জ্যোৎস্না ছড়ানো চাঁদের গল্পে রোকসানা

Share on Facebook

পর্যটন বিষয়ক অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘পর্যটনিয়া’ পর্যটন শিল্পের নানা সমস্যা ও সম্ভাবনা তুলে ধরে আসছে নিয়মিত। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যটন বিষয়ে অধ্যয়নরত অনেক ছাত্র-ছাত্রী যথাযথ তথ্যের অভাবে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে শঙ্কিত। সুতরাং সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে পর্যটনের সাবেক ছাত্র-ছাত্রীদের ‘ক্যারিয়ার স্টোরি’ প্রকাশ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে পর্যটনিয়া। পর্যটনের বিভিন্ন খাত-উপখাত নিয়ে পড়ালেখা করে তাঁদের আজকের অবস্থান একজন ছাত্রকে হয়তো তার নিজস্ব ক্যারিয়ার গড়তে স্বপ্ন দেখাবে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সাহসী করে তুলবে। পর্যটনের সাবেক ছাত্রদের ‘ক্যারিয়ার স্টোরি’ হোক শঙ্কিত ছাত্রদের দিকনির্দেশনা আর সাহসী ছাত্রদের প্রেরণা। আমাদের এই পর্বের আয়োজন রোকসানা কবিরকে নিয়ে। তিনি বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ন্যাশনাল হোটেল এন্ড ট্যুরিজম ট্রেনিং ইন্সটিটিউট থেকে ফুড এন্ড বেভারেজ বিষয়ে কোর্স করে হয়েছেন একজন উদ্যোক্তা। ‘ড্রিম ফুড স্টেশন’ এর প্রধান কর্ণধার তিনি।

রোকসানা কবিরের জন্ম লক্ষ্মীপুর জেলায় হলেও সেনা কর্মকর্তা বাবার চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কেটেছে শৈশব-কৈশোর। সরকারি চাকরিজীবী বাবা ও গৃহিণী মায়ের তিন সন্তানের মধ্যে রোকসানা কবির দ্বিতীয়।

রোকসানা কবির

ছোটবেলা থেকেই রোকসানা কবির যেন আর দশটা সাধারণ বাচ্চাদের চেয়ে একটু ব্যাতিক্রম। সাধারণ বাচ্চারা যেখানে নিয়মিত পড়ালেখা আর খেলাধুলার বাইরে বড়জোর ভোজনবিলাসী হয়ে ওঠে সেখানে রোকসানা এগুলোর বাইরেও জানার চেষ্টা করেন খাবারগুলো তৈরি করা হয় কিভাবে! কৌতুহলী হয়ে ওঠেন বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন খাবারের নাম ও স্বাদ নিয়ে। খাবারের নাম ও স্বাদের প্রতি বিশেষ ঝোক থেকেই পড়াশোনা আর খেলাধুলার ফাঁকেই তিনি মায়ের সাথে রন্ধন প্রনালী শিখতে সময় কাটিয়েছেন দিনের পর দিন। তখনকার দিনে আজকের মতো গুগল, ফেসবুক কিম্বা ইউটিউব চ্যানেল সহজলভ্য ছিল না। ফলে তিনি নানা রকম খাবার তৈরির রেসিপি পত্রিকা থেকে কেটে সংরক্ষণ করতেন। কখনো কখনো বিশেষ দিনে বা বাড়িতে কোনো আত্মীয়-স্বজন বেড়াতে এলে নতুন কোনো পদের রান্না তৈরি করে সবাইকে চমকে দিতেন কিশোরী রোকসানা।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন স্কুলে পড়াশুনা করে রাজেন্দ্রপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন রোকসানা। মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইন্স্টিটিউট থেকে এইচএসসি পাশ করে সরকারি তিতুমির কলেজে ভর্তি হন স্নাতক শ্রেণীতে। লালমাটিয়া মহিলা কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর পাশ করার আগে বাংলাদেশ নৌবাহী পরিবার কল্যাণ সংঘ থেকে হস্তশিল্পের উপর ৬ মাসের প্রশিক্ষণ নেন। স্নাতকোত্তর পাশ করে বাংলালিংক কল সেন্টারে কিছুদিন কাজ করে শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব মহিলা টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার থেকে আবার ৬ মাস মেয়াদী সেলাই প্রশিক্ষন নেন।

রোকসানা কবির

এত পড়ালেখা, রকমারি প্রশিক্ষণ আর পড়াশোনা শেষে করপোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি কোনো কিছুতেই যেন তৃপ্ত হতে পারছেন না রোকসানা। তিনি যত পড়ালেখাই করেন যত প্রশিক্ষণই নেন তার মন ফিরে যেতে চায় রান্নাঘরে। রন্ধন শিল্পের প্রতি তার আকর্ষণের তীব্রতা যেন উপেনের সেই দুই বিঘা জমির প্রতি আকর্ষণের তীব্রতার সমান।
‘সন্ন্যাসীবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য কত হেরিলাম মনোহর ধাম, কত মনোরম দৃশ্য!
ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি
তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারি নে সেই দুই বিঘা জমি।’
অবশেষে তিনি সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে এসে ইউসেফ বাংলাদেশ থেকে বেকিং কোর্সের NTVQF level -2 এবং কুকিং কোর্সের Level -1 সম্পন করেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষা আশ্রয় করে বলা যায়, কুমোরের বাড়ি দক্ষিণে ছাড়ি, রথ-তলা করি বামে// রাখি’ হাটখোলা, নন্দীর গোলা, মন্দির করি পাছে/ তৃষাতুর শেষে পঁহুছিলেন এসে তৃপ্তির কাছাকাছি।

রোকসানা কবির

রন্ধনগ্রস্থ রোকসানা এসব কোর্স চলাকালিন সময়েই Dream food Station নামে একটি পেইজ চালু করে শুরুতেই ভালো সাড়া পান। এরপরই তিনি একজন উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। রান্না বিষয়ক উচ্চতর জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে নিজেকে আরও সমৃদ্ধ করতে তিনি বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন থেকে Food & Beverage Production এবং Food Hyghine and Sanitation বিষয়গুলো নিয়ে কোর্স করেন। কোর্স শেষে দেশের পাঁচ তারকা হোটেলগুলোর অন্যতম ‘আমারই ঢাকা’ থেকে ইন্টার্ন করার সুযোগ পেয়ে নিজেকে করেন অধিক সমৃদ্ধ। ইন্টার্নিশিপ পিরিয়ড শেষে একটি চার তারকা মানের হোটেলে প্রায় বছরখানেক চাকরি করে তিনি পুনরায় ফিরে আসেন তার প্রতিষ্ঠিত ড্রিম ফুড স্টেশনে তথা উদ্যোক্তা জীবনে।

বর্তমানে Dream Food station পরিচালনা করার পাশাপাশি রোকসানা রান্না বিষয়ক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছেন নিয়মিত। বিটিইএ (বাংলাদেশ ট্যুরিজম এক্সপ্লোরার এসোসিয়েশন) এর উইমেন্স স্ট্যান্ডিং কমিটির কো-চেয়ারম্যানের দ্বায়িত্ব পালন করে নিজের সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন। খাবারের গুনগত মান ও স্বাদের সমন্বয় করে তিনি ব্যবসায়িক সুনাম বাড়িয়েই চলেছেন অবিরত। রোকসানা স্বপ্ন দেখেন ড্রিম ফুড ষ্টেশন ভালো ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার পর বিভিন্ন এলাকার আঞ্চলিক ও ঐতিহ্য বহনকারী তৈজসপত্র, শাড়ী-লুঙ্গী, নকশিকাঁথা ও মৃৎশিল্প নিয়েও কাজ করবেন।

রোকসানা কবির

স্বাধীন পেশাজীবি ও পর্যটনের গুরুত্বপূর্ণ খাতের একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে রোকসানার আজকের যে অবস্থান তা অন্য অনেক নারীদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। পরিবারের সাহস ও সহযোগিতা পেয়ে তিনি যতটা সহজে এতটা পথ পাড়ি দিতে পেরেছেন, হতে পেরেছেন একজন উদ্যোক্তা সেই পারিবারিক সাহস ও সহযোগিতা হয়তো অন্য অনেক নারীর পক্ষেই সম্ভব হবে নয়।
আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে দু’একজন ব্যাতিক্রম বাদে যেকোনো নারীর পক্ষেই উদ্দ্যোক্তা হয়ে ওঠার রাস্তাটা বাধাবিঘ্নতায় ভরপুর। কারণ একজন পুরুষকে তার কাজের ব্যপারে যতটা বাহবা দেয়া হয় একজন নারীকে ঠিক ততটাই নিরুৎসাহিত করা হয় যা সত্যি দুঃখজনক। রোকসানা বলেন, প্রয়োজনের সাথে সাথে নিজেকে পরিবর্তন করতে পারাটা শিখতে হবে। একজন নারী উদ্যোক্তা যদি পরিশ্রমী, উদ্যমী, ন্যায়পরায়ণ, নিষ্ঠাবান ও কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারে তাহলে কোনো বাধাই তাকে আটকাতে পারবে না। রোকসানা কবির নিজের সফলতার গল্পগুলো ছড়িয়ে দিয়ে নারীদেরকে সাহসী ও সংগ্রামী করে গড়ে তুলতে চান। রোকসানার সাফল্যের গল্প অনুপ্রেরণা হয়ে ছড়িয়ে পড়ুক পর্যটনিয়া পরিবার সেই কামনা করে।

Leave a Reply