আয়ুর্বেদ মতে আহার

Share on Facebook

আয়ুর্বেদ কেবলই একটি চিকিৎসা ব্যবস্থা নয়, জীবনশৈলীও বটে। অর্থাৎ আয়ুর্বেদিক ব্যবস্থায় চিকিৎসা গৌণ। মূখ্য হলো আহার (খাবার) ও বিহার (জীবনযাত্রা)-এর মাধ্যমে স্বাস্থ্য রক্ষা ও পরিচর্যা করা। কথাটা খুব সাদামাটা হলেও এর ভিতর রয়েছে অনেক বৈজ্ঞানিক নির্দেশনা। বিষয়ের গভীরতা ও আঙ্গিক কলেবর চিন্তা করে এই পর্বে শুধু আহার নিয়ে আলোচনা করছি। বিহার নিয়ে আরেকটি প্রবন্ধ লিখবো।

আহার সম্বন্ধে ধারণা:
আহার হলো বেঁচে থাকার এক অপরিহার্য উপাদান। স্বাস্থ্য ও রোগাক্রমণ প্রধানত আহারের উপর নির্ভরশীল। যথার্থ আহার যথাসময়ে এবং যথানিয়মে গ্রহণ করলে স্বাস্থ্য রক্ষা ও রোগ নিরাময় উভয়ই সম্ভব বলে প্রাচীনকালে আয়ুর্বেদের পন্ডিতগণ পরিস্কারভাবে বলে গেছেন। তাদের এইসব বক্তব্য আজকের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ ও সমুজ্জ্বল। আহারকালে যে খাবার গ্রহণ করা হয় তাতে মিষ্টি (Sweet), টক (Sour), নোনা (Salty), কটু (Pungent), তিক্ত (Bitter) ও কষা (Astringent) এই ৬ (ছয়) ধরণের স্বাদ থাকে। তবে এর সবগুলি সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। দেহের ধরণের উপর নির্ভর করে একেকজনের জন্য তার পরিমাণ নির্ধারণ করতে হয়। অর্থাৎ প্রযোজ্য স্বাদযুক্ত আহার নির্ধারণের পূর্বে দেহের ধরণ নির্ধারণ করা জরুরি। সব মিলিয়ে যথার্থ আহার নির্ধারণ এবং তা পরিমাণ ও সময়মতো গ্রহণ সুখায়ু ও হিতায়ু লাভ করা সম্ভব।

আয়ুর্বেদমতে দেহের গঠন:
আয়ুর্বেদে জীবনকে দেহ, অনুভূতি, মন এবং আত্মার সমন্বয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মানবদেহের প্রধান চালিকাশক্তি হলো বায়ু অর্থাৎ এনার্জি অব মুভমেন্ট, পিত্ত অর্থাৎ এনার্জি অব ট্রান্সফর্মেশন ও কফ অর্থাৎ এনার্জি অব স্ট্রাকচার এন্ড লুব্রিকেশন। একে পরিপূর্ণ দৈহিক রূপ দিয়েছে ৭টি প্রাথমিক ধাতু বা কলা (রস, রক্ত, মাংস, মেদ, অস্থি, মজ্জা ও শুক্র) এবং ৩টি মল (মল, মূত্র ও ঘাম)। দেহের বৃদ্ধি ও ক্ষয় পুরোটাই নির্ভর করে খাদ্যের উপর যা দোষ, ধাতু ও মল এ পরিবর্তিত হচ্ছে। হজম প্রক্রিয়া, শোষণ, পরিপাক প্রনালী ও খাদ্যের রাসায়নিক প্রক্রিয়ার উপর আমাদের স্বাস্থ্যরক্ষা ও ব্যাধির আক্রমণ নির্ভর করে। আবার আমাদের শারীরিক সুস্থতার উপর মানসিক অবস্থা ও অগ্নির প্রভাব আছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আয়ুর্বেদ ৫,০০০ বছরের প্রাচীন চিকিৎসা ব্যবস্থা হলেও তা পুরোটাই বিজ্ঞানভিত্তিক।

বায়ু, পিত্ত এবং কফ – এই ৩টি অবস্থাকে আয়ুর্বেদে ‘দশা/দোষ/শক্তি’ বলে। দেহে এদের সমতা থাকলেই শরীর সুস্থ্য থাকে। কিন্তু অসমতা সৃষ্টি হলেই রোগের আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়। এই শক্তিগুলি একসাথে শরীরের ক্যাটাবোলিক ও এ্যানাবোলিক জৈবরাসায়নিক ক্রিয়া অর্থাৎ মেটাবোলিজম ঘটায়। এদের প্রধান কাজ হলো শরীরের হজম হওয়া পুষ্টির উপজাত দ্রব্য শরীরের সমস্ত স্থানে পৌঁছে দিয়ে কোষ ও কলা তৈরিতে সাহায্য করা।

আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় পথ্য ব্যবস্থা:
আয়ুর্বেদে খাদ্যাভ্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মানব দেহকে খাদ্যের ফলস্বরূপ ধরা হয়। মানুষের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ এবং মন মেজাজ সবই খাদ্যমানের উপর নির্ভরশীল। মানব দেহে খাদ্য বিভিন্ন প্রক্রিয়া দ্বারা রক্ত, পেশী, চর্বি, হাড়, হাড়ের মজ্জা, পুনর্জননের উপাদানে পরিণত হয়। কাজেই খাদ্য হল দেহের সমস্ত রাসায়নিক প্রক্রিয়া এবং জীবনী শক্তির মূল। খাদ্যে পুষ্টির অভাব বা অঠিক রূপান্তর অনেক রোগের পরিবেশ সৃষ্টি করে।

আয়ুর্বেদে মোট ৬ ধরণের চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে ‘পথ্য ব্যবস্থা’ অন্যতম। অন্য ৫টি হলো শোধন (বিশুদ্ধিকরণ) চিকিৎসা, শমন (প্রশমন) চিকিৎসা, নিদান পরিবর্জন (অসুখের কারণ বর্জন), সত্ববজায় (মানসিক রোগের চিকিৎসা) ও রসায়ন চিকিৎসা (দৈহিক শক্তি ও প্রাণশক্তি সৃষ্টির চিকিৎসা)। দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক ক্রিয়াাকর্ম, অভ্যাস ও আবেগজনিত অবস্থার উন্নতির জন্য পথ্য ব্যবস্থা অনুসরণ করা হয়। থেরাপিউটিক কার্যকারিতা বাড়াতে এবং প্যাথোজেনিক প্রক্রিয়াকে বাধা প্রদান করতে এই ব্যবস্থা বিশেষ কার্যকর। দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসের উপর নিষেধাবলি জারি করে অগ্নিকে উদ্দীপিত করা এবং খাদ্যবস্তুর উত্তম আত্মীকরণের মাধ্যমে কলাসমূহের শক্তি লাভই এই চিকিৎসার মূল লক্ষ্য।

দেহের ধরণ ও মানুষের বৈশিষ্ট্য:
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বায়ু, পিত্ত ও কফ দেহ পরিচালনার প্রধান শক্তি। তাই এদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী দেহকে ৭ ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। এরা হলো বায়ু, পিত্ত, কফ, বায়ু-পিত্ত, পিত্ত-কফ, কফ-বায়ু ও বায়ু-পিত্ত-কফ। দেহের এই ৭টি ধরণকে নিয়ে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

১. বায়ু প্রকৃতি: উৎসাহ, অনুপ্রেরণা, দৈহিক কার্য পরিচালনা, অঙ্গ ও ইন্দ্রিয়সমূহের কার্যকারিতা বজায় ও রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি হলো বায়ুর প্রধান কাজ। এই ধরণের মানুষের দেহের গড়ন হয় হালকা ও অবিরাম বিশ্রামহীন অবস্থায় কাজ করতে পারে এরা। এদের দেহ শুষ্ক হয়। তাই ময়েশ্চারাইজিংয়ের প্রয়োজন পড়ে। এরা গভীরভাবে দীর্ঘক্ষণ ধরে ঘুমায় না। ফলে ঘুম চট করে উঠে ফ্রেশ হতে সময় লাগে। হালকা চলনের এই মানুষদের কথা ও কন্ঠস্বর হয় নির্দেশমূলক, যা অনেকে পছন্দ করে না। এরা কথা একটু বেশি বলে। ভ্রমণপ্রিয় হয় বলে এরা বেশিক্ষণ একস্থানে থাকতে পছন্দ করে না। বসে থাকলেও এরা হাতের আঙুল নিয়ে খেলা করে এবং মনের অজান্তেই পা নাড়ায়। এরা যে কোন কাজ দ্রুত সম্পাদন করতে পছন্দ করে। প্রচুর এনার্জি থাকে বলে লাফ-ঝাফ এদের পছন্দ। এরা শীতল পানীয় বেশ পছন্দ করে। তাই ঘনঘন তা পান করে। বায়ু প্রকৃতির মানুষেরা অন্য কাউকে দ্রুত ভালোবাসেন এবং দ্রুত ত্যাগও করেন। এরা দ্রুত শিখতে পারে। তবে আবার দ্রুত ভুলেও যায়। এদের দেহে অধিক পরিমাণ ও মোটা মোটা লোম থাকে। এরা স্বল্প আহারী। নতুন সৃষ্টিতে এরা অত্যন্ত পটু, বিধায় সহজেই অন্য কাজের সাথে দ্রুত নিজেদেরকে যুক্ত করে ফেলে।

বায়ু প্রকৃতির মানুষের মধ্য থেকে ক্ষুরধার বক্তা, জনপ্রিয় নৃত্যশিল্পী ও উচুঁমানের সঙ্গীতশিল্পী তৈরি হয়। বিক্রয়কর্মী ও ভ্রমণ বিষয়ক চাকুরির জন্য এরা উত্তম। অংকে ভালো হয় বলে এদের বিশ্লেষণ ক্ষমতা খুবই ভালো। তবে অধৈর্য হওয়ার জন্য এরা ব্যবসায়ে ভালো করে না। এরা দ্রুত নতুন ও সৃজনশীল উদ্ভাবনে পটু হলেও বাস্তবায়নে দূর্বল। এরা দ্রæত আয় করেন ও দ্রুত ব্যয় করতে পছন্দ করেন।

২. পিত্ত প্রকৃতি : হজমে সাহায্য করা, শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখা, দৃষ্টি, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, বুদ্ধি ও সাহস বৃদ্ধি করা এবং দেহের কোমলতা প্রদান করা পিত্তের প্রধান কাজ। পিত্ত প্রকৃতির মানুষের দেহ কোমল ও মাংসল হয় এবং একটু মোটা হলে পেশী ঝুলে পড়ে। এইজন্য উত্তপ্ত পরিবেশ এদের অপছন্দ। এরা দ্রæত মোটা হয় এবং দ্রæত শুকিয়ে যায়। এদের হজম শক্তি বেশি এবং মাঝারি দীর্ঘ সময় ঘুমাতে পারে। ঘুম থেকে উঠে সহজেই ফ্রেশ হতে পারে। এদের চুল নরম ও পাতলা, নখ ও চামড়া নরম এবং চুলের বর্ণ সাধারণত ধুসর কালো হয়। এদের গায়ের চামড়া সুন্দর হয়। তবে মুখে ও দেহের বিভিন্ন স্থানে ব্রোন উঠে। এরা দ্রæত রেগে যায়, তবে তা বেশি সময় ধরে পুষে রাখতে পারে না। এরা অন্যকে গভীরভাবে ভালোবাসে তবে তা প্রকাশ করে না। এদের দেহে একধরণের কটু গন্ধ পাওয়া যায়। ক্ষুধা ও তৃষ্ণা তীব্র বলে এরা বেশ খেতে পছন্দ করে। এরা সহজে বুড়িয়ে যায়, চামড়া কুঁচকে যায় এবং মাথার চুল কমে যায়।

তীক্ষ বুদ্ধিসম্পন্ন ও গভীর গর্বিত মানুষেরা পিত্ত টাইপের। এরা পরিকল্পনা, আয়োজন, ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কাজে পটু। এদের নেতৃত্ব দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে সফলতা আনায় দক্ষ। পিত্ত টাইপের মানুষেরা ভালো শিক্ষক হয়। এরা বাণিজ্য, বিতর্ক, রাজনীতি ও অধিকার আদায়ে সক্ষম ও সফল চরিত্রের। এরা শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করে ও ভালো রান্না কিংবা খাবার উপভোগ করে।

৩. কফ প্রকৃতি: স্থিতিশীলতা, দেহের জয়েন্টগুলির কার্যকারিতা, সহনশীলতা, আবেগ এবং মানসিক চাপ ধরে রাখা কফের অন্যতম প্রধান কাজ। এদের দেহ সাধারণত চর্বিতে মোড়ানো থাকে বলে দৈহিক আকার বড় হয়। এদের চুল, চামড়া ও নখ ময়েশ্চারাইজড থাকে। এদের চুল সাধারণ সোজা ও গভীর কালো বর্ণের হয়। এদের গায়ের রং কালো থেকে ফরসা হয় এবং দেহ মসৃণ থাকে। এদের দেহ বেশ ভারী প্রকৃতির। তাই এরা একটু অলস হয়, তবে অত্যন্ত দৃঢ়। এদের দৈহিক ও মানসিক চলন ধীর প্রকৃতির। এরা সহজে অধিক ক্ষুধার্ত বা তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়ে না। রুটিনের মধ্যে যে কোন কাজ এরা খুব সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারে। তবে হঠাৎ নতুন কোন কাজ দেখলে ঘাবড়ে যায়। এদের কন্ঠ নরম ও গভীর হয়, যা সুখময়তা নিয়ে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

গবেষক ও চিন্তাশীল ব্যক্তি হিসেবে কফ প্রকৃতির মানুষ অত্যন্ত কার্যকর। সহমর্মিতা ও আগাম বুঝার ক্ষমতা আছে এদের। তাই চিকিৎসক ও মনোবিদ হিসেবে এরা ভালো করে। নিয়োগদান ও জনবল ব্যবস্থাপনায় এরা খুব দক্ষ। দায়িত্ব গ্রহণে বেশ ভালো বলে এরা ব্যবসায়ে এরা সফল হয়। দীর্ঘমেয়াদি কাজের সহযাত্রী হিসেবে কফ প্রকৃতির মানুষ খুবই ভালো।

৪. বায়ু-পিত্ত: এরা বায়ু ও পিত্তের যৌথ ও গড় গুণাবলিসম্পন্ন হয়।

৫. পিত্ত-কফ: এরা পিত্ত ও কফের যৌথ ও গড় গুণাবলিসম্পন্ন হয়।

৬. কফ-বায়ু: এরা কফ ও বায়ুর যৌথ ও গড় গুণাবলিসম্পন্ন হয়।

৭. বায়ু-পিত্ত-কফ: এরা বায়ু, পিত্ত ও কফের যৌথ ও গড় গুণাবলিসম্পন্ন হয়।

বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, বিশুদ্ধ বায়ু, পিত্ত, কফ ও বায়ু-পিত্ত-কফ এই ৪ ধরণের মানুষের সংখ্যা খুব কম। অধিকাংশ মানুষ যে কোন ২টি দশার মিশ্র রূপ।

আহার নির্ধারণ:
আয়ুর্বেদিক রান্নাঘরকে ফার্মেসি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ এখানে যে আহার প্রস্তুত করা হয় তা দিয়ে অনেক স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান ও ভবিষ্যৎ সমস্যা রোধ করা হয়। ৬টি স্বাদের সমন্বয়ে দেহের ধরণ বিবেচনা করে ত্রিদোষে সমতা আনার উদ্দেশ্যে এবং প্রকৃত স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য আয়ুর্বেদিক আহার প্রস্তুত করা হয়। তাই এরূপ আহার গ্রহণের মাধ্যমে দেহ ও মন মহাজাগতিক শক্তি অর্জন করে। আয়ুর্বেদিক আহার বিশুদ্ধ, তাজা, পরিপূর্ণ হয় যা ভালোবাসার স্পর্শে প্রস্তুত করা হয়। মানুষের দেহের ধরণের উপর ভিত্তি করে আহার নির্ধারণ হয়, যা নিচে উল্লেখ করা হলো:

বায়ু প্রকৃতি: কর্নাটকের মাইশুরুতে অবস্থিত ইন্দাজ ভ্যালি আয়ুর্বেদা সেন্টার বায়ু প্রকৃতির মানুষের জন্য সুষম আহারের কথা বলেছে। তাদের মত অনুযায়ী আহারের অর্ধেক অর্থাৎ ৫০% শর্করা (চাল, যব, গম ইত্যাদি), ৪০%-এর মধ্যে অর্ধেক থাকবে উদ্ভিজ্জ প্রোটিন (মসুর, মুগ, সিম ইত্যাদি) ও অর্ধেক সব্জি এবং ১০% থাকবে মিষ্টি বা ফল। বায়ু প্রকৃতির মানুষদেরকে যথাসম্ভব শুকনো, মচমচে, শীতল ও কাঁচা আহার পরিহার করতে হবে।

পিত্ত প্রকৃতি: পিত্ত প্রকৃতির মানুষের আহারে অধিক সব্জি ও তিক্ত স্বাদযুক্ত খাদ্য থাকা বাঞ্ছনীয়। আহারে অধিক পরিমাণ লবন, মসলা ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে এবং টকজাতীয় খাবার কম দিতে হবে। তবে দারুচিনি, হলুদ ও গোলমরিচ, চা ও কফি খেতে বাধা নাই পিত্ত প্রকৃতির মানুষের। এলকোহল পরিত্যাজ্য। এরা নানা ধরণের মিষ্টি ফল (দুপুরে খাবারের একঘন্টা আগে), দানাদার খাদ্য (চাল ও গম) ও মসুর ব্যতীত অন্যান্য ডাল, ডিম, দুধ ও দুগ্ধজাত আহার, টাটকা মধু (সংগ্রহের ৬ মাসের মধ্যে) গ্রহণ করতে পারবে। সাথে ঘি ও ঠান্ডা পানি গ্রহণ করলে তা বাহক বা অনুপান হিসেবে উপকারী ভূমিকায় কাজ করবে।

কফ প্রকৃতি: কফ প্রকৃতির মানুষদেরকে যতটুকু ক্ষুধা, তারচেয়ে কম আহার গ্রহণ করতে হবে। মসলাযুক্ত খাবার, শুকনো ডুমুর, অল্প শর্করা, ডিম, মুরগি, মাসকলাই ছাড়া অন্য ডাল, মধু, ননীমুক্ত দুধ ইত্যাদি খাবার এদের জন্য উত্তম।

পরিহারযোগ্য আহার:
দেহের প্রকৃতি অনুযায়ী প্রত্যেককে কিছু খাদ্য পরিহার করতে হয়, যা উপরে কিছুটা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে নিউ মেক্সিকোতে অবস্থিত দ্য আয়ুর্বেদিক ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও বিখ্যাত আয়ুর্বেদ পন্ডিত ড. বসন্ত লাড এক প্রকাশনায় নিচের খাদ্যগুলিকে যথাসম্ভব পরিহার করার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। এই অনুযায়ী আমাদের দেশে সহজলভ্য কিছু পরিত্যাজ্য খাদ্যের তালিকা নিচে তুলে ধরা হলো:

বায়ু প্রকৃতি: কাঁচা আপেল, শুকনো খেজুর, পিয়ার, তরমুজ ইত্যাদি ফল। ব্রোকলি, কাঁচা ফুলকপি ও বাধাকপি, কচি ভূট্টা, বেগুন, মাশরুম, কাঁচা জলপাই, কাঁচা পেয়াজ, কাঁচা মরিচ, টমেটো সালাদ, সাদা আলু, কাঁচা মূলা ইত্যাদি সব্জি। কাজু বাদাম, গরু ও ছাগলের গুঁড়া দুধ, দই, ভেড়ার মাংস, চকোলেট, তিসির তেল, আপেল জুস, ব্ল্যাক টি, কফি, কার্বোনেটেড ড্রিংক, চকোলেট মিল্ক এবং দুগ্ধজাত শীতল খাবার।

পিত্ত প্রকৃতি: টক আপেল, কলা, কাঁচা আঙ্গুর, লেবু, কাঁচা আম, টক কমলা, টক আনারস ও তেঁতুল ইত্যাদি ফল। কটু স্বাদযুক্ত সব্জি, রসুন, কাঁচা মরিচ, কাঁচা পেয়াজ, কাঁচা মূলা, কাঁসুন্দি, টমেটো ইত্যাদি সব্জি। বাটার, বাটার মিল্ক ও পনির, গরু ও ভেড়ার মাংস, হাঁস, সামুদ্রিক মাছ, লেবু ও আমের আচার, মেয়োনেজ, সয়া সস, সূর্যমুখী ও তিলের তেল, আপেল সিডার ও কার্বোনেটেড ড্রিংক।

কফ প্রকৃতি: কলা, নারিকেল, খেজুর, ডুমুর, তরমুজ, কমলা, পেঁপে, আনারস, তেঁতুল ইত্যাদি ফল। শসা, মিষ্টি আলু, মিষ্টি কুমড়া ইত্যাদি সব্জি। শর্করার মধ্যে গম এবং সয়াবিন দিয়ে তৈরি খাদ্য। গরুর দুধ, দই, পনির ও আইস ক্রিম, গরু, মহিষ, ভেড়া ও হাঁসের মাংস এবং সামুদ্রিক মাছ। চকোলেট, আমের চাটনি ও আচার, লেবু ও লেবুর আচার, সয়া সস, ভিনেগার, সয়াবিন তেল, সূর্যমুখী ও নারিকেল তেল এবং কার্বোনেটেড ড্রিংক।

আহারের সময়:
আয়ুর্বেদ মতে সকল আহার গ্রহণের সাথে আকাশে সূর্যের উপস্থিতির প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। দিনের বেলা দেহের অগ্নি অনেক বেশি কর্মক্ষম থাকে। ফলে খাদ্য থেকে দেহে অমা বা টক্সিন তৈরি হয় না। তাই ঘুম থেকে উঠেই প্রাতঃকালে ঊষাপান হিসেবে এক গ্লাস গরম পানি পান করে সূর্যোদয়ের কাছাকাছি সময়ে সকালের আহার গ্রহণ করা উচিত। তবে তা কোনভাবেই ৯.৩০ টা অতিক্রম না করার জন্য অভিজ্ঞরা মত দিয়েছেন। সূর্য যখন মধ্যগগনে থাকাকালে দুপুরের আহার গ্রহণ করা উত্তম। রাতের আহার সূর্যাস্ত থেকে শুরু করে রাত ৮.০০ টার মধ্যে গ্রহণ করার বিশেষ তাগিদ আছে। রাত ১০.০০ টার পর শর্করা জাতীয় আহার গ্রহণ থেকে বিরত থাকা বাঞ্জনীয়।

আহারের পদ্ধতি:
দুপুর ও রাতের আহারে ৬ ধরণের স্বাদযুক্ত আহার গ্রহণ করা উচিত। তবে বায়ু, পিত্ত ও কফের প্রকৃতি মেনে পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে। আহারের শুরুতে মিষ্টি জাতীয় ফল দিয়ে শুরু করে পরে নোনা ও টক জাতীয় খাবার গ্রহণ করা উত্তম। সবশেষে কটু, কষা ও তিক্ত খাবার দিয়ে আহারের পরিসমাপ্তি ঘটানো উচিত। অত্যন্ত মনযোগ সহকারে, ঠান্ডা হওয়ার পূর্বেই আহার গ্রহণ করতে হবে। তবে পরিপূর্ণ স্বাদ গ্রহণের জন্য রসনাকে সময় দিতে হবে এবং অধিক খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে। খেতে হবে শুধু ক্ষুধা নিবারণের উদ্দেশ্যে। আগের বেলার খাবার হজম না হলে পরের বেলায় কম আহার গ্রহণ করা উচিত। অনেক আয়ুর্বেদের পন্ডিতদের মতে প্রাতঃরাশে মাঝারি এবং মধ্যাহ্নভোজনে অধিক আহার গ্রহণের উপর তাগিদ দিয়েছেন। তারা আরো বলেছেন যে, ক্ষুধা না লাগলে রাতের খাবার পরিহার করা উত্তম।

উপসংহার:
বায়ু, পিত্ত ও কফ এই ত্রিদোষ সূর্যালোক ও তাপ এবং দিবারাত্রি ও ঋতুর প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। তাই এদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রুটিন মেনেই নিজেকে মানিয়ে নিয়ে চলতে হবে। অন্যথায় সুখায়ু অর্জন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।

 

মোখলেছুর রহমান
আহ্বায়ক, সম্মিলিত পর্যটন জোট

Leave a Reply