ডিম পাড়তে এসে বেওয়ারিশ কুকুরের হাতে মারা পরছে মা কচ্ছপ

Share on Facebook

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের চতুর্দিকে সৈকতে বিচরণ করে ১০ হাজারের বেশি বেওয়ারিশ কুকুর। ডিম পাড়তে উঠলেই মা কচ্ছপের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সংঘবদ্ধ কুকুর।

দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে কয়েক বছর আগেও ডিম পাড়ার জন্য গভীর সমুদ্র থেকে ছুটে আসত শত শত মা কচ্ছপ। শামুক-ঝিনুকে ভরপুর দ্বীপের নির্জন সৈকতে ডিম পেড়ে সেই কচ্ছপ পুনরায় গভীর সাগরে ফিরে যেত। এখন সে সুযোগ নেই। দ্বীপে ডিম পাড়তে এসে মারা পড়ছে অসংখ্য কচ্ছপ। জোয়ারের পানিতে সেই মরা কচ্ছপ ভেসে আসছে উপকূলে।

দ্বীপের তিন দিকে পুঁতে রাখা হয় মরণফাঁদ খ্যাত মাছ ধরার জাল। গভীর সাগরে ট্রলিং জালে আটকা পড়েও মারা যাচ্ছে মা কচ্ছপ। আবার মরণফাঁদ (জাল) ডিঙিয়ে কিছু কচ্ছপ সৈকতে এসে ডিম পাড়তে পারলেও সেই ডিম রক্ষা করা যাচ্ছে না। ডিমগুলো খেয়ে ফেলছে কুকুর। দ্বীপের চতুর্দিকে সৈকতে বিচরণ করে ১০ হাজারের বেশি বেওয়ারিশ কুকুর। ডিম পাড়তে উঠলেই মা কচ্ছপের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সংঘবদ্ধ কুকুর। কিছু লোক আছেন, যাঁরা কচ্ছপের ডিম চুরি করে পাচার করছেন মিয়ানমারে। সৈকতজুড়ে পর্যটকসহ বিপুল মানুষের কোলাহল, হইচই, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক (টমটম) ও মোটরসাইকেলের দৌড়ঝাঁপ আর বৈদ্যুতিক বাতির ঝলকানিতে বেহাল মা কচ্ছপের।

পরিবেশ অধিদপ্তর সেন্ট মার্টিন কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আজহারুল ইসলাম বলেন, গত তিন দিনে ১০-১২টি মরা কচ্ছপ ভেসে আসার খবর পাওয়া গেছে। কচ্ছপগুলো কুকুর খেয়ে ফেলেছে। কচ্ছপ রক্ষা করতে হলে বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, ইউনিয়নের লোকসংখ্যা ১০ হাজার, কিন্তু দ্বীপে বেওয়ারিশ কুকুর আছে ১২ হাজারের বেশি। নিষেধাজ্ঞার কারণে কুকুর নিধন সম্ভব হচ্ছে না। কুকুরের জন্য পর্যটকসহ সাধারণ মানুষ হাঁটাচলা করতে পারছে না। ডিম পাড়তে আসা কচ্ছপের পাশাপাশি অভুক্ত কুকুরগুলো মানুষের ছাগল, হাঁস, মুরগি, মাছও খেয়ে ফেলছে।

সৈকতজুড়ে মরা কচ্ছপ
৯ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টা। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের আরেক প্রতিবেশ সংকটাপন্ন দ্বীপ ছেঁড়াদিয়ার পশ্চিম অংশের সৈকতে ভেসে আসে ৫০ কেজি ওজনের একটি অলিভ রিডলে (জলপাই রং) প্রজাতির মা কচ্ছপ। কচ্ছপটির মুখ ও হাতে আঘাতের চিহ্ন। ঢাকা থেকে ভ্রমণে আসা কয়েকজন পর্যটক কচ্ছপটি ঘিরে ছবি তুলছিলেন। দলের এক সদস্য সরদার আবদুল মতিন বলেন, নির্জন ছেঁড়াদিয়াতেও ডিম পাড়তে পারছে না মা কচ্ছপ। সম্ভবত কচ্ছপটিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

ছেঁড়াদিয়ার দক্ষিণ ও পূর্ব অংশের সৈকতে পড়ে আছে আরও দুটি মরা কচ্ছপের দেহাবশেষ। শরীরের বেশির ভাগ অংশ কুকুর খেয়ে ফেলেছে। পর্যটক ছাড়া সেখানে মরা কচ্ছপের অবস্থা দেখার সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কেউ নেই।

দ্বীপে ভ্রমণে আসা কক্সবাজারের ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম বলেন, তিনিও গতকাল ছেঁড়াদিয়া, দিয়ারমাথা, গলাচিপা এবং সেন্ট মার্টিনের পশ্চিম সৈকতে পাঁচটি মরা কচ্ছপ দেখতে পান। কুকুরের দল মরা কচ্ছপগুলো নিয়ে টানাটানি করছে। কচ্ছপ থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে।

সেন্ট মার্টিনের উত্তরপাড়ার মৎস্য ব্যবসায়ী জমির হোসেন বলেন, গত তিন দিনে তিনি দ্বীপের পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ সৈকতে ১২টির মতো মরা কচ্ছপ ভেসে আসতে দেখেছেন। কুকুরের দল কচ্ছপগুলো খেয়ে ফেলছে। দুর্গন্ধ ছড়াবে বলে কিছু কচ্ছপ স্থানীয় লোকজন বালুতে পুঁতে ফেলেছেন।

মৎস্য ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা
পরিবেশ অধিদপ্তরের স্বেচ্ছাসেবী ও দ্বীপের উত্তরপাড়ার বাসিন্দা আবদুল হামিদ বলেন, গত ৮ ফেব্রুয়ারি উত্তর সৈকত দিয়ে দুটি মরা কচ্ছপ ভেসে এসেছিল। কচ্ছপ দুটির মুখে আঘাতের চিহ্ন ছিল। কিছু কচ্ছপ ডিম পেড়ে চলে গেলেও কুকুরের দল বালুর নিচ থেকে ডিম তুলে খেয়ে ফেলছে। তাড়াতে গেলে কুকুরের আক্রমণের শিকার হতে হয়।

সৈকতে কত কচ্ছপের মৃত্যু হয়েছে এ তথ্য পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে নেই। নেই কত ডিম চুরি কিংবা কুকুর খেয়েছে তার তথ্যও। এ প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তর সেন্ট মার্টিন কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘এই কয়েক দিনে আমরা সৈকত থেকে পাঁচ শতাধিক কচ্ছপের ডিম সংগ্রহ করে একটি হ্যাচারিতে বালুচাপা দিয়ে রেখেছি। মাসখানেক পর ডিম থেকে বাচ্চা বেরোবে। ডিম সংগ্রহের জন্য চারজন কর্মী নিয়োজিত থাকলেও কুকুরের জন্য কিছুই করা যাচ্ছে না।’

সচেতন নন জেলেরা
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ঘুরে এসে পরিবেশবাদী সংগঠন ‘কক্সবাজার বন ও পরিষদ সংরক্ষণ পরিষদ সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, প্রতিদিন গড়ে ১০টি করে মরা কচ্ছপ ভেসে আসছে দ্বীপে। প্রতিটি কচ্ছপের পেটে ডিম থাকে। ৯০ শতাংশ কচ্ছপের শরীরে আঘাতের চিহ্ন যাওয়া যাচ্ছে। সাগরে পুঁতে রাখা মাছ ধরার জালে আটকা পড়লে জেলেরা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে কিংবা ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে কচ্ছপকে হত্যা করে সমুদ্রে নিক্ষেপ করেন। জোয়ারের পানিতে কচ্ছপগুলো উপকূলে ভেসে এলে কুকুর খেয়ে ফেলে। গত পাঁচ বছরে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ডিম পাড়তে এসে অন্তত দুই হাজার মা কচ্ছপের মৃত্যু হয়েছে।

৯০ শতাংশ কচ্ছপ অলিভ রিডলে প্রজাতির জানিতে দীপক শর্মা বলেন, ৫০-৬০ কেজি ওজনের একেকটি অলিভ রিডলে ৬০-২২০টি পর্যন্ত ডিম দিতে পারে। এই কচ্ছপ স্বাভাবিকভাবে ৫০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। পুরুষ কচ্ছপ সৈকতে থাকে না, শুধু ডিম পাড়ার জন্য মা কচ্ছপ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সৈকতে আসে। দীর্ঘপথ সাঁতার কেটে আসতে আসতে প্রায় দুর্বল হয়ে পড়া গর্ভবতী মা কচ্ছপগুলো যখন ফাঁদ জালে আটকা পড়ে কিংবা কুকুরের আক্রমণের শিকার হয়, তখন করার কিছুই থাকে না নিরীহ এই প্রাণীর।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, দ্বীপে মাছ ধরার তিন শতাধিক নৌকা রয়েছে। নৌকার জেলেদের বলা আছে জালে কচ্ছপ আটকা পড়লে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বরগুনা, খুলনা, বরিশাল এলাকার ট্রলারের জেলে এ ক্ষেত্রে অসচেতন।

মৎস্য ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, জালে আটকা পড়ার পর কচ্ছপ সর্বোচ্চ দু-তিন ঘণ্টা জীবিত থাকতে পারে। কিন্তু জেলেরা পিটিয়ে মা কচ্ছপ হত্যা করে সাগরে নিক্ষেপ করছেন। কচ্ছপ সমুদ্রের ময়লা-আবর্জনা খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। তাদের বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব সবার।

Leave a Reply