কেন ইউ স্টপ রামপাল – জন কেরি

Share on Facebook

সুন্দরবনকে বাঁচাতে বাংলাদেশ সরকারের নানামুখী উদ্যোগ আছে। আবার সুন্দরবনের কাছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও করছে সরকার। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনকে বিপন্ন করে তুলবে—বিশেষজ্ঞরা বারবার বলার পরও সরকার তা বিবেচনায় নেয়নি। সুন্দরবন নিয়ে সরকারের এমন বিপরীতমুখী অবস্থানে ‘বিভ্রান্ত’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূত জন কেরি।

৯ এপ্রিল মাত্র সাড়ে ছয় ঘণ্টার জন্য ঢাকা সফরে এসে সুন্দরবন নিয়ে কোনো রাখঢাক না রেখেই বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জন কেরি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনাতেই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তির বিষয়টি তুলেছেন তিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কেরির আলোচনার সময় উপস্থিত থাকা সরকারের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

অবশ্য রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়টি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় তুললেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনায় এ নিয়ে কিছু বলেননি কেরি। তবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র যে পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম বড় কারণ, এটি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় তিনি বলেছেন। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নেতিবাচক অবস্থানের বিষয়টি বৈঠকে উল্লেখ করেন তিনি।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আয়োজিত ‘লিডার্স সামিট অন ক্লাইমেট’-এর আমন্ত্রণপত্র তুলে দিতে এবার ঢাকা সফর করেন জন কেরি। ২২ ও ২৩ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রে এই সামিট (সম্মেলন) হবে। তবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে সম্মেলন হবে ভার্চ্যুয়ালি।

ঢাকায় নামার ঘণ্টা দেড়েক পর জন কেরি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় প্রথমে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। সেখানে অন্যদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ও পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন। ওই আলোচনায় জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা আলোচনায় তুলে ধরেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। একপর্যায়ে সুন্দরবনের প্রসঙ্গটি ওঠে। তখন জন কেরিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, সুন্দরবনকে বাঁচানোর জন্য সরকার বনায়ন করার পাশাপাশি নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তাঁর এই বক্তব্যের পর জন কেরি বলেন, সুন্দরবন নিয়ে বাংলাদেশের কর্মকাণ্ডে তিনি কনফিউজড (বিভ্রান্ত)! একদিকে বাংলাদেশ সুন্দরবনকে বাঁচানোর উদ্যোগ নিচ্ছে, আবার সেখানে রামপালের মতো প্রকল্পও করছে। এটা কী করে সম্ভব!

আলোচনায় উপস্থিত থাকা একাধিক সূত্র জানায়, সুন্দরবন নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূতের মন্তব্যের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি বাংলাদেশের কর্মকর্তারা। আলোচনার শেষ পর্যায়ে জন কেরি আবারও সুন্দরবন আর রামপালের প্রসঙ্গটি তোলেন। আব্দুল মোমেনকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘কেন আই মেইক আ আউটরেজাস কোয়েশ্চন? (আমি কি একটা ভয়ানক অনুরোধ করতে পারি?)। কেন ইউ স্টপ রামপাল?’ (আপনারা কি রামপালের কাজ বন্ধ করতে পারেন?)।

তখন জন কেরিকে জানানো হয়, পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টিকে বাংলাদেশ সব সময় গুরুত্ব দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। সুন্দরবনকে রক্ষার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ চলছে।

সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ এ মুহূর্তে অনেকটা এগিয়ে গেছে। তাই এ নিয়ে কেউ আপত্তি জানালে এটা নিয়ে সরকারের তেমন কিছু করার নেই।

এর আগে ২০১৭ সালে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ বন্ধের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ জানান যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও পরিবেশবাদী আল গোর। ওই বছরের জুনে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের কর্ম-অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর পাশে বসেই সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর ওই অনুরোধ জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন আল গোরকে বলেছিলেন, বাংলাদেশে এসে সুন্দরবন ঘুরে যান। দেখুন প্রকল্পটি পরিবেশের কোনো ক্ষতি করছে কি না।

১৯৯৭ সালে সুন্দরবনকে জাতিসংঘের শিক্ষাবিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি প্রদান করে। সুন্দরবনের পাশে বাগেরহাটে রামপালে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড যৌথভাবে ভারতের এনটিপিসি লিমিটেডের সঙ্গে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নিয়ে দেশে-বিদেশে পরিবেশবাদীরা প্রশ্ন তুলেছেন।

২০১৮ সাল থেকে ইউনেসকো রামপাল প্রকল্প নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছে। তারা সুন্দরবনের পাশ থেকে রামপাল প্রকল্প সরিয়ে ফেলতে বলেছে। ইউনেসকো ও প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর জোট আইইউসিএন রামপাল প্রকল্প নিয়ে করা সমীক্ষায় বলেছে, এ প্রকল্প হলে সুন্দরবনের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। এ ধরনের ক্ষতি হলে সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান হারাতে পারে বলেও একাধিকবার হুঁশিয়ার করেছে ইউনেসকো।

এ ব্যাপারে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীদের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, রামপাল প্রকল্পে যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে তা নিম্নমানের। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিচ্ছে। সুন্দরবনের ক্ষতি করে এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ দেশের পরিবেশ, অর্থনীতি ও সম্মানের জন্য ক্ষতিকর।

Leave a Reply