জ্বালানী তেলের দাম বাড়ানোই কী একমাত্র সমাধান?

Share on Facebook

পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই সরকার গতকাল ৫ আগস্ট মধ্যরাত থেকে দেশে সকল প্রকার জ্বালানি তেলের দাম আরেক দফা বৃদ্ধি করেছে। দাম বেড়েছে প্রতি লিটার ডিজেলে ৩৪, কেরোসিনে ৩৪, অকটেনে ৪৬, পেট্রোলে ৪৪ টাকা। দাম বাড়ার পর একজন ক্রেতাকে প্রতি লিটার ডিজেল ১১৪ টাকায়, কেরোসিন ১১৪ টাকায়, অকটেন ১৩৫ টাকায় ও প্রতি লিটার পেট্রোল ১৩০ টাকায় কিনতে হবে।
আগে ভোক্তা পর্যায়ে খুচরা মূল্য ছিল প্রতি লিটার ডিজেল ৮০ টাকা, কেরোসিন ৮০ টাকা, অকটেন ৮৯ টাকা ও পেট্রোল ৮৬ টাকা। শুক্রবার রাত ১২টার পর এ দাম কার্যকর হয়েছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ জানিয়েছে, বৈশ্বিক বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ার কারণে বাংলাদেশ প্রেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি), ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডে (ইআরএল) পরিশোধিত এবং আমদানি করা ডিজেল, কেরোসিন, অকটেন ও পেট্রোলের মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে।

এর আগে গত বছরের ৪ নভেম্বর থেকে ডিজেল ও কেরোসিনের দম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৬৫ থেকে ৮০ টাকা করেছিল সরকার। তবে সে সময় অকটেন ও পেট্রোলের দাম অপরিবর্তিত রাখা হয়েছিল। তেলের দাম পুনরায় বৃদ্ধির ফলে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ের উপরে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হবে। আকস্মিকভাবে দেশে বহুল ব্যবহৃত জ্বালানি তেল ডিজেল, অকটেন ও পেট্রোলে ও দরিদ্র মানুষের জ্বালানি হিসেবে পরিচিত কেরোসিনের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে।

জ্বালানির দাম বৃদ্ধির ফলে ভোগ্যপণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম আরেকদফা বৃদ্ধি পাবে। ফলশ্রুতিতে জনদুর্ভোগ বেড়ে যাবে। আমাদের জানা যে, দেশের অধিকাংশ গণপরিবহন বিশেষ করে বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও নৌযান ডিজেল চালিত। সুতরাং ডিজেলের দাম বৃদ্ধির ফলে পুনরায় সকল প্রকার গণপরিবহণের ভাড়া বৃদ্ধি পাবে। যার প্রভাব ইতোমধ্যেই সড়কে বা মহাসড়কে পড়তে শুরু করেছে।
যাত্রী ভাড়া বৃদ্ধি করে দিয়েছে পরিবহন মালিকরা। অবশ্য ভাড়া বৃদ্ধি করা ছাড়া তাদের কোন উপায়ও নেই। দেশের প্রান্তিক জনপদের গরিব মানুষ ও চরাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষেরাই বলতে গেলে কেরোসিন তেল ব্যবহার করে। কেরোসিনের অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি খেটে খাওয়া গবীর মানুষের জীবন মানের ব্যয় বৃদ্ধি করবে। তাদের চলমান অভাব ও দুঃখ কষ্টকে অনেকাংশে বাড়িয়ে দিবে। কেরোসিন ধনিক শ্রেণীর মানুষেরা মোটেই ব্যবহার করে না বা তাদের ব্যবহার করার প্রয়োজনও পড়ে না। তাই কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধি জনদুর্ভোগ বাড়াবে।

কেরোসিনের দাম বৃদ্ধিতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবন যাপনকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে। তাছাড়া কেরোসিনের এই মূল্যবৃদ্ধি দিন আনা দিন খাওয়া গরিব শ্রেণির মানুষদের জীবনমান কে আরো নিম্নমুখী করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। যে কোন সংকটকালে কৃষিখাত দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মহামারি করোনা কালে দেশের কৃষিখাত অনেকটা ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল।

যদিও রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দেশে জ্বালানি তেলের দামসহ খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের কৃষিজপণ্য উৎপাদনে সর্বাধিক পরিমাণের ডিজেল ব্যবহার হয়ে থাকে। তাই ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধি কৃষিজপণ্যের উৎপাদন ব্যয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সেচের জন্য ব্যবহৃত অধিকাংশ যন্ত্র ডিজেল চালিত। কয়েক মাস পরেই বোরো মৌসুম। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বোরো চাষের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। এমনিতেই বর্তমানে চাল-ডালসহ নিত্যব্যবহৃত প্রতিটি দ্রব্যমূল্যের দাম নিম্ম মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। মানুষের আয় না বাড়লেও ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুণ। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি এই পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে দিতে পারে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে নিম্নআয়ের মানুষের জীবনযাপনের ব্যয় নিশ্চিতভাবেই বৃদ্ধি পাবে।

আমরা জানি করোনাকালে বহু মানুষ চাকরি হারিয়ে কর্মহীন হয়ে পড়েছে। অনেকেই পেশা বদল করেছে। তাদের কেউ কেউ আবার কৃষিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। এখন ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি দেশের বিকাশমান কৃষিখাতকে বড় ধরনের একটি সংকটের মধ্যে ফেলে দিবে। আমাদের দেশের উৎপাদনমুখী শিল্প-কারখানা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের ওপরে অনেকটা নির্ভরশীল। গ্যাসের অপ্রতুলতা বিদ্যুৎ এবং ডিজেলের উপর নির্ভরশীলতাকে অনেকাংশেই বৃদ্ধি করেছে। সুতরাং জ্বালানি তেলের এই মূল্যবৃদ্ধি বিদ্যমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মাত্রাকে অনেকাংশে বাড়িয়ে দিবে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে শিল্পপণ্যের উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাবে।

হঠাৎ এই সিদ্ধান্তের কারণ জানিয়েছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। গতরাতে জ্বালানি মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে প্রতিমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, নিরুপায় হয়েই জ্বালানির দাম কিছুটা সমন্বয়ে করতে হচ্ছে।
বিবৃতিতে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘জনবান্ধব আওয়ামী লীগ সরকার সব সময় আমজনতার স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়। যত দিন সম্ভব ছিল, তত দিন সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর চিন্তা করেনি। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকটা নিরুপায় হয়েই দাম কিছুটা সমন্বয়ে যেতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে সরকার জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে দিয়েছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সে অনুযায়ী জ্বালানি তেলের দাম পুনর্বিবেচনা করা হবে।

এর আগে রাত ১০টায় জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এখন থেকে ডিজেলের দাম হবে প্রতি লিটার ১১৪ টাকা, যা এত দিন ৮০ টাকা ছিল। কেরোসিনের দামও একই হারে বাড়ানো হয়েছে। নতুন দাম ডিজেলের সমান, অর্থাৎ ১১৪ টাকা।

বাড়ানো হয়েছে পেট্রল ও অকটেনের দামও। পেট্রলের নতুন দাম প্রতি লিটার ১৩০ টাকা, যা এত দিন ৮৬ টাকা ছিল। অকটেনের দাম ৮৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা করা হয়েছে।

দিবাগত রাত ১২টার পর থেকেই নতুন দাম কার্যকর হয়েছে।

 

 

Leave a Reply