক, কিছু আছে হাওর ও বিল কেন্দ্রীক। একটি গ্রাম থেকে আরেকটি গ্রামের মানুষের আচার-ব্যবহার, সংস্কৃতি, শিক্ষাদীক্ষা, প্রথা, নীতি, জীবনযাত্রা, বিবাহ-অনুষ্ঠান আলাদা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং বৈচিত্রময় জীবনাচার যে কোন পর্যটককে বার বার ফিরিয়ে নিয়ে আসবে গ্রামগুলো ভ্রমণ করতে।

বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮-এর একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিশ্রুতি হচ্ছে ‘গ্রাম হবে শহর’। গ্রামকে শহরে রূপান্তর করার মানে এই নয় যে কৃষি জমি নষ্ট করে গাছ কেটে উজার করে ইট পাথরের জঞ্জাল তৈরী করা। ‘গ্রাম হবে শহর’ বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে গ্রামীণ জনগণের জন্য উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, সুপেয় পানি, কর্মসংস্থান, বিনোদন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিসহ সহজ যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। আর এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের অন্যতম বলিষ্ঠ হাতিয়ার হতে পারে পর্যটন গ্রাম।

প্রথমে আমাদের বুঝতে হবে পর্যটন গ্রাম কি?
কোন গ্রামকে পর্যটনের উদ্দেশ্যে পর্যটন অনুগন্তব্য (Micro-destination) হিসেবে রূপান্তর (Transformation) করলেই তাকে পর্যটন গ্রাম বলা যায়। অর্থাৎ গ্রামটিকে গতানুগতিকতার বাইরে একটু ভিন্ন ভাবে সাজাতে হবে যাতে পর্যটক এসে তার প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা পায় সেই সাথে সেখানকার জীবনধারা উপোভোগ করতে পারে। তবে এই রূপান্তর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের সাথে খাপ-খাইয়ে এখানকার অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে, যাতে এদের সাবলীল যাপিত জীবনে ছন্দ পতন না ঘটে।

পর্যটন গ্রামের প্রয়োজনীয়তা:
আধুনিক পর্যটনের উদ্দেশ্য হলো পর্যটনকে সাশ্রয়ী ও জীবনমুখী করা। পর্যটনের উপাদানসমূহের উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে জীবনের উৎকর্ষ সাধন করে মানুষের বিশ্রাম, বিনোদন ও শিক্ষার জায়গাকে নিশ্চিত করা সম্ভব। এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হলে আমাদেরকে কৃত্রিম পর্যটন সেবা থেকে সরিয়ে এনে প্রাকৃতিক পর্যটন সেবার দিকে ধাবিত করতে হবে। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে পর্যটন ১০৯টি শিল্পকে সরাসরি প্রভাবিত করে, চালিত করে ও প্রসারিত করে। একজন পর্যটকের আগমনে সেবাখাতে প্রত্যক্ষভাবে ১১ জন ও পরোক্ষভাবে আরো ৩৩ জন মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। পর্যটন গ্রাম প্রতিষ্ঠার ফলে পর্যটনের উলম্ব উন্নয়নের (Vertical Development) পরিবর্তে অনুভূমিক উন্নয়নকে (Horizontal Development) ত্বরান্বিত করবে, যা আমাদের মতো জনবহুল দেশে টেকসই উন্নয়নে নিশ্চিত করতে পারবে সেই সাথে অনুভূমিক পর্যটন কাঠামো অধিক সংখ্যক কর্মীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।

পর্যটন গ্রামের প্রয়োজনীয়তা পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এখন অনুভূত হচ্ছে এবং করোনা প্রভাবের জন্য অদূর ভবিষ্যতে আরো তীব্রতরভাবে অনুভূত হবে। প্রত্যেকেই নিজেদের সম্পদ ও সংস্কৃতির উপর নির্ভর করে নানা আঙ্গিকে পর্যটন গ্রাম গড়ে তুলছে। পর্যটন গ্রাম গড়ে তোলার মাধ্যমে বাংলাদেশ যে সুবিধাগুলো পাবে-

ক. পর্যটন সেবাপণ্য উৎপাদন ও মানসম্মত সাংস্কৃতিক পণ্যায়ন গ্রামের জিডিপিতে উৎকর্ষী অবদান রাখবে।

খ. কৃষকদেরকে সংগঠিত করে গ্রামে জৈবকৃষির সূচনা হবে, যা খাদ্যের মানোন্নয়ন ও গণস্বাস্থ্যের নতুন ভিত্তি রচনা করবে।

গ. পর্যটন গ্রামে বাহ্যিক বিনিয়োগ এবং ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে অর্থ প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে।

ঘ. মানুষ ক্ষুদ্র বিনিয়োগ ও হস্ত শিল্প পণ্য ও সেবা শিল্প উৎপাদনে অধিক আগ্রহী হবে।

ঙ. স্বল্পশিক্ষিত মানুষকে প্রায়োগিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উৎপাদনশীল মানুষে পরিণত করা যাবে।

চ. প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সকলের দারিদ্র্য বিমোচন হবে।

ছ. মানুষের মধ্যে শহরমুখী প্রবণতা হ্রাস পাবে।

জ. গ্রামে প্রচুর পরিমাণে পরোক্ষ ও আবেশিত কর্মসৃষ্টি হবে, যা মানবিক গ্রাম সৃজনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখবে।

ঝ. পর্যটন গ্রাম হবে পরিচ্ছন্ন ও অধিকতর স্বাস্থ্যসম্মত, যা বসবাসের জন্য অধিক উপযোগী।

ঞ. মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও শিষ্টাচার বৃদ্ধি পাবে, যা সামাজিক স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে।

ট. গ্রামে আস্থা, ভালবাসা, সহযোগিতা, ত্যাগ সৌহার্দ্য ইত্যাদি জাতীয় সামাজিক পুঁজির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।

ঠ. পর্যটন গ্রামগুলি শান্তির গ্রামে (Peace Village) পরিণত হবে।

কী ধরণের পর্যটন পরিচালনা করা যায় পর্যটন গ্রামে?
পর্যটন গ্রামে অন্ততপক্ষে নিচের দশ ধরণের পর্যটন কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব-

ক. কৃষি পর্যটন (Argo Tourism): এই ধরণের পর্যটনে কৃষকরা তাদের ফার্মে অবকাশ যাপনের আয়োজন করবেন যেখানে পর্যটকরা কৃষি উৎপাদন, সংগ্রহ, সংরক্ষণ ইত্যাদিসহ ও কৃষিভিত্তিক বহুমাত্রিক জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পাবেন। অভিজ্ঞতা সঞ্চয়য়ের উদ্দেশ্যে পর্যটকরা কৃষি কার্যক্রমে অংশগ্রহণও করতে পারবেন। পাশ্চাত্যে এ ধরণের পর্যটন অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিশেষ করে মা-বাবারা তাদের সন্তানকে জীবনমুখী শিক্ষা দিতে এ ধরণের পর্যটন করে থাকেন।

খ. খাদ্য পর্যটন (Food Safari): ফুড সাফারি সারা বিশ্বে অত্যন্ত জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষন। পর্যটকরা কোন স্থানে ভ্রমণে গেলে সেই এলাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার চেখে দেখতে চায়। খাবার সেই এলাকার সাংস্কৃতির একটি অঙ্গ। খাদ্য উৎপাদন ও রন্ধনশৈলী একেকটি এলাকার ঐহিত্য। এমনকি খাদ্য উৎপাদনের উপাদানেও থাকে ভিন্নতা। পর্যটকরা গ্রাম ভ্রমণকালে বিশেষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য উক্ত গ্রামের স্থানীয় খাবারের স্বাদ গ্রহণ করার সুযোগ পাবেন।

গ. আয়ুর্বেদিক পর্যটন (Ayurveda tourism): বর্তমানে মানুষ কৃত্রিম চিকিৎসা পদ্ধতির পরিবর্তে সনাতন প্রাকৃতিক চিকিৎসায় আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। আয়ুর্বেদ পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রাকৃতিক চিকিৎসা, যা এই ভারত উপমহাদেশে সৃষ্টি। ভারত (বিশেষ করে কেরালা) শ্রীলঙ্কাসহ আমাদের প্রতিবেশী অনেক দেশেই আয়ুর্বেদিক পর্যটন অত্যন্ত জনপ্রিয়। এই পদ্ধতি শুধু মাত্র আক্রান্ত অংশেই নয় বরং সামগ্রিক ভাবে একজন মানুষের চিকিৎসা করে থাকে। উদ্ভিদ, প্রাণী ও খনিজ উপাদান থেকে হিতকর এই চিকিৎসা পদ্ধতি পর্যটন গ্রামে সূচনা করতে পারলে পর্যটকদেরকে তা সহজেই আকৃষ্ট করবে। অনেক মানুষ এই চিকিৎসা গ্রহণের জন্য পর্যটন গ্রামে যাবেন।

ঘ. জলাভূমি পর্যটন (Wetland tourism): নদীমাতৃক দেশ আমাদের বাংলাদেশ। সরকারী হিসাবে গ্রীষ্মকালে পানি থাকে এমন নদীর সংখ্যা প্রায় ৩২০ টি। শাখাপ্রশাখাসহ প্রায় ৮০০ নদনদী বিপুল জলরাশি নিয়ে প্রায় ২৪,১৪০ কিঃমিঃ জায়গা দখল করে শিরা-উপশিরার মত দেশের শরীরে বয়ে চলেছে। এছাড়াও আছে অন্যান্য জলাভূমি। ২০১৫ সালে মিথিলা চক্রবর্তীর গবেষণায় দেখা যায়, দেশে প্রায় ৩৭৩টি জলাভূমি রয়েছে, যার মোট আয়তন প্রায় ৭৫-৭৮ লাখ হেক্টর। জলজ পর্যটনের জন্য এর চাইতে উপযুক্ত ক্ষেত্র আর কি হতে পারে। দীঘি, বিল, ঝিল, নদী ইত্যাদি যে গ্রামে আছে সেখানে জলাভূমি পর্যটনের জন্য পর্যটকরা অবশ্যই যাবেন। এই ধরণের পর্যটনে জলক্রীড়া, নৌভ্রমণ, নৌযানে রাত্রিযাপন ইত্যাদি নানা ধরণের কর্মকান্ড গ্রামীণ পর্যটনে বিশেষ মাত্রা যোগ করতে পারে। বাংলাদেশের অন্যতম গ্রামীণ ঐতিহ্য নৌকা বাইচকে বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং করা গেলে অনায়াসে বিদেশী পর্যটক আকর্ষিত হবে।

ঙ. সাংস্কৃতিক পর্যটন (Cultural Tourism): সংস্কৃতি হচ্ছে একটি জাতির সামাজিক গোষ্ঠীর চিন্তা, কর্ম এবং আচরণ ও বিশ্বাসের প্রকাশ। সংগীতসহ বাংলা লোকসংস্কৃতির মাধ্যমগুলোতে আত্মিক বিকাশ এবং দর্শনের যে জায়গা রয়েছে, তাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য দেশে সাংস্কৃতিক পর্যটন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সাংস্কৃতিক পর্যটনের ফলে পারস্পরিক বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হবে। লোক সঙ্গীত, লোক নৃত্যসহ নানা ধরণের লোকজ আচার ও উৎসবের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হতে পর্যটন গ্রামগুলি। গ্রামীণ মেলা, গ্রামীণ উৎসব, আঞ্চলিক গান যেমন কুষ্টিয়ার লালন সঙ্গীত, ময়মনসিংহের ঘাটু গান, রংপুরের ভাওয়াইয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গম্ভীরা সংগত কারণেই পর্যটকদেরকে ঐ অঞ্চলের গ্রামগুলিতে আকৃষ্ট করবে।

চ. ঐতিহ্য পর্যটন (Heritage tourism): সারাদেশে ছড়িয়ে আছে বহু প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা এসব ঐতিহ্য স্থাপনাগুলোকে সংরক্ষণ ও সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে ঐতিহ্য পর্যটনকে করতে পারে সমৃদ্ধ ও সম্ভাবনাময়। প্রত্নতত্ব সম্পদ আছে এমন গ্রামে প্রত্নতত্ব পর্যটন পরিচালনা করা সম্ভব।

ছ. মুক্তিযুদ্ধ পর্যটন (Liberation War Tourism): মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের এমন এক ঘটনা যা বাঙালীকে জাতী হিসাবে নতুন ভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। মুক্তিযুদ্ধ শুধুমাত্র ঐতিহাসিক কোন ঘটনা নয় এটি বাঙালী জাতীর গর্ব। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন, বধ্যভূমি ইত্যাদি যে সকল গ্রামে রয়েছে সেগুলোকে সংরক্ষণ করে পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলা গেলে নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যটনের মাধ্যমে নতুন আঙ্গিকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা যায়। এছাড়া বিদেশী পর্যটক, গবেষক ও শিক্ষার্থিদের জন্য একটি নতুন দ্বার উন্মুক্ত হয়।

জ. গোষ্ঠীভিত্তিক পর্যটন (Community Tourism): গোষ্ঠিভিত্তিক পর্যটনের আধুনিক রূপই হলো গ্রাম পর্যটন। এ ধরণের পর্যটনে একটি এলাকার বাসিন্দারা এক হয়ে তাদের মধ্য থেকে লোকেরা তাদের এলাকায় আসা পর্যটকদের নানা সেবা দিয়ে থাকে। কমিউনিটি ভিত্তিক পর্যটন এর মাধ্যমে স্থানীয় বাসিন্দাদের বিশেষ করে গ্রামীণ, দরিদ্র ও অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক লোকেরা একীভূত হয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে পর্যটকদের আমন্ত্রণ জানান এবং পর্যটকদের খাদ্য, বাসস্থান অন্যান্য সুবিধা বিনিময়ের মাধ্যমে নিজেদের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করেন। সারা বিশ্ব দিন দিন গোষ্টি ভিত্তিক পর্যটনের আবেদন বেড়েই চলেছে।

ঝ. দারিদ্র্যবান্ধব পর্যটন (Poverty friendly tourism): যে পর্যটন থেকে দরিদ্র মানুষেরা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়, তাকে দারিদ্র্যবান্ধব পর্যটন বলে। বাংলাদেশের অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে ভারী শিল্প কারখানা তৈরি করা সম্ভব নয়, আবার হাওর অঞ্চলের অনেক স্থান বছরের বেশীর ভাগ থাকে পানির নীচে। ওই সকল স্থানের প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠির ভাগ্যন্নয়নের অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে এই পর্যটন। পর্যটন গ্রামে দরিদ্র মানুষদেরকে সরবরাহকারী (Supplier) হিসেবে তৈরি করে তাদেরকে পর্যটনপণ্য উৎপাদন ও বিপননে প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত করা যায়। কর্মসৃজন ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য এই পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকর।

ঞ. জীবনযাত্রা পর্যটন (Life Style Tourism): পর্যটন গ্রামের মানুষেরা কীভাবে জীবনযাত্রা নির্বাহ করেন অর্থাৎ ব্যক্তিগত, পারিবারিক, কৃষি ও বাণিজ্যিক জীবনযাত্রা নির্বাহে তাদের দৃশ্যমান চিত্র কী রূপ তা দেখার জন্য উৎসুক পর্যটকরা যাবেন।

পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের মত এমন জনবহুল কৃষি নির্ভর দেশে শুধু শিল্পায়নের মাধ্যমে আর্থ সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দারিদ্র্য দূরীকরণ, ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য গ্রামীণ পর্যটন উন্নয়ন একান্ত প্রয়োজন। পৃথিবীর অনেক দেশ যেমন : থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মালদ্বীপ, নেপাল, মালয়েশিয়া, কলম্বিয়া, কিউবা, সাইপ্রাস, মরিশাস, সেন্ট নেভিস অ্যান্ড কীটসসহ অন্যান্য ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে পর্যটন যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য বিমোচনে অনন্য ভূমিকা রাখতে পারে তা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত। অথচ বাংলাদেশে পর্যটন এখনো একটি উপেক্ষিত একটি ক্ষেত্র। গ্রামীণ জনপদের জীবনযাত্রার মান বাড়াতে হলে পরিবেশের ক্ষতি না করে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে আর তা শুধু মাত্র পর্যটন গ্রাম গড়ে তোলার মাধ্যমেই সম্ভব।

লেখকঃ মাসুদুল হাসান জায়েদী
ভাইস প্রেসিডেন্টঃ বাংলাদেশ ট্যুরিজম এক্সপ্লোরার’স এ্যাসোসিয়েশন
ছবিঃ অপরূপ দে

Leave a Reply