জ্যোৎস্না ছড়ানো চাঁদের গল্পে শারমীন
Tweet
পর্যটন বিষয়ক অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘পর্যটনিয়া’ পর্যটন শিল্পের নানা সমস্যা ও সম্ভাবনা তুলে ধরে আসছে নিয়মিত। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যটন বিষয়ে অধ্যয়নরত অনেক ছাত্র-ছাত্রী যথাযথ তথ্যের অভাবে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে শঙ্কিত। সুতরাং সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে পর্যটনের সাবেক ছাত্র-ছাত্রীদের ‘ক্যারিয়ার স্টোরি’ প্রকাশ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে পর্যটনিয়া। পর্যটনের বিভিন্ন খাত-উপখাত নিয়ে পড়ালেখা করে তাঁদের আজকের অবস্থান একজন ছাত্রকে হয়তো তার নিজস্ব ক্যারিয়ার গড়তে স্বপ্ন দেখাবে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সাহসী করে তুলবে। পর্যটনের সাবেক ছাত্রদের ‘ক্যারিয়ার স্টোরি’ হোক শঙ্কিত ছাত্রদের দিকনির্দেশনা আর সাহসী ছাত্রদের প্রেরণা। আমাদের এই পর্বের আয়োজন রন্ধন শিল্পী শারমীন ইসলামকে নিয়ে। তিনি টনি খান কালিনারি ইন্সটিটিউট এন্ড হোটেল ম্যানেজমেন্ট থেকে ফুড এন্ড বেভারেজ বিষয়ে বেকিং এন্ড কুকিং কোর্স সম্পন্ন করে হয়েছেন একজন নারী উদ্যোক্তা। ‘বিসমিল্লাহ কিচেন’ এর প্রধান কর্ণধার হিসেবে আছেন তিনি।
শারমীন ইসলামের জন্ম চট্রগ্রামের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে। পরবর্তীতে বাবার ব্যবসার সুবাদে ঢাকাতেই স্থায়ী বসবাস। একমাত্র ফুপু চাকরি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হলেও বাবার মতো চাচারাও ঢাকাতেই গড়েছেন ব্যবসা ও স্থায়ী আবাস। ছোটভাই সানাউল ইসলাম সানী “এ লেভেল“ পাস করে পড়াশুনার পাশাপাশি ব্যবসা শুরু করে ধরে রেখেছেন ব্যবসায়ী পরিবারের পরম্পরা। দুই ভাই-বোনের মধ্যে শারমীনই বড়।
ওয়ারীর “সিলভারডেইল” স্কুলে নার্সারি ক্লাসে ভর্তির মাধ্যমে শারমীনের শিক্ষা জীবনের শুরু। ২০০১ সালে মাধ্যমিক এবং ২০০৩ সালে শেরে বাংলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ভর্তি হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। পড়াশোনার প্রতি ব্যাক্তিগত বিশেষ নিবেদন থাকা স্বত্বেও বাবা-মায়ের পছন্দের পাত্রের সাথে বসেন বিয়ের পিড়িতে। স্নাতক আর সংসার একসাথে শুরু।
দাম্পত্য জীবনের দু’তিন বছরের মাথায় ঘর আলোকিত করে সুমিষ্ট দু’কন্যার শুভাগমন। সংসারের নিত্যকার কাজকর্ম আর সন্তানদের সেবাযত্ন নিয়ে ব্যস্ততা যতো বাড়তে থাকে পড়াশোনার সাথে বিচ্ছেদ যেন ততোই অনিবার্য হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে পড়াশোনা করে নিজের ক্যারিয়ার গঠনের স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে নিমগ্ন হয়ে পড়েন স্বীয় সংসার নিয়েই। শ্বশুরবাড়িতে একান্নবর্তী পরিবারে স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর, ননদ, জা সবাইকে নিয়ে সুখে থাকতেই যেন শারমীনের অধিক তৃপ্তি।
মা ও নানী পুরান ঢাকার বাসিন্দা হওয়ায় ছোটো বেলা থেকেই শারমীন বিভিন্ন পদের বাহারি খাবারের পরিচিত। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বাহারি বিভিন্ন পদের রান্না করে সবাইকে খাওয়ায়ে নিজে তৃপ্তি পেতেন শারমীন। শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়স্বজনদের প্রশংসা কুড়িয়ে নিতেন। এভাবেই সংসারের মায়াজালে আটকে পড়ে প্রশংসার আড়ালে ঢাকা পড়তে থাকে শারমীনের স্বতন্ত্র সত্তা। নিজেকে বিলীন করে দিয়ে শারমীন নিজেকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছেন সংসারের সদস্যদের মাঝে। শ্বশুর বাড়ির লোকদের প্রশংসার মাঝে নিজেকে খুঁজে পেতে চেয়েছেন তিনি। ছোট্ট দুটো মেয়ে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, মেয়ে দুটোর মাঝে নিজেকে খুঁজে পেতে চান শারমীন। ব্যাক্তিগত চাওয়া পাওয়ার হিসেবের ঊর্ধ্বে উঠে সংসারকে ভালবেসেই এগিয়ে যাচ্ছেন সংসারকে বহন করে। বাঙালী সমাজে বিয়ের পর বাঙালী মেয়েদের সাধারণত এইতো পরিনতি।
খৃষ্টীয় ২০১৯ সাল। পবিত্র রমজান মাস। শারমীনের জীবনে নেমে হঠাৎ করেই নেমে আসে নিস্তব্ধ সন্ধ্যা। বিবাহ-বিচ্ছেদ | যে সংসারের জন্য তিনি নিজের ক্যারিয়ারের স্বপ্ন দিলেন বিসর্জন, যে সংসারের প্রত্যেকটি মানুষকে করে নিয়েছিলেন নিজের চেয়েও আপন সেই সংসারের সাথেই ঘটে গেল বিচ্ছেদ। নিরবে একফোঁটা অশ্রুজল নেমে গেল শারমীনের গাল বেয়ে নিচে। জীবনের সোনালী সময় অতিক্রম করে এসে তিনি এখন কী করবেন! পিতা-মাতার বোঝা হয়ে বাপের বাড়িতে থাকবেন নাকি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য নিজে কিছু করবেন?
চুড়ান্তভাবে ভেঙে পড়ার আগে শারমীন নিজের দিকে নিজে তাকালেন নিবিড় যত্নসহকারে। সময় বড়ই অসময়। এই অবেলায় নিজের এমন কোন শক্তির উপর ভ’র করে তিনি দেখবেন স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার স্বপ্ন। অবচেতন মন যেন নিজেই নিজেকে জানিয়ে দিলো রান্নাই তার একমাত্র শক্তি। তৎক্ষনাৎ তিনি যোগাযোগ করলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শেফ টনি খানের সাথে। বিস্তারিত শুনে তিনি শারমীনকে রন্ধন শিল্পীই হতে পরামর্শ দিলেন। স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার গল্পের শুরু এখান থেকেই। যদিও জীবন এখন গেঁথে গেছে হাঁটু পরিমাণ কাদাপানিতে। শারমীন নামের হবু একজন রন্ধন শিল্পী কি হতে পারবেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের বিখ্যাত সেই শিল্পকর্মের গাড়িয়ালের মতো! শারমীন কি পারবেন তার জীবন গাড়িকে কাদা থেকে ঠেলে উপরে তুলতে? এরকম আরও কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন ও দুই কন্যাকে নিয়ে সংগ্রাম শুরু।
মাত্র এক বছরের ব্যবধানে শারমীন আজ দেশ সেরা রন্ধন শিল্পীদের অন্যতম। তার প্রতিষ্ঠিত বিসমিল্লাহ্ কিচেন বিভিন্ন স্কুল, কলেজসহ অফিস আদালতে এমনকি পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত খাদ্য সরবরাহ করে আসছে সুনামের সাথে। এছাড়াও তিনি ২০২০ সালের শুরুতে “অনন্যা কনটেস্টে” এ সারা দেশের ৪০০ জন প্রতিযোগীর মধ্যে সেরা ৯ তম স্থান অধিকার করে নেন। শেফ কোর্সে ভর্তির পর থেকেই দেশের অন্যতম সেরা পাঁচ তারকা হোটেল লা-মেরিডিয়ানে খণ্ডকালীন চাকরি পান যা তার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়। তিনি বর্তমানে দেশের পর্যটন পেশাজীবিদের সংগঠন বিটিইএ’র উইমেন্স স্ট্যান্ডিং কমিটির ইসি অপারেশন পদে দ্বায়িত্ব পালন করে সাংগঠনিক দক্ষতার স্বাক্ষর রাখছেন।
টনি খানের দেওয়া হাতে কলমে শিক্ষা আর নিজের অভিজ্ঞতা ও একাগ্রতার সংমিশ্রণে শারমীন জীবনের নীল অন্তরীক্ষে মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়তে শিখেছেন। ভয়কে জয় করে বহু ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে পেরিয়ে এসেছেন চড়াই উৎরাই। প্রাইভেট কারে চলাফেরা করার দীর্ঘদিনের অভ্যাসের সাথে আপোষ করে রিকশা, সিনএজি এমনকি বাসেও চড়েছেন প্রয়োজনের তাগিদে। চারপাশের নেতিবাচক প্রস্তাব উপেক্ষা করে জীবনযুদ্ধে লড়াই চালিয়ে চালিয়ে যাওয়া শারমীন ইতোমধ্যেই হয়ে উঠেছেন মূর্তিমান একজন ফিল্ড মার্শাল। শারমীন ইসলামের স্বপ্নের আকাশ অনেক বড়। নিজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি তিনি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মন্ত্র ছড়িয়ে দিতে চান শত সহস্র নারীর মধ্যে। লড়াকু শারমীনের আলোয় আলোকিত হোক অগণিত নারীগণ পর্যটনিয়া পরিবারও সেই প্রত্যাশা করে।
One thought on “জ্যোৎস্না ছড়ানো চাঁদের গল্পে শারমীন”
Leave a Reply to Jeny Jahan Cancel reply
You must be logged in to post a comment.
Wish u all the best, Sharmin.
Build up ur cartier strongly.
Stay fine.