চাঁদপুরে গড়ে উঠতে পারে ইলিশ পর্যটন

Share on Facebook

ইলিশ পর্যটন নিয়ে রাশিদুল হাসান স্যারের সাথে আলাপ করছি বিগত বেশ কিছুদিন যাবত। তিনি আমাদেরকে বলছেন ইলিশ কিভাবে আমাদের পর্যটনে অবদান রাখতে পারে। ইলিশমাছ এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য। বাংলাদেশের জিডিপিতে ইলিশের অবদান ১.৫ শতাংশ আর পর্যটনের অবদান ২.৭ শতাংশ। ইলিশ আর পর্যটনের রসায়ন হলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। চাঁদপুরকে পর্যটন গন্তব্য ধরে গড়ে উঠতে পারে ইলিশ পর্যটন। ইলিশ পর্যটন নিয়ে বাস্তবভিত্তিক ধারণা পেতে আমরা পর্যটনিয়ার একটা দল স্যারের সাথে সেদিন চাঁদপুর ভ্রমণে গেলাম।

গত বৃহস্পতিবার (নভেম্বর মাসের ১ তারিখ) সকাল আটটায় সদরঘাট থেকে লঞ্চে উঠে চাঁদপুর গিয়ে পৌঁছলাম সাড়ে এগারোটায়। লঞ্চ থেকে নেমে তিনি আমাদেরকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখালেন চাঁদপুর শহর যেমন তেমন লঞ্চ টার্মিনাল এলাকা, ইলিশমাছের আড়তের চারপাশ ও ডাকাতিয়া নদীরতীর। দুপরে ইলিশমাছের ভাঁজি, ইলিশমাছের ভর্তা, বেগুন ভাঁজি আর ডাল দিয়ে গরম ভাত খেয়ে বসলাম ইলিশ পার্কে।

পার্কের গাছের ছায়ায় বসে গল্পেগল্পে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিয়ে আমাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন ইলিশ কিভাবে আমাদের পর্যটন পণ্য হতে পারে। যেমন তিনি উল্লেখ করলেন ইন্দোনেশিয়ার কথা। ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে কফি ট্যুরিজম আছে। সেখানে তারা একদিন আপনাকে নিয়ে যাবে কফি বাগান ঘুরে দেখাতে।  বাগান দেখানোর পাশাপাশি দেখাবে কফি কিভাবে সংগ্রহ করা হয়, তারপর কফি প্রসেসিং এবং সব শেষে সেই কফিগুড়া দিয়ে কফি বানিয়ে আপনাকে খাওয়াবে। একইভাবে সিঙ্গাপুরের স্কুল ছাত্রদেরকে ধান উৎপাদন পদ্ধতি সম্বন্ধে ধারণা দিতে নিয়ে যাওয়া হয় পার্শ্ববর্তী দেশ মালেয়শিয়া কিংবা ইন্দোনেশিয়ার কৃষি জমিতে। দেখানো হয় যে ধানের তারা ভাত খায় সেই ধান কিভাবে উৎপাদিত হয়। বাস্তব ভিত্তিক ধারণা দিতে এরকম কফি ট্যুরিজম বা এগ্রিকালচারাল ট্যুরিজমের প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে।

ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। বাজার থেকে ইলিশ কিনে আমরা হয়তো নিয়মিত খাইও কিন্তু ইলিশমাছ সম্বন্ধে আমাদের শিক্ষা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐ পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাস পর্যন্তই। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার উপন্যাসে লিখেছেন পদ্মায় ইলিশ মাছ ধরার মরসুম চলিয়াছে। দিবারাত্রি কোন সময়েই মাছ ধরার কামাই নাই। সন্ধ্যার সময় জাহাজঘাটে দাঁড়াইলে দেখা যায় নদীর বুকে শত শত আলো অনির্বাণ জোনাকির মত ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। জেলে-নৌকার আলো ওগুলি। ……… শেষরাত্রে ভাঙা ভাঙা মেঘে ঢাকা আকাশে ক্ষীণ চাঁদটি উঠে। জেলে-নৌকার আলোগুলি তখনো নেভে না। নৌকার খোল ভরিয়া জমিতে থাকে মৃত সাদা ইলিশ মাছ। লণ্ঠনের আলোয় মাছে আঁশ চকচক করে। মাছের নিষ্পলক চোখগুলিকে স্বচ্ছ নীলাভ মণির মত দেখায়।

আমি মনে করি আমাদের সন্তানদেরকে আমাদের জাতীয় মাছ সম্বন্ধে আরও একটু ধারণা দেয়া দরকার। আমাদের সন্তানেরা যেনো জানতে পারে ইলিশ মাছ আসে কোথা থেকে, আমরা ইলিশ কোথায় ধরা হয়, কিভাবে ধরা হয়। তারপর কিভাবে ইলিশ জেলেদের নৌকা থেকে আড়তের ব্যবসায়ীদের কাছে আসে। ইলিশ মাছ ধরতে যারা সাগরে যায় তাদের জীবনধারা সম্বন্ধেও ধারণা দেয়া যেতে পারে।

জানতে চাইলাম যত সহজে কফি বাগান বা কৃষি খামার পরিদর্শনে যাওয়া যায় তত সহজে তো সাগরে ইলিশ মাছ ধরা দেখতে যাওয়া যায় না। এটা তো ঝুকিপূর্ণ।

তিনি বললেন ইলিশ মাছ ধরা দেখতে যাওয়ার জন্য তো আর সবারই সাগরে যাওয়ার দরকার নাই। দশ বা পনের মিনিটের একটা ডকুমেন্টারি বানানো যেতে পারে। তারপর একটা অডিটোরিয়াম বা থিয়েটার হল বানিয়ে সেখানে সেটা প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আড়তের পাশেই হবে সেই হল। তাহলে হল থেকে বেড়িয়েই পর্যটকেরা আড়তে গিয়ে ইলিশ মাছ কিনতে পারবে। ঢাকায় বসে এমনি অন্য সময়ে ইলিশ মাছ কিনে খাওয়া আর এভাবে আড়তে এসে নিজ হাতে ইলিশ মাছ কিনে খাওয়ার অনুভূতির মধ্যে আকাশপাতাল পার্থক্য থাকবে। এই যে ইলিশ মাছ ধরার পদ্ধতি দেখা, মাছের আড়ত দেখা, মাছ খাওয়া মাছ কেনা এটাই হলো এক্সপেরিয়ান্স।

বললাম এমনিতেও তো চাঁদপুরে পর্যটক আসতে বা ইলিশ কিনতে কোনো বাধা নাই। তাহলে ইলিশ পর্যটন ডেভেলপ করছে না কেনো?

দেখেন, চাঁদপুর আসতে কোনো বাধা নাই আর চাঁদপুর আপনাকে ডাকছে দুটো কিন্তু ভিন্ন কথা। সারাদেশের মানুষকেই চাঁদপুরে আহ্বান করার মধ্যে দিয়েই চাঁদপুরে ইলিশ পর্যটন গড়ে তুলতে হবে। এর জন্য কিছু প্রস্তুতি থাকতে হবে। যেমন ইলিশমাছ ধরা সংক্রান্ত যে কথাগুলো বললাম একটু আগে এরকম অন্তত একটা ডকুমেন্টারি বানানো আর সেটা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা। তাহলেই চাঁদপুরে ইলিশ পর্যটন গড়ে তোলা সম্ভব। তারপর পর্যটন অবকাঠামো যেমন, হোটেল, মোটেল বা গেস্ট হাউজ ইত্যাদি ধীরে ধীরে গড়ে উঠবে।

বাংলাদেশের চাঁদপুরে গড়ে উঠুক ইলিশ পর্যটন এই আশা বুকে নিয়ে আমরা যখন ঢাকায় ফেরার লঞ্চে উঠছি তখন সুর্য পশ্চিম আকাশে ডুবুডুবু। দিবসের শেষ আলোটুকু নিঃশেষ হওয়ার আগে দেখি স্যার কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আনমনে কি যেনো ভাবছেন। চোখেমুখে কিছুটা বিষণ্ণতার ছাপ নাকি সারাদিনের ক্লান্তি! স্যারের সেই বিষণ্ণ অথবা ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আমি মনে মনে ভাবছি ভোর ছয়টা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত প্রতি আধাঘণ্টা পর পর যে শহরে লঞ্চ ভেড়ে এতো এতো লোকজন আসা যাওয়া করে সে শহর পর্যটনে পিছিয়ে থাকতে পারে না। আপনার এই বিষণ্ণ অথবা ক্লান্ত অবয়বের বিনিময়ে হলেও চাঁদপুরে ইলিশ পর্যটন গড়ে উঠবে শীঘ্রই।

Leave a Reply