একজন মুকুটহীন সম্রাট মাইকেল বালাক

Share on Facebook

মোহাম্মদ আলী শাহঃ   সম্রাট এবং মুকুট শব্দ দুটো একে অপরের পরিপূরক। অথচ উনার সময়ে উনি ফুটবলকে শাসন করেও শুধুমাত্র শিরোপা শূন্যতায় সম্রাট খেতাব পাওয়া থেকে হয়েছিলেন বঞ্চিত!

য়ুর্গেন ক্লিন্সম্যান বলেছিলেন—
“He knows what being the captain of Germany means.”

উনার সময়টায় উনি ছিলেন সর্বজন স্বীকৃত সেরাদের একজন। ফুটবলে উনাকে রিকোগনাইজ করা হয়, “ওয়ান অব দ্যা মোস্ট কমপ্লিট এবং ভার্সেটাইল মিডফিল্ডার অব হিজ জেনারেশন”। মিডফিল্ডের সম্ভব সবগুলো পজিশনে উনার বিচরণ ছিল সম্রাটের মতোই। তাইতো উনাকে বলা হয় মুকুটহীন সম্রাট।

বালাক ছিলেন এমন একজন কমান্ডার যাকে ছোট কাইজার উপাধি দেয়া হয়েছিল। একটা বিশ্বকাপ জয় হয়তো উনাকে ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার এবং লোথার ম্যাথিউসের পর পরই স্থান দিতো! ২০০২ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল এবং সেমি ফাইনালে ব্যাক টু ব্যাক গোল করে দলকে যখন ফাইনালে তুললেন, ঠিক তখনই সেমিতে উনার করা একটি ট্যাকলে জার্মানদের হৃদয় ভেঙ্গে গিয়েছিল। ঐ হলুদ কার্ডটিতেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, উনি আর ফাইনাল খেলতে পারছেন না। ফাইনালের আগেই যেনো জার্মানরা আঁচ করতে পেরেছিলেন, বিশ্বকাপটা ব্রাজিলই পেতে যাচ্ছে। উনি ফাইনালে খেললে হয়ত ২০০২ সালে জার্মানরা নিজেদের চতুর্থ বিশ্বকাপটা জিতেও যেতে পারতেন! হয়ত ছোট কাইজার মুকুটের পাশাপাশি পেয়ে যেতেন ফুটবল সম্রাট উপাধি।

ফাইনালে জার্মান দলের হয়ে বালাকের শূন্যতা ছিল চোখে পড়ার মতো। ফুটবলীয় মনোভাব এবং আগ্রাসন সম্পর্কে ধারনা পেতে সাহায্য করবে উনার এই উক্তিটি—
“We have to be very aggressive, to go to the limit of what’s legal.”

উনার পায়ে বল থাকার মানেই ছিল জার্মানরা নিরাপদ। দারুণ সব গোলের সম্ভবণা তৈরি করতে কখনো চিকি পাস, কখনো দুর্দান্ত লং পাস কিংবা কখনো নিজেই নিয়ে নিতেন আচমকা দূর পাল্লার জোরালো শট। কিন্তু কখন কি করবেন, এটা ছিল প্রতিপক্ষের কাছে সবসময়ই ধাঁধার মতো! ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে, মধ্যমাঠে বল পাবার পর জিনেদিন জিদানের পর সবচেয়ে বেশি প্রাণবন্ত মনে হতো উনাকেই। সহজাত পজিশন সেন্ট্রাল মিডে হলেও এটাকিং মিড কিংবা ডিফেন্সিভ মিড পজিশনেও তিনি ছিলেন অনন্য। দলের প্রয়োজনে যেকোন পজিশনে নিজেকে মানিয়ে নিতেন। খেলার মাঠে প্রতিপক্ষের সাথে হট্টগোল, পিছিয়ে থেকে আক্রমণের পর আক্রমণ করেও গোল না পাওয়া, রেফারীর বাজে ডিসিশানের স্বীকার হওয়া সহ প্রতিটি দৃশ্যে যার সরব উপস্থিতি সবার চোখে পড়ত, সেই মানুষটাই ছিলেন মাইকেল বালাক। দলের নেতা হবার আগে থেকেই নেতৃত্ব গুণে নিজেকে তৈরি করেছিলেন। এ কারণেই সহযোগী খেলোয়াড়েরা উনাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন এবং উনার নেয়া সকল সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নিতেন।

শিরোপা জয় দিয়ে আজকাল সব খেলোয়াড়কেই মূল্যায়ন করা হয়। এটা বাদ দিলে, মধ্যমাঠ দাপিয়ে বেড়ানোদের মধ্যে উনি ছিলেন আমার দেখা সেরাদের মধ্যে অন্যতম একজন। প্রতিপক্ষ খেলোয়াড় উনার পা থেকে বল কেড়ে নেবার জন্য টেকনিক কিংবা ট্যাকল, এমনি শারীরিক বল প্রয়োগ করেও বেশিরভাগ সময়ই উনার বিপক্ষে অসফল ছিলেন। ফুটবলীয় স্কিল, গতি এবং শক্তিমত্বায় উনার ধারেকাছেও সমসাময়িক কেউ ছিলেন না!

কৈশোরে সিনিয়র ভাইদের মারফতে ব্রেণে একটা কথা আটকে গিয়েছিল, জার্মানরা অসম্ভব মেরে খেলে এবং তারা জোর করে বিশ্বকাপ নিয়ে নেয়! এই একটি কারনে গ্রেট অলিভার কান, লোথার ম্যাথিউস কিংবা ক্নিন্সম্যানদের মতো লিজেন্ডদের অসাধারণ খেলাটাও কখনো সহ্য করতে পারতাম না! এটা ছিল অনেকটা অন্ধ বিশ্বাসের মতো, যেখানে আমি ছিলাম শতভাগ রিজিড।

একটু একটু করে ফুটবল বুঝতে শুরু করেছি তেমন একটি সময়ে আমি উনিতে মুগ্ধ হয়ে থাকতাম। মনে মনে চাইতাম জার্মানরা হারুক কিন্তু উনি ভালো খেলুক! ৬’২” উচ্চতার মানুষটিকে প্রথম দেখায় মনে হয়েছিল কোন হলিউড হিরো। উনার সুঠাম দেহ, অসাধারন টেকনিক, শারীরিক শক্তিমত্তা, স্পট কিক, ফ্রি কিক, দুর্বার গতি, পেনাল্টি স্পেশালিস্ট, দানবীয় হেড, ডিফেন্ডারদের মতো ট্যাকল, নির্ভূল লং পাস এবং দুই পায়ে সমান পাওয়ারফুল শট সবসময়ই ছিল দৃষ্টি নন্দন এবং ট্রেড মার্কের মতো।

জাতীয় দলের হয়ে বড় শিরোপার পাশাপাশি ক্লাব ফুটবলে উচল বঞ্চিত এই মধ্য মধ্য মাঠের কমান্ডারের ব্যক্তিগত শিরোপার ভান্ডার কিন্তু বেশ সমৃদ্ধ। মিডফিল্ডার হিসেবো অসংখ্য উয়েফা এবং ফিফা বর্ষসেরা দলীয় অ্যাওয়ার্ডের পাশাপাশি যৌথভাবে তিন তিনবার জার্মান প্লেয়ার অব দ্যা ইয়ারে মনোনীত হয়েছিলেন যেখানে উনার উপরে শুধু চারবারের বর্ষসেরা বড় কাঈজার ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার।

ফুটবলকে বিদায় জানানোর পর ক্লিন্সম্যানের এই উক্তিটি বেশ দাগ কেটেছিল—
“He is a role model in all respects on and off the pitch and has developed tremendously himself.

মাইকেল কিংবা বালাক কিংবা মাইকেল বালাক যে নামেই উনাকে ডাকা হোক না কেন, এটা দিবালোকর মত সত্য জার্মান ফুটবল যখন বেকেনবাওয়ার, মুলার, লোথার কিংবা ক্লিন্সম্যানদের শূন্যতায় ধুকছিল, ঠিক তখনই সোনালী দিনের হারানো ভয়ংকর ফুটবল ছন্দ খুঁজে পাবার নতুন শুরুটা কিন্তু হয়েছিল উনার নায়োকোচিত আভির্ভাবের মাধ্যমেই। নিজে মুকুটহীন থেকেও জার্মান স্বর্ণালী প্রভাত ফেরির সূচনা ঠিকই করে গিয়েছিলেন।

ফুটবল সমর্থকরাই সর্বদা সাফল্যের গুণগানে ব্যস্ত থাকে। মাইকেল বালাককে তারা হয়ত স্বরণ করবে ২৫টির বেশি ফাইনালে পরাজিত একজন পরাজিত যোদ্ধা হিসেবে কিংবা ফুটবলের মোস্ট আনলাকি ফুটবলার হিসেবে। কিন্তু কেউ কেউ ঠিকই বালাকের প্রসঙ্গে আবেগতাড়িত হয়ে যাবে, বালাকের সোনালী দিনগুলোকে প্রচন্ড মিস করবে এবং বালাককে স্মরণ করবে সম্মানের সাথে। ১৯৯০ পরবর্তি সময়ে হারিয়ে যাওয়া জার্মান ফুটবল ঐতিহ্যের বিশ্বসেরা গৌরব ফিরে পেতে অসংখ্য জার্মান ফুটবল সেনাদের মধ্যে সবার প্রথমে এবং সবচেয়ে বেশি যিনি নতুন স্বপ্নের সূচনা করেছিলেন, তিনিই হচ্ছেন বালাক, মাইকেল বালাক দ্যা কমান্ডার।

যেকোন সময় কিংবা যুগ বিবেচনায় বালাকই আমার সবচেয়ে প্রিয় জার্মান ফুটবলার। আজ এই মানুষটার ৪৪তম জন্মদিন। শুভ জন্মদিন লিজেন্ড।

One thought on “একজন মুকুটহীন সম্রাট মাইকেল বালাক

Leave a Reply