জ্যোৎস্না ছড়ানো চাঁদের গল্পে তমা

Share on Facebook

পর্যটন বিষয়ক অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘পর্যটনিয়া’ পর্যটন শিল্পের নানা সমস্যা ও সম্ভাবনা তুলে ধরে আসছে নিয়মিত। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যটন বিষয়ে অধ্যয়নরত অনেক ছাত্র-ছাত্রী যথাযথ তথ্যের অভাবে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে শঙ্কিত। সুতরাং সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে পর্যটনের সাবেক ছাত্র-ছাত্রীদের ‘ক্যারিয়ার স্টোরি’ প্রকাশ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে পর্যটনিয়া। পর্যটনের বিভিন্ন খাত-উপখাত নিয়ে পড়ালেখা করে তাঁদের আজকের অবস্থান একজন ছাত্রকে হয়তো তার নিজস্ব ক্যারিয়ার গড়তে স্বপ্ন দেখাবে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সাহসী করে তুলবে। পর্যটনের সাবেক ছাত্রদের ‘ক্যারিয়ার স্টোরি’ হোক শঙ্কিত ছাত্রদের দিকনির্দেশনা আর সাহসী ছাত্রদের প্রেরণা। আমাদের এই পর্বের আয়োজন তাহসিন ইসলাম তমাকে নিয়ে। তিনি আপডেট হোটেল ম্যানেজমেন্ট ইন্সটিটিউট থেকে ফুড এন্ড বেভারেজ বিষয়ে শর্ট কোর্স করে হয়েছেন একজন উদ্যোক্তা। ‘তাহসিন আর কিচেন’ এর প্রধান কর্ণধার হিসেবে আছেন তিনি।

তাহসিন ইসলাম তমা ১৯৯৫ সালে ঢাকায় মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জন্ম রাজধানী ঢাকায় হলেও পৈত্রিক নিবাস মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুর। বাবা ছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের একজন কর্মকর্তা এবং মা গৃহিণী। বাবার চাকরির সুবাদেই মূলত তমাদের ঢাকায় বসবাস এবং বেড়ে ওঠা। তিন বোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ তমা স্বভাবে কিছুটা ডানপিটে ও আত্মপ্রত্যয়ী।

বিদেশ ভ্রমণে তমা

তিনবোন ও মা-বাবা মিলে তমাদের পাঁচ জনের ছোটো সুখের সংসারে প্রথম দমকা হাওয়া বয়ে যায় ১৯৯৭ সালে। চাকরিজীবী বাবা হঠাৎ স্ট্রোক করার পরে প্যারালাইজড হয়ে পড়েন। সুখী পরিবারে আচমকা নেমে আসে ভয়াবহতম দুঃসময়। ১৯৯৮ সালে বাবার মৃত্যুর পর তিন মেয়েকে নিয়ে অকুল পাথারে পড়ে যান গৃহিণী মা। বাবার পেনশনের সামান্য কিছু টাকার উপর ভরসা করে সংসারের হাল ধরেন তাদের মা। নিত্যকার কতো প্রয়োজনীয় উপকরণের সাথে আপোষ করে মা চেয়ে থাকেন ভবিষ্যতের দিকে! আর্থিক ও সামাজিক বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে তিন মেয়েকেই তিনি মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলতে হয়ে ওঠেন স্পর্ধিত।

২০১০ সালে সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগে এস.এস.সি পাশ করার আগে মৌচাকে অবস্থিত মনি-মুকুর স্কুলের মাধ্যমে শিক্ষা জীবনে পদার্পণ করেন তমা। ২০১২ সালে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ থেকে একই বিষয়ে এইচ.এস.সি পাশ করে ইংরেজি বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন সাউথ-ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে।

শখের বিড়াল নিয়ে তমা

২০১৪ সালে মেজ বোনের বিয়ের পর মাকে রান্নার কাজে সহযোগিতা করার দায়িত্ব এসে পড়ে তমার কাঁধে। বড় বোন সংসারে আর্থিক স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে চাকরি নিয়ে ব্যস্ত আর তমা পড়াশোনার পাশাপাশি রসুঁই ঘরে ব্যস্ত মায়ের সাথে। নিয়মিত ডাল, ভাত, মাছ, মাংস রান্নায় নুন-তেলের রসায়ন মায়ের কাছেই শেখা। একেকটা ছুটির দিনে একটু কেক অথবা একটু পিঠা বানিয়ে যেন রসনা বিলাসী হতে চান সদ্য কৈশোর পেরুনো তমা। প্রথম প্রথম স্বাদের অল্পকিছু ঘাটতি থাকলেও সময়ের ব্যবধানে পরিবারের সদস্যদের প্রশংসা কুড়িয়ে নেন তিনি। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালে মোহাম্মদপুরের “প্রিন্স বাজার” পিঠা উৎসবে ১২ রকম পিঠা নিয়ে অংশগ্রহণ করে ৭ম স্থান অধিকার করেন।

২০১৬ সাল, স্নাতক শেষ বর্ষে তমা। পড়াশোনার কিছুটা চাপ এমন সময় ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান মা। শোকস্তব্ধ তমা বড়বোনের অভিভাবকত্বে স্নাতক পড়া শেষ করেন। পিতার পরে মাতাকেও হারিয়ে দিশাহারা হওয়ার পরিবর্তে তমা হয়ে ওঠেন আত্মপ্রত্যয়ী। জীবনের ঊষালগ্ন থেকেই লড়াই করার বিবিধ শিক্ষা তিনি পেয়েছেন মায়ের কাছে। ২০১৭ সালে কয়েকজন বন্ধুর কাছে কিছু টাকা ধার নিয়ে তিনি অংশগ্রহণ করেন মোজো পিঠা উৎসবে। ২০ রকম পিঠার পসরা সাজিয়ে উৎসবে অংশগ্রহণ করে প্রশংসিত হন ব্যাপকভাবে। মোজো পিঠা উৎসব থেকেই তিনি বিভিন্ন ধরনের পিঠার অর্ডার পেতে থাকেন। এরপর একে একে রূপচাঁদা নবান্ন উৎসব, জাতীয় পিঠা উৎসব, প্রাণ নবান্ন উৎসব এবং প্রিন্স বাজার পিঠা উৎসবসহ আরও কিছু পিঠা উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৮ সালে প্রাণ প্রিমিয়াম ঘি ঐতিহ্যের ঘ্রাণ সিজন-৩ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে তিনি ২য় স্থান অধিকার করেন।

দ্বিতীয় স্থান অর্জনের পুরস্কার গ্রহণ করছেন তমা

পেশাগত উৎকর্ষতা সাধন ও পণ্যের খাদ্যগুণ বৃদ্ধির জন্য ২০১৮ সালে আপডেট হোটেল ম্যানেজমেন্ট ইন্সটিটিউট থেকে ফুড এন্ড বেভারেজ বিষয়ে শর্ট কোর্স করেন, একই সাথে মিশুক একাডেমী থেকে মোগলাই কুসিনের উপরেও শর্ট কোর্স করেন। একই বছর মিজান পাম-অলিন সেরা রন্ধন শিল্পী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে সেরা ২৪ এর একজন হন তাহসিন ইসলাম তমা। ২০১৯ সালে প্রিন্স বাজার পিঠা উৎসবে অংশ নিয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেন এরপর তিনি বিয়ের পিঁড়িতে বসেন।

প্রথম স্থান অধিকারের পুরস্কার গ্রহণ করছেন তমা

ছাত্র জীবনেই Tahshins R Kitchen নামক অনলাইন প্লাটফর্মে তমা হোমমেড ফুড ক্যাটারিং ব্যবসা স্বল্প পরিসরে চালু করেছিলেন। বর্তমানে ঘরে খাবার তৈরি ও সরবরাহের ব্যবসা করছেন তিনি। প্রতিদিন ৮০ থেকে ১০০ জনের খাবার নিজহাতে রান্না করে সরবরাহ করছেন। খাবারের মানোন্নয়ন ও স্বাদ বৈচিত্র্যময় করতে তিনি বিভিন্নরকম প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ফুড ক্যাডেট হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট থেকে লেভেল ওয়ান কমপ্লিট করে বর্তমানে বাংলাদেশ হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট ইন্সটিটিউট থেকে বেকিং কোর্স করছেন।

এটিএন বাংলার রিয়েলিটি শো মিজান পাম-অলিন সেরা রন্ধন শিল্পী ২০১৯ প্রতিযোগিতার সেরা ৪ এর একজন প্রতিযোগী তমা। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের কারণে প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত রাউন্ড আপাতত স্থগিত আছে। ব্যক্তিগত জীবনে রান্নাবান্নার পাশাপাশি দেশ-বিদেশ ঘোরাঘুরি করতেও বেশ পছন্দ করেন তিনি। ঘরে তৈরি খাদ্য সরবরাহের বর্তমান ব্যবসাটা আরও কিছুটা সম্প্রসারণ করে তিনি ভ্রমণ সংক্রান্ত ব্যবসায়ও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখেন। সেরা রন্ধন শিল্পী প্রতিযোগিতায় সুনাম অর্জন করার পাশাপাশি তাহসিন ইসলাম তমা ভ্রমণ সংক্রান্ত ব্যবসা করেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করুক পর্যটনিয়া পরিবার তা কায়মনোবাক্যে কামনা করে।

Leave a Reply