কিটো ডায়েটের কুফল

Share on Facebook

ওজন কমাতে অনেকেই কিটো ডায়েট বেছে নিচ্ছেন। অথচ কিটো ডায়েটের ক্ষতিকর প্রভাবও কম নয়। এ বিষয়ে জানালেন ডায়েট কাউন্সেলিং সেন্টারের প্রিন্সিপাল নিউট্রিশনিস্ট সৈয়দা শারমিন আক্তার

কিটো ডায়েটে মূলত কার্বো-হাইড্রেটকে এড়িয়ে চলা হয়। আমাদের শরীরে যে জমাট ফ্যাট থাকে, কোনো কাজের সময় শরীর সেটাকে পোড়ায় না। তুলনামূলকভাবে চর্বি পোড়ানো সহজ হওয়ায় কাজের ক্ষেত্রে শরীর প্রথমে চর্বিকেই পোড়ায়। ফলে এ কার্বো-হাইড্রেট আমাদের শরীরে জমাট বেঁধে স্থূলতা তৈরি করে। কিটো ডায়েটের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে কার্বো-হাইড্রেটকে পুড়িয়ে ফেলা।

কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাবার ভাত; যার ৯০ শতাংশই কার্বো-হাইড্রেট। অর্থাৎ আমাদের শরীর কার্বো-হাইড্রেটসমৃদ্ধ খাদ্যে অভ্যস্ত। এটি শরীরের ওজন বাড়িয়ে দেয়। খাদ্য কিটোজেনিক ডায়েটের মূল ফর্মূলা কার্বো-হাইড্রেটকে বাদ দিয়ে ফ্যাট আর প্রোটিনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

আমাদের শরীরের প্রধান খাদ্য বা জ্বালানি হলো গ্লুকোজ। কিন্তু যদি কোনো কারণে গ্লুকোজ শেষ হয়ে যায়, তবে দেহ একটি বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার করে। সেই বিকল্প জ্বালানিগুলোকে বলা হয় কিটোন বডি। কিটোন বডি থেকেই এসেছে কিটোজেনিক ডায়েট। কিটোন বডির মধ্যে রয়েছে এসিটোন, এসিটো এসিটিক এসিড এবং বিটা-হাইড্রক্সি-বিউটারেট।

কিটো ডায়েট হলো সুপার লো-কার্ব ডায়েট। এ ডায়েটে কার্ব এক্সট্রিম লেভেলে কম থাকবে আর ফ্যাট অনেক হাই থাকবে আর প্রোটিন মিড লেভেলে থাকবে। টিপিক্যাল কিটোজেনিক ডায়েটে টোটাল ক্যালরিক নিডের কার্ব ৫ শতাংশ, প্রোটিন ২৫ শতাংশ আর ফ্যাট থাকে ৭০ শতাংশ। মানে আপনি সারা দিন যত খাবার খাবেন তার মধ্যে খাবারের পার্সেন্টেজ এমন হবে। আমাদের নরমাল ডায়েটে ৫০ শতাংশ কার্বো-হাইড্রেট থাকে, ২০ শতাংশ প্রোটিন আর ৩০ শতাংশ ফ্যাট থাকে। ধরা যাক আপনি ১২০০ ক্যালরি খাবেন সারা দিনে। তার ৫০ শতাংশ কার্ব মানে আপনাকে ৬০০ ক্যালরির কার্ব খেতে হবে।

বহুল আলোচিত-সমালোচিত কিটোজেনিক ডায়েট। অনেকেই না জেনে এই ডায়েট গ্রহণ করছেন। কিটোজেনিক ডায়েট মোট পাঁচ ধরনের হয়ে থাকে।

১২ বছর গবেষণার ফসল কিটোজেনিক ডায়েট। মৃগীরোগীদের ওষুধ আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত এটি ব্যবহার করা হতো। ওষুধ আবিষ্কারের পর এ ডায়েটকে গ্রহণযোগ্য নয় বলা হয়েছে। কারণ সাইড ইফেক্ট হিসেবে অতিরিক্ত ওজন হ্রাস পেত। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যাও দেখা দিত। যেহেতু ওজন হ্রাস পায় সেজন্য অনেকের মনে হতে পারে, কিটোজেনিক ডায়েট ওজন কমানোর খুবই কার্যকর ডায়েট। অথচ কিটোজেনিক ডায়েট অনুসরণকারীদের নানা ধরনের সমস্যা হয়।

যেসব সমস্যা হতে পারে

যেমন ডায়াবেটিস না হওয়া সত্ত্বেও হাইপো গ্লাইসেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়া।

গলব্লাডার রিমুভ এমন অনেকের দিন-রাত শুধু বমি হতে পারে। * এসিডিটি অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পায়।

মেটাবলিক রেট একেবারে স্লো হয়ে গেছে। ক্ষুধামান্দ্য দেখা দিয়েছে।

সবকিছু ভুলে যাচ্ছেন এমনকি দোকানে কিছু কিনতে গেলেও কত টাকায় কিনেছেন বা কত ফেরত পাবেন বা কী কী কিনেছেন সবকিছু।

শরীর অসম্ভব ধরনের ড্রাই থাকে, সারাক্ষণ পানি পিপাসা লাগে। মনে হচ্ছে হাত-পা জ্বালা করছে। ডিহাইড্রেশন হয়।

চুল আগের তুলনায় একেবারে কমে গেছে।

মেজাজ কন্ট্রোল করা যাচ্ছে না। সবার ওপর রাগ করার প্রবণতা দেখা দিয়েছে।

হঠাৎ হঠাৎ হার্টবিট বেড়ে যায়। সে সময় অন্য কোনো কাজ করা যায় না।

আগে ওষুধ খেতে হতো না। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত উচ্চরক্তচাপের জন্য মেডিসিন খেতে হচ্ছে।

ডিসলিপিডেমিয়া হয়ে গেছে। অর্থাৎ খারাপ কোলেস্টেরল বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু ভালো কোলেস্টেরল কমে যাচ্ছে।

এ ধরনের ডায়েট আসলে কারোর জন্য প্রযোজ্য নয়। এখন পর্যন্ত দীর্ঘদিন কিটোজেনিক ডায়েট অনুসরণের ফলাফলের কোনো গবেষণা হয়নি। কারণ তার আগেই স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো দেখা দিয়েছে। ফলে কিটোজেনিক ডায়েট অনুসরণ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। যেকোনো ডায়েট অনুসরণেই প্রচুর পানি খাওয়া ও এক্সারসাইজ জরুরি। তাহলে কেন নিজস্ব খাদ্যাভ্যাস বাদ দিয়ে অন্য দেশীয় খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত হতে হচ্ছে?

খাদ্যাভ্যাস ঠিক রেখে ওজন কমানোর সুফল

অথচ খাদ্যাভ্যাসে ২ মাসে ১০ কেজি, ৪ মাসে ২০-২৫ কেজি, ৬-৮ মাসে ৪৫-৪৮ কেজি পর্যন্ত কমাতে পেরেছেন। শুধু তাই নয়, সব ধরনের খাবার খেয়েও ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখাও সম্ভব হচ্ছে। এনার্জি লেভেল যাদের কম ছিল, তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি এনার্জেটিক ও সুস্থ। যাদের উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য মেডিসিন খেতে হতো, তাদের নিয়মিত মেডিসিন খেতে হয় না। চুল পড়া বন্ধ হয়েছে। পিসিওএসের সমস্যা নিয়ন্ত্রণ হয়েছে। অনিয়ন্ত্রিত মিনস্ট্রেশন নিয়ন্ত্রণ হয়েছে।

ডায়াবেটিস কন্ট্রোলে এসেছে। যাদের লিপিড প্রোফাইল বেশি ছিল, তাদের কোলেস্টেরল কমেছে। হাইপোথাইরয়েড নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ফ্যাটি লিভার স্বাভাবিক হয়েছে। সুষম খাদ্যাভ্যাস এবং কিছু নিয়মকানুন অনুসরণ করে কিশোর-কিশোরীর উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকেরই যাদের নিয়মিত ঠাণ্ডা-কাশির জন্য মেডিসিন খেতে হতো, তাদের ঠাণ্ডা সমস্যা একেবারে ঠিক হয়ে গেছে।

সুষম খাদ্যাভ্যাসের এত সুবিধা থাকা সত্ত্বেও কেন নিজেদের খাদ্যাভ্যাসকে বিসর্জন দিয়ে অন্য দেশের খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত হতে হবে? অবশ্যই নিজের দেশের খাদ্যাভ্যাসের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করুন। কারণ ওবেসিটি আমাদের দেশীয় খাদ্যাভ্যাস থেকে তৈরি হয়নি। হয়েছে অন্য দেশীয় খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত হওয়ার কারণে। নিজের প্রতি আস্থাশীল থাকুন, সুস্থ থাকুন। নিজে না বুঝলে অভিজ্ঞ পুষ্টিবিদদের পরামর্শ নিন।

 

Leave a Reply