নিউইয়র্ক টু ফ্লোরিডা ভ্রমণ দ্বিতীয় পর্ব

Share on Facebook

মায়ামী এয়ারপোর্টে নেমেই মনে হলো এটা আমেরিকা নয়, অন্যকোনো দেশে চলে এসেছি। এর আগে নিউইয়র্কের বাইরে বলতে আশেপাশের স্টেটগুলো ঘুরেছি, কিন্তু এতো দূরে তো আসা হয়নি কখনো। বাইরে বের হতেই একটা গরম বাতাসের ঝাপটা মুখে এসে লাগলো, অথচ মাত্র তিনঘন্টা আগে নিউইয়র্ক থেকে শীতে কাঁপতে কাঁপতে বিমানে উঠেছি।

মনে মনে ভাবছি, আমি আমেরিকার মধ্যেই আছি নাকি বিমান ভুল করে অন্যকোনো দেশে নামিয়ে দিলো! রাত তখন একটা বাজে, পরিচিত কাছের ছোটভাই সঞ্জয় বাইরে গাড়ী নিয়ে অপেক্ষা করছে। এয়ারপোর্ট ছাড়িয়ে সুনসান হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চললো আমাদের গাড়ী। নিউইয়র্কে যেমন রাতের বেলাতেও হাইওয়েগুলো বিজি থাকে সেরকম না, মনে হচ্ছে চোখ বেঁধে দিলেও এই রাস্তায় গাড়ী চালানো সম্ভব। রাতের বেলা হলেও রাস্তার দু’পাশে গাছের সারি আর ঝোপঝাড়ের অবয়বে অনুমান করছি দিনের আলোয় তারা অপরুপ সুন্দর হবে। নিউইয়র্কের গাছগুলো এখন সব পাতা ঝরে মরাগাছের মতো হয়ে গেছে, অথচ এখানে তাদের যৌবন আবছা অন্ধকারেও পরিস্কার দেখা যাচ্ছে।

আধাঘন্টার মতো চলার পর একটা খুব ছিমছাম সুন্দর অথচ নিরব অপরূপ জায়গায় এসে গাড়ী দাড়ালো। রাতের নিরবতায় পুরো এলাকাটা মনে হচ্ছে একটা রূপবতি ঘুমন্ত রাজকুমারী। এখানেই সঞ্জয়ের বাড়ী। বেশীরভাগ বাড়ীই এখানে একতলা তবে সঞ্জয়ের বাড়ীটি দোতলা। নিউইয়র্কে রাতদুপুরেও আমরা নির্দ্বিধায় হৈচৈ করি কিন্তু এখানে এসে আপনা আপনিই ফিসফিস করে কথা বলা শুরু করলাম। একটু জোরে কথা বললেই রাতের নিস্তব্ধতায় সেই আওয়াজ বাঘের হুংকারের মতো মনে হচ্ছে।

সঞ্জয়ের স্ত্রী লাবণী ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে টেবিলে খাবার সাজিয়ে নিয়ে বসে আছে, মেয়েটার সম্ভবত রাত জাগার অভ্যাস নেই। আমরা নিউইয়র্কের মানুষ অনেকেই নিশাচর, আমাদের কাছে রাতজাগা কোনো ব্যাপারই না। টেবিলে অনেক রকমের খাবার সাজানো। বিমানঅলারা খেতে দেয়নি, সেই রাগ অনেকটাই এই খাবারগুলোর উপর দিয়ে ঝাড়লাম। বিছানায় যেতে যেতে রাত তিনটা বেজে গেলো।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই চোখ ছানাবড়া ! এ আমি কোথায় এলাম! বাংলাদেশে না তো ! চারিদিকে সবুজ আর সবুজ, গাছে গাছে আমের মুকুল, পাশেই কিছু নারিকেল গাছ, সেই গাছ ভর্তি নারকেল। একটু দুরেই সজিনা গাছ, অনেক ফুল এসেছে। লিচুগাছ, জামগাছ, আতাগাছ, কলাবাগান, পেঁপেগাছ সব বাড়ীটাকে ঘিরে রেখেছে। পাখির কিঁচির মিচির, ঘুঘু পাখীর ডাক, বসন্তের সকালের ঝিঁরি ঝিঁরি প্রাণ জুড়ানো হাওয়া ! ফেব্রুয়ারী মাস, এখন তো উইনটার, তাহলে এমন লাগছে কেনো! বুঝলাম এটাই ফ্লোরিডা, সারা বছর নাকি এরকমই আবহাওয়া। বাংলাদেশ বাংলাদেশ ভাব আছে। আসেপাশের বাড়ীর দেয়ালগুলোতে কিছু দেয়াল লিখন শ্লোগান; কিছু পোস্টার সেটে দিলে, রাস্তায় কিছু নোংরা আবর্জনা আর রাস্তার পাশে কিছু রিকশা দাড় করিয়ে দিলেই পুরোপুরি বাংলাদেশ।

কাকীমা ( সঞ্জয়ের মা) সকালের নাশতার টেবিলে ডাক দিলো। আহা ! গরম গরম লুচি, বাধাকপি ভাজি, ঘন ডাল আর মিষ্টি। অমৃত মনে হলো। কতদিন পরে এরকম পরিবেশে এরকম খাবার! সেই স্কুল-কলেজ জীবনের কথা মনে পড়ে গেলো।

নাশতা সেরে ছুটলাম TURO এ্যাপস থেকে ভাড়া করে নেওয়া গাড়ী পিকআপ করতে। যদিও এখানে সবার বাড়ীতেই দুইতিনটা গাড়ী প্রায় পড়েই থাকে তবুও নিজের স্বাধীনতা বলে একটা কথা। TURO কোম্পানি অনেকটা AirBnB এর মতো, আপনার পার্সোনাল গাড়ী এদের মাধ্যমে ভাড়া দিতে পারেন। গাড়ীর মালিক স্প্যানিশ মহিলা খুবই অমায়িক, ২০২২ মডেলের নতুন গাড়ীটির চাবি আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন “এনজয় ইওর ট্রিপ”। মাত্র ৪০০ ডলারে ফুল কভারেজ ইন্স্যুরেন্সসহ ৬ দিনের জন্য গাড়ীটি আমার। পরিস্কার ঝকঝকে গাড়ী, দারুণ একটা পারফিউমের গন্ধ গাড়ীর ভিতরে।

এবার গন্তব্য সেন্ট পোর্ট লুসি, মায়ামির কাছেই একটা ছোট্ট শহর। ১০০ মাইল মতো হবে। ওখানে তাহিরা থাকে, আমাদের ABCH গ্রুপের সদস্যা, আমার জেলাতেই বাড়ি, এলাকার ছোট বোন। অনেকদিন ধরেই অনুরোধ করে, ভাইয়া আমার বাড়িতে বেড়াতে আসেন।

রাস্তায় স্পীড লিমিট নির্দেশ করা আছে ৭০ মাইল কিন্তু প্রায় সব গাড়ীর স্পীডই দেখি ৮০ মাইলের উপরে। সবার সাথে তাল মিলিয়ে আমিও ৮০ মাইল গতিতে যাচ্ছি। রাস্তার দু’পাশের দৃশ্যগুলো মনোরম। সারিসারি বিভিন্ন প্রজাতির পামগাছ। কমলার ক্ষেত, আঙুর ক্ষেত, ভুট্টা ক্ষেতসহ বিভিন্ন গাছের বাগান। সবুজের বুক চিরে ছুটে চলা। ঝকঝকে মিষ্টি রোদ মনে করিয়ে দিচ্ছে এই স্টেটের আরেক নাম হলো সানসাইন স্টেট। গাড়ীর ব্লুটুথে আমার ফোন কানেক্ট করে দিয়েছি, রবীন্দ্র সংগীত বেজে চলেছে “গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ, আমার মন ভোলায় রে..”। ক্ষণিকের জন্য নস্টালজিক হয়ে গেছি, এতো ভালো লাগছে কেনো ! আনন্দে চোখে পানি চলে আসার মতো অবস্থা। দুপুরের পরপরই পৌছে গেলাম তাহিরার বাসায়। সেন্ট পোর্ট লুসি, অনিন্দ্য সুন্দর একটি জনপদ। পরের পর্বে বলবো। (চলবে)

মো. তরিকুল ইসলাম মিঠু
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

 প্রথম পর্ব

Leave a Reply