অপার সম্ভাবনার স্লো ট্যুরিজম

Share on Facebook

ইংরেজি স্লো (slow) শব্দের বাংলা অর্থ ধীর বা মন্থর আর ট্যুরিজম বাংলায় পর্যটন- এই দু’য়ে মিলে স্লো ট্যুরিজমের অর্থ কিন্তু ‘ধীর বা মন্থর গতির পর্যটন’ নয়। উৎপত্তি আর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় স্লো ট্যুরিজমকে বাংলায় অচঞ্চল পর্যটন বা বিবেচক পর্যটন বলা ভালো।

বিশ্বখ্যাত ফাস্টফুড চেইন ম্যাকডোনাল্ডস ১৯৮০’র দশকে ইতালির রোমে স্প্যানিশ স্টেপস অঞ্চলে একটি শাখা খুলতে গেলে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। কার্লো পেট্রিনির নেতৃত্বে স্থানীয় রেস্তরা কর্মী, মালিক ও খাদ্য উৎপাদকরা ফাস্টফুডের বিরুদ্ধে স্লো ফুড আন্দোলন শুরু করেছিলেন।

‘স্লো ফুড’ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় খাদ্য সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যগুলিকে হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করা, স্বাভাবিক গতির তুলনায় জীবনাচারণের দ্রুত উত্থান ও পরিবর্তনের অস্বাভাবিকতা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি এবং আমরা যে খাবার খাই তা কোথা থেকে আসে, এর উৎপাদন থেকে ভোক্তার হাত পর্যন্ত পৌছতে কিভাবে স্থানীয় অর্থনীতি সচল রাখে এবং চারপাশের প্রকৃতি ও পরিবেশকে প্রভাবিত করে সে সম্পর্কে জনসাধারণের আগ্রহ বৃদ্ধি করা। অর্থাৎ স্লো ফুডের ধারণাটি স্থানীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, রাজনীতি, কৃষি, পরিবেশ, প্রকৃতি ও অর্থনীতিসহ অন্যান্য বহু বিষয়ের ‘টেকসইতার’ সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আন্তঃসম্পর্কিত। স্লো ফুড আন্দোলনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল বাণিজ্যিক বহুজাতিক কর্পোরেট সংস্থাগুলোর ব্যবসায়িক স্বার্থে নিজস্ব মানকরণ (স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন) অনুযায়ী সংস্কৃতি, খাদ্য ও কৃষির প্রতি পরিচালিত আগ্রাসন প্রতিরোধ করা।

কার্লো পেট্রিনি

স্লো ফুড আন্দোলনের অনুপ্রেরণায় গত শতকের নব্বইয়ের দশকে শুরু হয় সিট্টাস্লো (Cittaslow) আন্দোলন। সিট্টস্লো আন্দোলনের লক্ষ্য হল কর্পোরেট আগ্রাসনের প্রতিরোধ করে ছোট শহরগুলি যেন তাদের সংস্কৃতি, আত্ম পরিচয়, ঐতিহ্য, ইতিহাস, খাদ্য, শিল্প, সংগীতসহ প্রচলিত জীবনধারা সংরক্ষণ করে টিকে থাকতে পারে।

স্লো ফুড এবং সিট্টাস্লো আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল বাণিজ্যিক কর্পোরেট সংস্থাগুলির বিশ্বায়নের মুগ্ধ শ্লোগানে যেন স্থানীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, রাজনীতি, কৃষি, পরিবেশ, প্রকৃতি ও অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণসহ সার্বিক আত্মপরিচয় হারিয়ে না যায়। স্লো ফুড আর সিট্টাস্লো আন্দোলনের হাত ধরেই স্লো ট্যুরিজমের বিকাশ।

স্লো ট্যুরিজম বা অচঞ্চল/বিবেচক পর্যটন প্রচলিত ধারার পর্যটন হতে ভিন্ন। মূল ধারার পর্যটনে বিভিন্ন পর্যটন গন্তব্যে দ্রুত ভ্রমণ করা হয়। এই ধারার পর্যটনে পর্যটকের অনন্দ-বিনোদন লাভ করাই মূখ্য, সাধারণ দায়িত্বশীলতা ছাড়া অন্যান্য দায়িত্বশীলতা পালন করার বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু স্লো ট্যুরিজম বা অচঞ্চল/বিবেচক পর্যটনে গন্তব্যগুলোতে দ্রুত পর্যটন নিরুৎসাহিত করে।

স্লো ট্যুরিজম বা অচঞ্চল/বিবেচক পর্যটনে সংখ্যা তথা ভ্রমণের পরিমাণ অপেক্ষা ভ্রমণের গুণগত মানকে প্রধান্য দেয়। সাধারণ উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমাদের দেশের পর্যটকরা ৩ বা ৪ দিনের ভ্রমণে কক্সবাজারে যায় এবং অতি দ্রুত গতিতে সমুদ্র সৈকতের তিন/চারটা স্পট, হিমছড়ি, সেন্ট মার্টিন ঘুরে ফিরে আসে। এই ধরণের ভ্রমণে ক’টা প্রশ্ন মূখ্য- মাত্র তিন/চার দিনে কি এতগুলো স্পট যথাযথভাবে উপভোগ করা সম্ভব? এমন গতিশীল পর্যটনের ফলে স্থানীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, কৃষি, পরিবেশ, প্রকৃতি, শিল্পকলা, সংগীত, বিনোদন সম্পর্কে পর্যটকের কতটা জানা/অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হল? স্থানীয় মানুষের সাথে কতটা সংযোগ সৃষ্টি হল? এমন দ্রুত গতির পর্যটনে স্থানীয় প্রকৃতি, পরিবেশ ও অর্থনীতিতে কতটা প্রভাব রাখবে?- এমন বহু প্রশ্নের উত্তর স্লো ট্যুরিজম বা অচঞ্চল/টেকসই পর্যটন।

প্রচলিত ধারায় স্বল্প সময়ে বহু পরিমাণ পর্যটন গন্তব্যে দ্রুত ভ্রমণের পরিবর্তে স্লো ট্যুরিজম পর্যটনে স্বাভাবিক গতি, গতিসীমার প্রতি গুরুত্ব প্রদান এবং পরিমাণের চেয়ে গুণগত মানকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করে। পর্যটন গন্তব্যে গতি মন্থর করে স্থানীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, রাজনীতি, কৃষি, পরিবেশ, প্রকৃতি, সমাজ, শিল্পকলা, সংগীত, ইতিহাস, ও অর্থনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে জানা, উপভোগ করা, স্থানীয় মানুষের সাথে সংযোগ সৃষ্টি করাকে গুরুত্ব প্রদান করে। ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে আরামদায়ক বিশ্রাম, বিনোদনে অভিনবত্ব ও অভিজ্ঞতা সঞ্চারক, আনন্দময়, উপভোগ্য, বিভিন্ন সংস্কৃতির সাথে সুষম সংযোগ স্থাপন, পরিবেশ বান্ধব আর টেকসই গুণের কারণে স্লো ট্যুরিজম বা অচঞ্চল/বিবেচক পর্যটন ধারা দিনে দিনে জনপ্রিয় হচ্ছে।

কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে সারা বিশ্ব প্রায় দুই বছরের জন্য স্তব্দ হয়ে গিয়েছিল। এই দুই বছরের ঘরবন্দী জীবনে পৃথিবীর প্রতি, প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি মানুষের ভালবাসা, মমতা ও দায়িত্ববোধ বেড়েছে। কোভিডের-১৯ এর থাবাকে প্রতিরোধ করে পৃথিবী আবার সচল হচ্ছে। জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার হিসেব অনুসারে কোভিড-১৯এ সবচে ক্ষতিগ্রস্থ খাতগুলোর অন্যতম পর্যটন শিল্প ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, প্রাক-মহামারী অবস্থার প্রায় ৭০শতাংশ পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়েছে।

কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে বিগত অভিজ্ঞতা আর জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে স্লো ট্যুরিজম বা অচঞ্চল/বিবেচক পর্যটন টেকসই ধারা হিসেবে বিবেচিত ও জনপ্রিয় হচ্ছে। এই ধারার ট্যুরিজমে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাস অতি প্রাচীন, বাঙালি জাতির ইতিহাসও সহস্র বছরের পুরানো। আবার প্রতিটি অঞ্চল/জেলার রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, কৃষি আর ইতিহাস, মিথ ও উপকথা। এছাড়া মহান মুক্তিযুদ্ধের অমরগাঁথা আজও অম্লান। এসব বিবেচনায় বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা এবং পর্যটন কেন্দ্রে পরিকল্পিতভাবে স্লো ট্যুরিজম বা অচঞ্চল/বিবেচক পর্যটন গন্তব্য তৈরী করে বিশ্বের পর্যটকদের আকৃষ্ট করা সম্ভব। এমন কি শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনে বিশ্বব্যাপী জনমত গঠনে বিহারীদের জেনেভা ক্যাম্প আর রোহিঙ্গাদের আশ্রয়শিবির কেন্দ্র করেও স্লো পর্যটন গন্তব্য তৈরী হতে পারে।

হালাল, ইকো ও এগ্রিট্যুরিজমের পাশাপাশি স্লো ট্যুরিজম বা অচঞ্চল/বিবেচক পর্যটন হতে পারে বাংলাদেশের লাভজনক পর্যটন পণ্য।

Leave a Reply