হালাল পর্যটন এবং বাংলাদেশ | পর্ব- এক

Share on Facebook

বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম এবং দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক খাতগুলোর মধ্যে পর্যটন অন্যতম। পর্যটন শিল্পের নতুন ধারাগুলির মধ্যে হালাল পর্যটন অত্যন্ত সম্ভাবনাময় পর্যটন খাত।

২০১৯ সালে বৈশ্বিক পর্যটন শিল্পে হালাল পর্যটনের অবদান ছিল ১৩শতাংশ। বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ সংক্রমণের ফলে ২০২০-২১ সালে সারা বিশ্ব প্রায় গৃহবন্দী হয়ে পড়ে। ফলে পর্যটন শিল্পে ধ্বস নামে। ২০২০সালে মুসলিম পর্যটকরা ব্যয় করেছিল ১৯২বিলিয়ন ডলার, যা ২০১৭ সালের তুলনায় প্রায় ১২৬ বিলিয়ন ডলার বেশী।

কোভিড পরবর্তী সময়ে পর্যটন শিল্প দ্রুত গতিতে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। চলতি ২০২২সালে হালাল পর্যটনের বৈশ্বিক বাজারের আকার ২৫৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নির্ভরযোগ্য বাজার গবেষণা সংস্থাসমূহের হিসেব গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী গড়ে ৪% হারে বৃদ্ধি পেয়ে ২০৩২সাল নাগাদ হালাল পর্যটন বাজারের আকার হবে ৩৬৫বিলিয়ন ডলার।

সীমাবদ্ধতার সীমারেখা অতিক্রম করে পর্যটনের চরিত্র বহুমুখীনতা অর্জন করেছে। পর্যটন শিল্পের যে নতুন ধারাগুলো সম্প্রতি জনপ্রিয় এবং টেকসই হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে ‘হালাল ট্যুরিজম’তাদের অন্যতম। শুধু মুসলিম দেশগুলো নয়, হালাল ট্যুরিজমের ক্রমবর্ধমান বাজারে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোও হালাল পর্যটন গন্তব্য হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে এসেছে, ব্রান্ডিং করছে।

হালাল পর্যটন একটি ধর্মবিশ্বাস ভিত্তিক পর্যটন ধারা বা শাখা। হালাল পর্যটন অপেক্ষাকৃত নতুন ধারণা হলেও টেকসইগুণ, জনপ্রিয়তা এবং ক্রমবর্ধমান বাজার চরিত্র এই ধারাটিকে পর্যটনের অন্যতম প্রধান ও সম্প্রসারণশীর সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিচ্ছে।
ইসলামে পর্যটনকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহর নির্দশনকে জানার জন্য, অনুভব করার জন্য পর্যটনকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছে। পবিত্র ধর্মগ্রন্থে সুস্পষ্ঠভাবে পর্যটনের পক্ষে বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ”(হে রাসূল) আপনি বলুন, তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ, কিভাবে তিনি সৃষ্টিকর্ম শুরু করেছেন। অতঃপর আল্লাহ পুর্নবার সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু করতে সক্ষ “ (সুরা আনকাবুত, ২০)। ”তোমাদের আগে অতীত হয়েছে অনেক ধরনের জীবনাচরণ। তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ যারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে তাদের পরিণতি কি হয়েছে। এই হলো মানুষের জন্য বর্ণনা। আর যারা ভয় করে তাদের জন্য উপদেশবাণী” (সুরা আল ইমরান, ১৩৭-৩৮)। ‘তোমাদের পূর্বে বহু বিধান-ব্যবস্থা গত হয়েছে, সুতরাং তোমরা পৃথিবী ভ্রমণ করো এবং দেখো মিথ্যাশ্রয়ীদের কী পরিণাম!’ (সুরা-৩ আল- ইমরান, আয়াত: ১৩৭)। “তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করো এবং দেখো তোমাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কী হয়েছে’! তাদের অধিকাংশই ছিল মুশরিক।’ (সুরা-৩০ রুম, আয়াত- ৪২)। নিঃসন্দেহে রাত্রি ও দিবসের পরিবর্তনের মধ্যে এবং আল্লাহ যা কিছু আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছেন, তার মধ্যে সাবধানী সম্প্রদায়ের জন্য বহু নিদর্শন রয়েছে” (সুরা ইউনুস, আয়াত ৬)।

ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে সামর্থ্য অনুযায়ী সফর করা ও ভ্রমণ করা উচিত। কারণ পবিত্রগ্রন্থ কোরআনে আরও বলা হয়েছে, ‘তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করো, অতঃপর দেখো, যারা সত্যকে অস্বীকার করেছে তাদের পরিণাম কী হয়েছিল!’ (সুরা-৬ আনআম, আয়াত: ১১)। ‘সুতরাং পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করো এবং দেখো, যারা সত্যকে মিথ্যা বলেছে তাদের পরিণাম কী হয়েছে?” (সুরা-১৬ নাহল, আয়াত: ৩৬)। ‘পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করো এবং দেখো, অপরাধীদের পরিণাম কীরূপ হয়েছে।’ (সুরা-২৭ নমল, আয়াত: ৬৯)। ‘এরা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না? করলে দেখত এদের পূর্ববর্তীদের কী পরিণাম হয়েছিল। পৃথিবীতে তারা ছিল এদের অপেক্ষা শক্তিতে ও কীর্তিতে প্রবলতর। অতঃপর আল্লাহ তাদের শাস্তি দিয়েছিলেন তাদের অপরাধের জন্য এবং আল্লাহর শাস্তি হতে তাদিগকে রক্ষা করার কেউ ছিল না।’ (সুরা-৪০ মুমিন, আয়াত: ২১)। “নিশ্চয় আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে বিশ্বাসীদের জন্য বহু নিদর্শন রয়েছে” (আল-জাসিয়া, আয়াত-৩)। “আর আসমানসমূহ ও যমীনে কত নিদর্শন রয়েছে, যা তারা অতিক্রম করে চলে যায়, অথচ সেগুলো থেকে তারা বিমুখ” (সুরা ইউসুফের, আয়াত- ১০৫)। “তুমি কি দেখনি যে, নৌযানগুলো আল্লাহর অনুগ্রহে সমুদ্রে চলাচল করে, যাতে তিনি তাঁর কিছু নিদর্শন তোমাদের দেখাতে পারেন। নিশ্চয় এতে প্রত্যেক ধৈর্যশীল, কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে” (সুরা লুকমান, আয়ত- ৩১) । “তারা কি যমীনে ভ্ৰমণ করেনি? তাহলে তারা জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন হৃদয় ও শ্রুতিশক্তিসম্পন্ন শ্রবণের অধিকারী হতে পারত। বস্তুত চোখ তো অন্ধ নয়, বরং অন্ধ হচ্ছে বুকের মধ্যে অবস্থিত হৃদয়” (সুরা আল-হজ্জ, আয়যাত-৪৬)। অর্থাৎ ধর্মের বিধি-বিধান মেনে পর্যটনের ক্ষেত্রে ইসলামের কোনো বাঁধা নেই। বরঞ্চ ইসলাম পর্যটনে উৎসাহিত করে, আহ্বান করে।

ধর্মানুরাগী মুসলিম পর্যটক, যারা ইসলাম ধর্মের প্রযোজ্য নিয়ম-নীতি মেনে পর্যটনে আগ্রহী তাদের বিশ্বাস-ভিত্তিক চাহিদা পূরণ করে প্রদত্ত পর্যটন সেবাকেই মূলত হালাল পর্যটন বলে। মুসলিম পর্যটক বান্ধব পর্যটনসেবার নাম ও গুণগত চরিত্র স্থানভেদে পরিবর্তিত হতে পারে, যেমন: হালাল পর্যটনকে মুসলিম সফর/মুসলিম-বান্ধব সফর, হালাল /হালাল-বান্ধব সফর/পর্যটন, ইসলামিক শরীয়াহভিত্তিক পর্যটন বা জিয়ারাহ পর্যটন।

হালাল পর্যটনে ইসলাম তথা শরীয়াভিত্তিক বিধিনিষেধকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করে বাসস্থান/আবাসন, খাদ্য, পরিবহন. স্বাস্থ্যসেবা, পরিবেশ/আবহসহ সকল সেবা ও কার্যক্রমে ইসলামী সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। যেমন পর্যটন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো হালাল পর্যটনের জন্য অনেক ক্ষেত্রে হালাল ফ্লাইটের বন্দোবস্ত করে। হালাল ফ্লাইটে মদ. শুকরের মাংসসহ ইসলামে নিষিদ্ধ খাবার পরিবেশন করা হয় না। নামাজ আদায়ের বন্দোবস্ত থাকে। সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে শরীয়ার বিধিবিধান মেনে চলা হয়।

হালাল হোটেল বা আবাসনের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। এছাড়া ইসলামী পোশাক ও সংস্কৃতিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করা হয়। সময়মত নামাজ আদায়ের জন্য আযানসহ প্রয়োজনীয় সুবন্দোবস্ত থাকে। নারী ও পুরুষদের জন্য পৃথক সুইমিংপুল ও জিমনেসিয়ামের ব্যবস্থা করা হয়। সমুদ্র সৈকতের ক্ষেত্রেও নারী-পুরুষের জন্য বিচ্ছিন্ন সমুদ্র সৈকতের ব্যবস্থা করা হয়। সকল ক্ষেত্রেই হালাল খাবার পরিবেশন করা হয়।

হালাল পর্যটনের ক্ষেত্রে পর্যটন গন্তব্য নির্ধারণে পর্যটকদের প্রথম পছন্দ মূলত ইসলামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক স্থানসমূহ, ইসলামী শিল্প-সংস্কৃতির উৎপত্তি ও বিকাশিত অঞ্চল। সাধারণ পর্যটন গন্তব্যেও হালাল পর্যটন ও পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। তবে হালাল পর্যটনের নিশ্চয়তা, সুবিধা, যোগাযোগ ও সেবার সহজলভ্যতা পর্যটন গন্তব্য নির্ধারণে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী মুসলমানদের জন্য পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে স্পেন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হলেও মুসলিম পর্যটকরা অধিকহারে বৃটেনে ভ্রমন করছে। গ্লোবাল মুসলিম ট্রাভেল ইনডেক্স (GMTI)-এর ধারণা অনুযায়ী ২০২৬ সালের মধ্যে মুসলিম পর্যটকদের সংখ্যা ২৩০ মিলিয়নে পৌঁছবে।

হালাল ট্যুরিজমের বিশাল সম্ভাবনাময় বাজারে প্রবেশের জন্য বাংলাদেশে কি প্রস্তুত- আগামী পর্বে চোখ রাখুন।

Leave a Reply