ঘুমিয়ে থাকা প্রকৃতিকে ঢেলে সাজাতে হবে

Share on Facebook

এক দিকে সীমাহীন সমুদ্রের নীল জলরাশি, আর অপর দিকে সুউচ্চ পাহাড়ে সবুজের হাতছানি। প্রকৃতির এমন মেলবন্ধন খুব কম দেশেই আছে। কক্সবাজার যেনো বাংলাদেশের পর্যটনে এক অপার সম্ভাবনাময় শহরের নাম। পৃথিবীর দীর্ঘতম নিরবচ্ছিন্ন বালুকাময় সমুদ্র সৈকতের খেতাবটাও এই শহরেরই। প্রকৃতিগত ভাবে এতো আকর্ষণ থাকার পরেও কেনো জানি ভ্রমন পিপাসুদের মনের খোরাক মিটাতে পারছে না প্রিয় শহর কক্সবাজার! তাই মাঝে মধ্যে নিজেই মনে মনে এর “কারণ ও সমাধান” খোঁজার চেষ্টা করি।

আমি ব্যাক্তিগতভাবে মনেকরি কক্সবাজার জেলা বাংলাদেশের জন্য একটি স্বর্ণের ডিম পাড়া হাঁসের মতো। যাকে কিছু অতি লোভী পর্যটন-জ্ঞানহীন ধনী ব্যবসায়ী গলা কেটে হত্যা করে একবারেই সমস্ত ডিমের মালিক বনে যাওয়ার অপচেষ্টায় মত্ত। অসাধু ব্যবসায়ীদের উন্মত্ত প্রতিযোগীতার ফলে বর্তমানে কক্সবাজার একটি আধুনিক বস্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এখানকার প্রায় প্রত্যেকটা সম্ভাবনাকে তারা এতোটাই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে যে, মানুষ এখন আর পাহাড় বা সমুদ্র দেখার জন্য কক্সবাজার যায় না, যায় মূলত একটু বিলাসী জীবন উপভোগ করার জন্য।

ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

তাই এই স্বর্ণের ডিম পারা হাসটিকে মেরে ফেলার পূর্বেই একটি সমন্বিত পর্যটক বান্ধব পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে বাঁচাতে হবে। যাতে প্রতিদিনের দেয়া সোনার ডিম বিক্রি করে দেশ এগিয়ে যেতে পারে সমৃদ্ধির দিকে। সেই লক্ষেই কিছু সুপারিশ বা আমার একান্ত ভাবনা তুলে ধরলামঃ

১. হোটেল নির্মানের ক্ষেত্রে কঠোর নীতিমালার বাস্তবায়ন জরুরী যাতে কেউ চাইলেই যেখানে সেখানে হোটেল নির্মান করতে না পারে৷

২. বিশ্বমানের থিমপার্ক ও ওয়াটার পার্ক নির্মান করতে হবে যেনো পাহাড়ের উপর দিয়ে চলা রোলার কোষ্টারের রোমাঞ্চকর অনুভূতি নেয়া বা ওয়াটার পার্কের পানিতে নির্ভয়ে নাচানাচি করার অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্যেই বারবার কক্সবাজার যেতে মন আনচান আনচান করে।

৩. স্ট্রীট সী ফুডকে কেন্দ্র করেও কক্সবাজারকে আকর্ষনের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত করা সম্ভব। তাই যত্রতত্র যাকে খুশি তাকে বীচ এলাকাতে ফুড ভেন্ডরের অনুমতি দেয়া বন্ধ করতে হবে। যারা প্রশিক্ষন প্রাপ্ত এবং সামুদ্রিক মাছ দিয়ে রকমারি মুখরোচক খাবার বানাতে পারদর্শী কেবলমাত্র তাদেরকেই অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। ভেন্ডরদের মধ্যে যারা ইংরেজি বা বিদেশি ভাষায় পারদর্শী তাদেরকে অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে। আশা করা যায়, একটা সময় দেশী বিদেশী পর্যটকরা কক্সবাজার আসবে শুধুমাত্র স্ট্রীট সী ফুড খাওয়ার লোভে। আর এর জন্য একটি জোন নির্ধারন করা থাকবে যেখানে দেশী-বিদেশী ভাষায় লাইভ গান গাইবেন দেশের নামিদামি শিল্পীরা।

৪. বাই সাইকেল প্রেমীদের কথা মাথায় রেখে মেরিন ড্রাইভে ৮/১০ ফিট চওড়া একটি বাইসাইকেল ট্রাক নির্মাণ করা যায়, যার দৈর্ঘ্য আপাতত কলাতলি মোর থেকে ইনানী বীচ পর্যন্ত হতে পারে৷ পৃথিবীতে এই ধরনের পর্যটকের অভাব নাই যারা কেবল সাইক্লিং করার জন্য বিভিন্ন সমুদ্র সৈকতে ঘুরে বেড়ায়।

৫. মেরিন ড্রাইবের এক পাশে নীল জলরাশি ও অপর পারে সুউচ্চ সবুজ পাহারের অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য কলাতলি ডলফিন মোড় থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ৪/৫ টি বগির বিশ্বমানের সকল সুবিধা সমৃদ্ধ ট্রাম বা টয়ট্রেন চালু করা যেতে পারে, যেটির কাঠামোর বেশিরভাগই হবে স্বচ্ছ কাঁচ দ্বারা নির্মিত। এই ট্রেন ভ্রমণ এতটাই রোমাঞ্চকর হবে যার টানে পর্যটকরা বার বার ফিরে যাবেন কক্সবাজারে।

৬. রাতেও প্রাণচাঞ্চল্যতা ধরে রাখার জন্য গড়ে তোলা যেতে পারে বিশ্বমানের স্টার সিনেপ্লেক্স, থিয়েটার, প্রদর্শন করা যেতে পারে বিশ্বমানের সার্কাস, এবং বিশ্বমানের ইনডোর গেমের কমপ্লেক্স যেখানে থাকবে সকল প্রকার খেলার আয়োজন।

৭. রাতে মেরির ড্রাইভে ড্রাইভিংএর  সৌন্দর্য উপভোগ করা জন্য পর্যাপ্ত পরিমানে আলো এবং নিরাপত্তার সুব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

৮. কক্সবাজার এলাকার টুরিস্ট পুলিশিকে নতুন আংগিকে সাজাতে হবে। এজন্য অন্তত বীচ এলাকায় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদেরকে হতে হবে শারিরীকভাবে ফিট এবং সুদর্শন। শুধু তাই নয়, পর্যটকের নিরাপত্তায় ব্যবহৃত সকল আধুনিক সরাঞ্জাম প্রদান করতে হবে তাদের, এবং আকর্ষণীয় দামি গাড়ি বা বাইক দিতে হবে। তাদের এমনভাবে পূর্ণগঠন করতে হবে যাতে কেউ পুলিশে চাকরি করার কথা ভাবলে প্রথম পছন্দ হয় কক্সবাজার টুরিস্ট পুলিশ।

৯. কক্সবাজার সার্কিট হাউজ থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত পাহাড়ের উপর দিয়ে ক্যাবল কারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পর্যটকরা ক্যাবল কারে করে যাবেন আর পাহাড়িদের জীবন ব্যবস্থা উপভোগ করবেন। আর এই উত্তেজনাপূর্ন অভিজ্ঞতাটা নেয়ার জন্য হয়তো অনেক পর্যটক বার বার ফিরে আসবে প্রিয় শহর কক্সবাজারে।

১০. বীচে উদ্ধার কাজে নিয়োজিত টিমকে খুব দক্ষ, প্রফেশনাল এবং তৎপর হতে হবে যাতে যেকোনো পরিস্থিতি তারা সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।

১১. বিদেশীদের জন্য একটি আলাদা বীচের ব্যবস্থা থাকলে সবচাইতে ভালো হয়। কারন তারা এসে যদি বীচে কম্ফোর্ট ফিল না করে তাহলে হাজারো আয়োজনে তাদের মন ভরানো যাবেনা।

১২. ঘোড়ার গাড়ির একটা সুব্যবস্থা রাখা যেতে পারে হিমছড়ি থেকে ইনানী সী বীচ পর্যন্ত। পর্যটকরা ক্যাবল কারে করে হিমছড়ি যাবে, সেখান থেকে ঘোড়ার গাড়িতে করে ইনানী যাবে৷

১৩. আর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, বীচ এলাকাকে সব ধরনের হকার এবং সাহায্যপ্রার্থী মূক্ত করতে হবে।

ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত থিম পার্কের ছবি

এইতো গেলো অবকাঠামোগত পরিবর্তন বা পরিবর্ধনের কিছু স্বপ্ন। তবে এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হলেই কিন্তু সুফল ভোগ করা সম্ভব হবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত কক্সবাজার পর্যটনের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ব্যাক্তিদের স্বভাব, আচার-আচরণ, চিন্তাভাবনা এবং মানসিকতায় সেবার মনোভাবের আবির্ভাবনা ঘটে! আমি ব্যাক্তিগতভাবে যতবারই এই প্রিয় জায়গাটিতে গিয়েছি, ভালোলাগায় ভেসেছি। কিন্তু এই ভালো লাগায় নুনের ছিটা তখনি লেগেছে, যখন লক্ষ করতাম এখানকার প্রতিটা মানুষ অতি মাত্রায় কমার্শিয়াল। তারা  পর্যটকদের বোকা বানানোর জন্য সারাক্ষণ সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। এটা খুবই দুঃখজনক। তারা এটা বুঝে না যে সেবা দিয়ে আরো বেশি কিছু অর্জন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে তাদের জন্য আমার কিছু ব্যাক্তিগত প্রস্তাবনা নিচে তুলে ধরলাম-

১. কক্সবাজার পর্যটন এলাকায় সেবার কাজে নিয়োজিত প্রতিটা ব্যাক্তিকে পর্যটনের উপর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতে হবে।

২. গদবাধা হারে যেকেউ চাইলেই যেকোনো এলাকায় রিক্সা, বা অটো রিক্সা চালাতে পারবে না। এর জন্য কিছু বিধিনিষেধ পালন করতে হবে। পর্যটন এলাকায় রিকশা বা অটোরিকশা চালানোর লাইসেন্স পাওয়ার আগে পর্যটকের সাথে কিভাবে কথা বলতে হবে, কি আচরণ করতে হবে, সেবার মানষিকতা কিভাবে উন্নত করা যায় এই বিষয়ক তিন মাসের শর্ট কোর্স করতে হবে। চালকদের আইডি কার্ড ও আলাদা ইউনিফর্ম বাধ্যতামূলক করতে হবে।

৩. সেবার মান বাড়ানোর জন্য খাবারের হোটেল, বা অন্যান্য দোকান মালিকদের  বাধ্যতামূলক ভাবে প্রতি বছর গুণগত মান সার্টিফিকেট নিতে হবে। এটি সেক্টর ভাগ করে প্রতিটি সেক্টরের জন্য আলাদা সার্টিফিকেট চালু করা যেতে পারে।

৪. সবচাইতে জরুরি যে বিষয়টা,  তাহলো পর্যটন এলাকার ভিতরে অটো রিক্সা বা অন্যান্য পাবলিক যানবাহনের ভাড়া নির্ধারন করে দিতে হবে যেনো নতুন কেউ এসে কোনো রকম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে না পড়ে।

হয়তো স্বপ্ন গুলো অবাস্তব মনে হচ্ছে বা কাল্পনিক। তবে পর্যটনকে বৈদেশিক মূদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস্ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে এই ধরনের কিছু মাস্টার প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করে ঘুমিয়ে থাকা প্রকৃতিকে ঢেলে সাজাতেই হবে। পাট-বস্ত্র-চামড়া জাত পন্য এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পাশাপাশি বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনে নতুন নতুন খাত চিহ্নিত করে তাদের নিয়ে কাজ করতে হবে। সেই দৃষ্টিকোন থেকে আমি মনে করি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পর্যটন শিল্প হতে পারে অপার সম্ভাবনাময় একটি খাত। শুধু একটু পরিকল্পনা আর সাজানোর অভাবে কেনো আমরা এই সুযোগ হাত ছাড়া করবো? মালদ্বীপের মত একটা ডুবন্ত দেশ শুধুমাত্র তাদের প্রকৃতিকে সাজিয়ে গুছিয়ে আজ বিশ্ব মানচিত্রে মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে। ইউরোপ আমেরিকার পর্যটন পিপাসু এমন একজন পর্যটক পাওয়া যাবে না যে মালদ্বীপ ভ্রমন করতে চায় না!

এদেশের প্রতিটা ইট, বালুকণা আমার কাছে ভালো লাগে বলেই দেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখতে খুব পছন্দ করি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট বিনীত আবেদন, আমার এই স্বপ্নগুলোকে যদি আপনাদের কাছে অবাস্তব ও অযৌক্তিক মনে হয়, তাতেও আমার কোনো আফসোস থাকবে না। তবে দয়া করে এই শিল্পটাকে বিশ্ব বাজারে তুলে ধরার জন্য প্রয়োজনীয় এবং অনুকরণীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করুন।

 

লেখকঃ এ জে রুমেল

পর্যটনের সাবেক ছাত্র

Leave a Reply