ঝটিকা সফরে মিঠামইন (প্রথম পর্ব)

Share on Facebook

২১ আগস্ট ভোর সাড়ে পাঁচটা। ফজরের নামাজ আদায় করে বসে চা খাচ্ছি। এমন সময় মোবাইলে ফোন এলো, ওয়েক আপ কল। আজ আমরা হাওরের দেশে যাবো, মিঠামইন। ঝটিকা সফরের এডমিন জান্নাতুল ফেরদৌসি মানু ফোন দিয়েছেন। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির কারণে বাসা থেকে বের হতে সামান্য দেরি হলেও ছয়টার মধ্যেই বেরিয়ে পড়লাম। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আই তেজগাঁও অফিসের সামনে থেকে বাস ছাড়বে সকাল সাতটায়। মনে মনে ভাবছি বৃষ্টি আর বাঙ্গালির স্বভাবজাত কারণেই বাস ছাড়তে দেরি হবে মিনিমাম একঘন্টা। অর্থাৎ আটটার আগে আমরা রওনা দিতে পারবো না বলে আমি মোটামুটি নিশ্চিত।

রিপোর্টিং টাইম সকাল সাড়ে ছয়টা। আমার অবশ্য পৌঁছতে দেরি হলো মিনিট পাঁচেক। এ-ই ভোরে ভ্রমণ সঙ্গীদের উপস্থিতি দেখে আমি তো অবাক। এই সাতসকালে বেশিরভাগ সঙ্গীই ইতোমধ্যে উপস্থিত। বাস এখনো স্পটে আসে নাই তাই তাঁরা অফিসের রাস্তাটায় হেলেদুলে বেড়াচ্ছেন, কেউ কেউ গরম পানি দিয়ে কাপ ধুয়ে নিয়ে ফুটপাতের দোকানে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। ওনাদের আকার-ইঙ্গিত, চলন-বলন দেখে ধারণা করছি তাঁরা কিছুটা গম্ভীর প্রকৃতির হবেন হয়তো। গম্ভীর মানুষদের সাথে ভ্রমণ করতে বাসের মধ্যে আসন বিন্যাস কেমন হতে পারে তা নিজ বিচারে নিয়েই গিয়ে বসলাম বাসের মাঝামাঝি সিটে। ওজনদার মানুষদের আসন সামনের দিকে থাকে সাধারণত। তাই নিজেকে মাঝারি মনে করে মাঝামাঝি সিটে গিয়ে বসলাম। আমার ডানপাশের সারিতে বন্ধু প্রমি আর পিছনের সিটে বড়ভাই লিপু দা। লিপু দা ছোটো ভাইদেরকে ভালবেসেই পিছনের সিটে বসে থাকবেন বোধ করি। ভ্রমণ সঙ্গীরা একে একে বাসে উঠছেন আর আমরা ভালো ছেলেদের মতো একসিট একসিট করে পিছনে সরে যাচ্ছি। এইভাবে বাস যখন উত্তরা অতিক্রম করে তখন আমি গিয়ে ঠেকলাম শেষ আসনের জাস্ট আগের আসনে। আর সর্বশেষ আসন অলংকৃত করে বসে আছেন আমার বড়ভাই লিপু দা।

সামাজিক দুরত্ব রক্ষা করে বাসে আসন

গাড়ির পিছনের আসনই যখন অনিবার্য পরিণতি তখন তা উপভোগ করা ছাড়া আর কী উপায় ছিল! ফলে আমরাও অর্থ্যাৎ আমি, প্রমি, লিপুদা, লিপুদার সাবেক সহকর্মী শাম্মি আপা হুলস্থুল গল্পগুজব আর হাসিঠাট্টা করে পুরোটা পথ পাড়ি দিলাম উল্লাসে। আমি একশো টাকা বাজি ধরে বলতে পারি গাড়ির মধ্যে আমাদের মতো আনন্দ-উল্লাস আর কেউ করতে পারে নাই। সত্যাসত্য বলতে পারবেন জান্নাতুল ফেরদৌসি মানু কারণ মহামান্য এডমিন হিসেবে উনি সারাটা বাস চষে বেড়িয়েছেন সারাক্ষণ।

পাকুন্দিয়া উপজেলার থানাঘাটে যাত্রাবিরতি শেষে গাড়ি ছুটে চলছে চামড়া ঘাট অভিমুখে। আমারও অপেক্ষা করছি গাড়ি কখন গিয়ে পৌঁছবে ঘাটে। গাড়ি ঘাটে পৌঁছা মাত্রই আমরা পিছনের সিটের দামাল ছেলেরা ঝাঁপিয়ে উঠবো নৌকার ছাদে। করিম গঞ্জের চামড়া ঘাটে ডাক বাংলোয় ফ্রেশ হয়ে আমরা সবাই (কেউ ফ্রেশ হয়েছে কেউ ফ্রেশ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে নাই) নৌকায় গিয়ে উঠলাম। দীর্ঘদিনের করোনাবন্দী জীবনের অতিষ্ঠতা অতিক্রম করে আমরা হাওরে ভাসছি নৌকার উপরে। চারদিকে পানি আর পানি। গভীর অগভীর জলরাশি সাঁতরিয়ে ভেসে আসছে মিষ্টি বাতাস। আমি ব্যাক্তিগতভাবে আশংকা করেছিলাম গুরুগম্ভীর ভ্রমণ সঙ্গীদের অনেকেই না আবার আনন্দের আতিশয্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে পানিতে। যেহেতু এই ট্যুরে ছোট বাচ্চাদের নিতে বারণ করা হয়েছিলো তাই আমি ভেবেছিলাম সবাই হয়তো হাওরে গিয়েই চোখ বন্ধ করে দিবে ঝাঁপ। যেহেতু এই ট্যুরে লাইফ জ্যাকেট বাধ্যতামূলক করা হয়েছিলো তাই আমি ধরেই নিয়েছিলাম হাতি দিয়ে টেনে ধরেও হয়তো পানিতে লাফালাফি করা থেকে দাবায়া রাখা যাবে না। আমার আশংকা মিথ্যে করে দিয়ে ওনারা নৌকার ছাদে উঠে চিপস, চানাচুর, ম্যাঙ্গোবার, মাম পানি ইত্যাদি খেয়ে গাম্ভীর্যভাবটা এখন অবধি ধরে রাখলেন। তবে হ্যাঁ সব্বাই অন্তত একটা বিষয়ে নিয়ম ভেঙেছেন শতভাগ, মুক্ত বাতাস পেয়েই শাটশাট করে মুখ থেকে খুলে ফেলেছে সরকার নির্দেশিত মাস্ক। একশো ছাপ্পান্ন দিন পরে প্রাণ ভ’রে নিশ্বাস- আহা কি আনন্দ, আকাশে বাতাসে…

নৌকার ছাদে ভ্রমণসঙ্গীদের একাংশ

মিঠামইনের সদর মাটিতে আমরা যখন পা রাখলাম সূর্য তখন হেলে পরেছে পশ্চিমাকাশে। আমরা ব্যাগবোঁচকা ও আমাদের সমান উচ্চতার ছায়াসঙ্গী নিয়ে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে একভাগ উঠলাম হোটেলে আরেকভাগ উঠলাম ডাকবাংলোয়। অবশ্য গ্রুপের সদস্যদেরকে একই হোটেল বা বাংলোয় রুম দেওয়া সম্ভব হয়নি সঙ্গত কারণেই। যেহেতু মিঠামইন উপজেলা এখনো সেই অর্থে পর্যটন গন্তব্য হিসেবে সরকার কিম্বা বড় বিনিয়োগকারীদের বিবেচনায় আসেনি তাই এখানে পর্যটনবান্ধব সুযোগ সুবিধা যেমন, বড় হোটেল, রেস্টুরেন্ট, কফিশপ ইত্যাদি গড়ে ওঠে নাই। নিকট অতীতে পর্যটন গন্তব্য হিসেবে যতটুকু পরিচিতি পেয়েছে তাতে ছোটোছোটো কিছু পর্যটনবান্ধব সুবিধার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করেছে ছোটোছোটো কিছু বিনিয়োগকারী, যেমন – ঘুরে বেড়ানোর জন্য ইজিবাইক, ভাড়া নেওয়ার জন্য মোটরসাইকেল ইত্যাদি। আশাকরি খুব শীঘ্রই মিঠামইন উপজেলা পর্যটন গন্তব্য হিসেবে সরকার ও বড় বিনিয়োগকারীদের নজরে আসবে সেদিন আমরা গিয়ে গ্রুপের সকল সদস্য একই হোটেলে থাকবো। (চলবে…)

 

আবু রায়হান সরকার
পর্যটনের সাবেক ছাত্র ও পর্যটন পেশাজীবি

Leave a Reply