এম এল পেলিকেনে সুন্দরবনে প্যাকেজ ট্যুর

Share on Facebook

পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনের নাম সুন্দরবন। ১৯৯৭সালে ইউনেস্কো  সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে। সুন্দরবন বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রশস্ত বনভূমি যা শুধু বাংলাদেশেরই নয় বিশ্বের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যগুলোর মধ্যেও অন্যতম। ১০,০০০বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা এই সুন্দরবনের ৬,০১৭বর্গ কিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে আর বাকি অংশ রয়েছে ভারতের সীমানার মধ্যে। সুন্দরবনের বাংলাদেশ থেকে যেসব প্রতিষ্ঠান সুন্দরবনে প্যাকেজ ট্যুর পরিচালনা করে সেগুলোর মধ্যে রয়্যাল ভিশন ট্যুরিজম অন্যতম। সুন্দরবনের প্যাকেজ ট্যুর বিষয়ে খুলনা ভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানের সিইও শাহেদ মোহাম্মদ ইমরানের সাথে বিস্তারিত কথা বলে পর্যটনিয়া।

 

শাহেদ মোহাম্মদ ইমরান

পর্যটনিয়াঃ কেমন আছেন।

ইমরানঃ আলহামদুলিল্লাহ্‌। আপনি কেমন আছেন।

পর্যটনিয়াঃ পর্যটন ব্যবসায় আপনার জড়িত হওয়ার গল্পটা বলেন।

ইমরানঃ পর্যটন ব্যবসায় জড়িত হওয়ার আগে আমি ছাত্র জীবনেই সুন্দরবনের বিভিন্ন ট্যুরে নিয়মিত গাইডিং করেছি দীর্ঘ সাত বছর। গাইড হিসেবে দীর্ঘ এই চাকরি জীবনে আমি অসংখ্যবার সুন্দরবনে গিয়েছি। সুন্দরবনের আনাচেকানাচে ঘুরেছি। এভাবে প্রতি মৌসুমে সুন্দরবনের বিভিন্ন স্পটে ঘুরতে ঘুরতে কখন যে বনের মায়ার বাঁধনে আটকে গেছি সেটা আসলে নিজেই জানি না। পড়ালেখা শেষে যখন অন্য কোনো চাকরীর জন্য চেষ্টা করবো ভাবছি, তখনই বুঝতে পারলাম সুন্দরবন কী মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছে আমাকে। আমি খুলনার ছেলে। ঢাকায় যেতে হবে চাকরীর পরীক্ষা দিতে। ভাবলাম, চাকরি যদি একবার হয়েই যায় তাহলে হয়তো সারাজীবন কাটাতে হবে ঢাকাতেই। আমি হয়তো আর কোনোদিন সুন্দরবনে যেতে পারবো না, হয়তো কোনোদিন দেখা হবে না শিপের ডেকে বসে সুর্যাস্তের মোহনীয় দৃশ্য। হয়তো আর কোনোদিনই এভাবে দেখা হবে না হরিণের দলের ছোটাছুটি; ভাবতেই সুন্দরবনের জন্য হাহাকার করে উঠলো বুক। সাথে সাথেই সিদ্ধান্ত নিলাম আমি সুন্দরবন ছেড়ে কোথাও যাবো না।

 

পর্যটনিয়াঃ সুন্দরবনের বিশেষ কোন গন্তব্যটা আপনাকে এভাবে মায়ার বাঁধনে আটকে দিলো?

ইমরানঃ দেখুন সুন্দরবন তো বিরাট একটা ব্যাপার। কতো নদী, কতো বন, কতো পশুপাখি! এসবেরই সমষ্টি সুন্দরবন। সত্যি কথা বলতে, সুন্দরবনকে আলাদা একটা রাজ্যই মনে হয় আমার কাছে। যখন সুন্দরবনে ঢুকি তখন আমার মনে হয় আমি বুঝি স্বপ্নের ঘোরে আলাদা একটা রাজ্যেই ঢুকে গেলাম।

 

সুন্দরবনের হরিণ

পর্যটনিয়াঃ তবুও সেই রাজ্যের কোন শহর বা গ্রাম আপনাকে আকর্ষন করে সবচেয়ে বেশি? বা কোন কোন গ্রাম বা শহরগুলি………

ইমরানঃ যদিও সুন্দরবনের সৌন্দর্য আলাদাভাবে বলা আমার জন্য কঠিন তারপরেও বলি, যখন সূর্যাস্তের আগে আগে কটকা পয়েন্টে পৌঁছি তখন সুন্দরবনের আলাদা একটা সৌন্দর্য আমি বুঝতি পারি। সুন্দরবনের গাঢ়তর একটা সৌন্দর্য আছে যেটা অন্য বনের নাই। এখানে গভীর রাতে কান পেতে থাকলে বাঘের গর্জন শোনা যায়। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলে নামজানা কত পাখির কিচিরমিচির শোনা যায়। বিকেলবেলা হরিণের দল ছুটে বেড়ায়, দেখতে কী যে ভালো লাগে সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। আমার সামনে একশো বা দেড়শো হরিণের একটা দল ছুটে বেড়াচ্ছে, শুধু এরকম একটা সুন্দর দৃশ্য দেখার লোভেই আমি কতবার বনে গেছি তার হিসেব নাই। করমজল, হাড়বাড়িয়া, কটকা, জামতলা, টাইগার পয়েন্ট, বাদামতলা সমুদ্র সৈকত, কচিখালী, দুবলা শুটকি পল্লী, দোবেকী, কলাগাছিয়া, মান্দারবাড়িয়া ও হিরণ পয়েন্ট বা নীলকমল আমার সবই ভালো লাগে।

 

হিরণ পয়েন্ট ক্যানেল

পর্যটনিয়াঃ হিরণ পয়েন্ট নিয়ে কিছু বলুন।

ইমরানঃ একটা সময় যখন সুন্দরবনের ভিতরে যাওয়ার জন্য আজকের মতো এতো সুযোগ সুবিধা ছিল না। এতো শিপ ছিল না, ট্রলার ছিল না তখন বনের ভিতরে পর্যটক যেতও কম। ঐসময় বড় বড় কিছু লঞ্চ ছিলো যেগুলো মাঝে মাঝেই হিরণ পয়েন্ট পর্যন্ত যেতো। তখন হিরণ পয়েন্টই ছিল একটা জনপ্রিয় গন্তব্য। এখন আমরা তো ট্যুরিস্ট শিপ চালাই, এগুলো তখনকার লঞ্চগুলোর চেয়ে ছোট কিন্তু ফ্যাসিলিটিজ অনেক বেশি। সমুদ্র উত্তাল থাকলে এই তুলনামূলক ছোট শিপগুলো নিয়ে হিরণ পয়েন্ট যাওয়া কিছুটা ঝুকিপূর্ণ। তবে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত হিরণ পয়েন্টে ঝুঁকি ছাড়াই যাওয়া যায়। তখন সমুদ্র শান্ত থাকে।

 

পর্যটনিয়াঃ তাহলে হিরণ পয়েন্টের বিকল্প স্পট হিসেবে আপনারা কোন পয়েন্টকে বেছে নিয়েছেন?

এমরানঃ সত্যি কথা বলতে সুন্দরবনের কোনো স্পটের বিকল্প কোনো স্পট হতে পারবে না। প্রত্যেকটা স্পটের আছে আলাদা আলাদা সৌন্দর্য। তবে হিরণ পয়েন্টের কিছুটা মিল আছে কচিখালি পয়েন্টের সাথে। এখানে ক্যানেল সাইট সিয়িং বলেন জঙ্গল ওয়াক বলেন সবই হিরণ পয়েন্টের মতোই। প্যাকেজ শিডিউলে আমরা সাধারণত কটকা পয়েন্টের সাথে কচিখালি পয়েন্ট যোগ করি হিরণ পয়েন্টের বদলে। এতেই ভ্রমণ বেশি উপভোগ্য হয়। কচিখালি পয়েন্ট থেকে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে কটকার বাদামতলা সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত হেটে যাওয়া যায়। এই ট্রেকিংটা এক কথায় অসাধারণ।

 

সুন্দরবনের বাঘ

 পর্যটনিয়াঃ হাড়বাড়িয়া ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্রে বাঘের আনাগোনা কি আজকাল একটু বেশি?

ইমরানঃ হাড়বাড়িয়া ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্রে বাঘের আনাগোনা আজকাল বেশি একথা সর্বোতভাবে সত্য নয়। বাঘের আনাগোনা আগেও ছিল এখনো আছে। আপনি দেখবেন, ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্রে একটা মিঠাপানির পুকুর আছে। এখানে বন্য প্রাণীরা এসে পানি খেয়ে যায়। যেখানে মিঠাপানির পুকুর অনেক দিন থেকেই আছে সেখানে বাঘের আনাগোনা শুধু এখন না অনেক আগে থেকেই আছে। তবে যেহেতু আজকাল তথ্য পাওয়া কিছুটা সহজ প্রকাশ করাও সহজ তাই হয়তো অনেকেই ব্যাপারটা ইদানিং জানতে পারছে, কিন্তু বাঘের আনাগোনা আসলে অনেক আগে থেকেই আছে।

 

হাড়বাড়িয়া মিঠাপানির পুকুর

পর্যটনিয়াঃ আপনাদের সুন্দরবন প্যাকেজে কি হাড়বাড়িয়া সাইট সিয়িং অন্তর্ভুক্ত থাকে? প্যাকেজ কতদিনের?  

ইমরানঃ জ্বি, আমাদের প্যাকেজে হাড়বাড়িয়া অন্তর্ভুক্ত থাকে। আমরা সাধারণত তিনদিনের প্যাকেজ করি। খুলনা থেকে শুরু খুলনায় এসে শেষ। প্রথম দিন সকালে চার নাম্বার ঘাট থেকে আমার ট্যুরিস্ট শিপ ছেড়ে চলে যায়। এরপর ঢ্যাইংমারি ফরেস্ট স্টেশন থেকে ফরেস্ট গার্ড নিয়ে চলে যাই করমজল স্পটে; এখানে একটা কুমির প্রজনন কেন্দ্র আছে। একটা কুমির পুকুর আছে। এই পুকুরে অনেক বড় বড় কুমির আছে। একাধিক ওয়াচ টাওয়ার আছে। ওয়াচ টাওয়ারে উঠে বনের অনেক গভীর পর্যন্ত দেখা যায়। তারপর জঙ্গলের মধ্যে হাটার জন্য কাঠের রাস্তা আছে। এই রাস্তা দিয়ে বনের প্রায় কিলোমিটার খানেক গভীরে গিয়ে বেড়িয়ে আসা যায়। তারপর শিপ ছেড়ে দেই কটকা বা কচিখালির উদ্দেশ্যে।

দ্বিতীয় দিন শুরু হয় অনেক ভোরে কটকা বা কচিখালির ক্যানেল সাইট সিয়িং দিয়ে। তারপর আছে জঙ্গল ট্রেকিং। কটকার জেটি থেকে বাদামতলা সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত যেতে বনের মধ্যে হাটতে হয় প্রায় ঘন্টাখানে। সৈকতে গোসল করা ফুটবল খেলা ইত্যাদি বিচ একটিভিটিজ করে এসে শিপে কিছুটা বিশ্রাম নেই। তারপর বিকেল বেলা সন্ধ্যার আগে আগে আবার যাই হরিণ দেখতে। দ্বিতীয় রাতে আমরা বারবিকিউ ডিনারের আয়োজন করি। সাথে পর্যটকদের অংশগ্রহণে হালকা কিছু গানবাজনাও হয় মনোরঞ্জনের জন্য। কিছু ইনডোর গেমস থাকে, হয়তো একটা কুইজ প্রতিযোগিতাও থাকে।

তৃতীয় দিন সকালে হাড়বারিয়া ইকো ট্যুরিস্ট স্পটে ঘোরাঘুরি করে দুপরের পর আমাদের শিপ রওনা হয় খুলনার উদ্দেশ্যে। খুলনায় সন্ধ্যায় এসে পৌঁছলে আমাদের ট্যুর শেষ হয়।

 

এম এল পেলিকেন

পর্যটনিয়াঃ আপনার তো একটা ট্যুরিস্ট শিপ আছে। সেই শিপের সামর্থ্য ও সুবিধাদি কী?

ইমরানঃ আমার নিজস্ব মালিকানায় যে শিপ সেটা এম এল পেলিকেন। এখানে টোটাল ১২টা কেবিন আছে। সিংগেল কেবিন ২টা, কাপল কেবিন ৪টা, ৪বেড বাঙ্কারকেবিন ৩টা, ৩বেড বাঙ্কারকেবিন ২টা আর ১টা  ২বেড বাঙ্কারকেবিন মিলিয়ে মোট ৩০ জনের একোমোডেশন ক্যাপাসিটি। একটা ডাইনিং হল ছাড়াও গেস্টদের আরাম আয়েশ করে বসে থাকার জন্য যথেষ্ট ফ্রি স্পেস আছে। গেস্টদের জন্য বাথরুম আছে মোট ৪টা। গেস্টদের জন্য বাথরুম আলাদা আর স্টাফদের জন্য বাথরুম আলাদা। ক্লিনিং পারপাস ছাড়া গেস্ট বাথরুমে কোনো স্টাফ কখনোই প্রবেশ করবে না। গেস্টদের রুচিতে বাধে বা প্রাইভেসি নষ্ট হয় এমন কোনো কিছুই করবে না আমার স্টাফরা।

 

পর্যটনিয়াঃ আপনার প্যাকেজের সাথে তো খাবারদাবার অন্তর্ভুক্ত থাকে তাই না?খাবার মেন্যুতে কী থাকে সাধারণত?   

ইমরানঃ সকালের নাশতায় একেকদিন একেক রকম খাবার থাকে। কোনোদিন থাকে গরম পরোটা, সবজি, ডিমভাজি, চা। কোনোদিন থাকে হয়তো সবজিখিচুড়ি সাথে ডিম ভুনা, চা। কোনোদিন হয়তো থাকলো ব্রেড, জেলি, কলা, সিদ্ধডিম আর চা। চা অবশ্য সারাদিন আনলিমিটেড থাকে।

দুপর আর রাতের খাবারে সামুদ্রিক মাছের সাথে থাকে মুরগি, ডাল, সবজি, সালাদ। একদিন দুপরে থাকে স্পেশাল কাচ্চি বিরিয়ানি। একটা বারবিকিউ ডিনার তো আছেই। এছাড়াও সকাল এগারোটা ও বিকেল পাচটার দিকে নাশতা হিসেবে থাকে কেক, কলা, মুড়িভর্তা, নুডুলস, সিংগারা বা ভাপা পিঠা ইত্যাদি।

 

পর্যটনিয়াঃ আপনাকে ধন্যবাদ।

ইমরানঃ আপনাকেও ধন্যবাদ।

Leave a Reply