কাতার বিশ্বকাপ : পর্যটনের স্বার্থে আইন প্রয়োগে নমনীয় কাতার

Share on Facebook

বর্তমান বিশ্বে প্রধানতম টেকসই অর্থনৈতিক খাত পর্যটন। এক দশক আগে ২০১১ সালে পর্যটন শিল্পের বৈশ্বিক বাজারের আকার ছিলো ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার। ধারাবাহিকভাবে বড় হতে হতে ২০১৯ সালে পর্যটন শিল্পের বাজারের আকার ১.৮ট্রিলিয়নে পৌছে। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম পর্যটন শিল্প। অন্যান্য শিল্পের মত পর্যটন শিল্পেও ধ্বস নামে, বাজারের আকার ছোট হয়ে ১ট্রিলিয়নে ডলারে নেমে আসে। তবে কোভিড পরবর্তী সময়ে পর্যটন শিল্প খুব দ্রুতই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। সদ্য কোভিডের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা পর্যটন শিল্পের বাজারের আকার ২০২১ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌছায়। বাজারের আয়তন বৃদ্ধি পাচ্ছে, আশা করা হচ্ছে চলতি বছর বাজার শেষে বাজারের আকার ১.৬ ট্রিলিয়ন ডলাবে দাঁড়াবে। পর্যটন শিল্পের দ্রুত সম্প্রসারণশীল এবং বাণিজ্যিক হিসেবে বেশী লাভজনক ধারাগুলোর মধ্যে স্পোর্টস ট্যুরিজম বা ক্রীড়া পর্যটন প্রধানতম। ক্রীড়া পর্যটনের বিশাল বাজারে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলো সুপরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। এরই ধারবাহিকতার ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল ২০২২এর আয়োজক দেশ কাতার।

ফুটবলের সবচে বড় আয়োজন ফিফা বিশ্বকাপ। কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবলের একটি আসর আয়োজন করার মাধ্যমেই কি ক্রীড়া পর্যটনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব- প্রশ্নটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে কাতারে ফিফা বিশ্বকাপ আসরের আয়োজন কোনে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, মধ্যপ্রাচ্যের এক ধনী রাষ্ট্রের খেয়ালখুশির প্রতিফলনও নয়। স্পোর্টস ট্যুরিজম তথা ক্রীড়া পর্যটনের বাজারে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে কাতার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন করছে।

ক্রীড়ার বড় অনুষ্ঠান বা মেগা ইভেন্ট আয়োজন করা কাতারের জন্য নতুন ঘটনা নয়। বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের আগে, গত দুই দশকে কাতারে এশিয়ান গেমস (২০০৬), এএফসি এশিয়ান কাপ ফুটবল (২০১১), ফিনা বিশ্ব সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপস (২০১৪), বিশ্ব হ্যান্ডবল চ্যাম্পিয়নশিপস (২০১৫), আইবিএ বিশ্ব বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপস (২০১৫), বিশ্ব এথলেটিক চ্যাম্পিয়নশিপস (২০১৯), বিশ্ব বিচ (Beach) গেমস (2019) এবং ফিফা আরব কাপ (২০১৯) অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্বকাপ ফুটবল আসর আয়োজনের এক বছর পরই কাতারে ওর্য়াল্ড একুয়ানটিকস চ্যাম্পিয়নশিপ’২০২৪ এবং এশিয়ান গেমস ২০৩০ অনুষ্ঠিত হবে।

ফিফা বিশ্বকাপ শুরু হতে মাত্র দুই সপ্তাহ বাকী। কাতারের সংস্কৃতি ও আইনের কড়াকড়িতে পশ্চিমাদের জন্য ফুটবল উপভোগ করা স্বস্তিদায়ক হবে কি না- পশ্চিমা মিডিয়া এবং সমর্থকদের মধ্যে মূখ্য আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠছে। কারণ পশ্চিমা সংস্কৃতি ও আচার আচরণের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের আরব সংস্কৃতি ও আচার আচরণের বিশাল বৈপরীত্য বিদ্যমান রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পশ্চিমের সাধারণ আচরণ কাতারের আইনে কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

কাতার বর্তমানে ভিশন ২০৩০ বাস্তবায়ন করছে। এই ভিশনের অন্যতম লক্ষ্য বহুমাত্রিক ও জ্ঞানভিত্তিক অর্থনৈতিক ধারা প্রবর্তনের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আয়ের লক্ষ্যে পর্যটন খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে পর্যটন খাতের লক্ষ্য অর্জনে কাতারি/আরব নাগরিকদের জন্য নিজস্ব সংস্কৃতি ও আইন বহাল রেখে বিদেশী পর্যটকদের প্রতি নমনীয় েআচরণ প্রদর্শন ছাড়া কাতারের হাতে তেমন বিকল্প নেই।

প্রকাশ্যে ঘোষণা না দিলেও বিশ্বকাপ ফুটবল দেখতে আসা অ-আরব সমর্থকদের প্রতি কাতার নমনীয় আচরণ করবে। নির্ভরযোগ্য পশ্চিমা মিডিয়াগুলোর তথ্য অনুযায়ী অ-আরব সমর্থকদের স্বার্থ রক্ষায় সম্প্রতি ফিফা এবং কাতার কর্তৃপক্ষ একটি গোপন সমঝোতায় উপনীত হয়েছে।

গোপন সমঝোতা অনুযায়ী বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়ে পশ্চিমা সংস্কৃতির সাধারণ আচরণ যেমন বিজয় উদযাপনে টেবিলে উঠে গান গাওয়া, মূর্তির উপর পতাকা টানানো, জনসমক্ষে উচ্চস্বরে গান গাওয়ার ক্ষেত্রে নমনীয়তা অবলম্বণ করাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। সমগ্র আরবে সমকামিতা অবৈধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও সমকামীদের প্রতি সহনশীল আচরণ কার হবে। আইন মেনে রংধনু রঙা পতাকা ওড়ানোর ক্ষেত্রেও বাঁধা দেওয়া হবে না। নারী-পুরুষের একসাথে হোটেল রুমে অবস্থানের ক্ষেত্রে বৈবাহিক বা পারিবারিক সম্পর্ক থাকার বাধ্যবাধকতায় ছাড় দেওয়া হবে।

বিশ্বকাপ দেখতে আসা নারীরা যে কোনো পরিস্থিতিতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গর্ভাবস্থা ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কিতসহ সকল ধরণের চিকিৎসা সেবা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাবেন।নারীরা অবৈবাহিক গর্ভধারণের ক্ষেত্রে কোনো অভিযোগ ও শাস্তির সম্মুখীন হবেন না। এছাড়াও ওধর্ষণ বা যৌন হয়রানি/সহিংসতার অভিযোগ করলে নারীরা পাল্টা অভিযোগের সম্মুখীন হবেন না।

কাতার পুলিশের পাশাপাশি বিশ্বকাপ আসরের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে পাকিস্তান ও তুরস্কের সেনাবাহিনীর একদল চৌকস সদস্য। ইতিপূর্বেই কাতার এই দুই দেশের সাথে চুক্তি সম্পাদন করেছে।

গোপন সমঝোতা বিষয়ে পশ্চিমা মিডিয়া হতে জানতে চাওয়া হলে ফিফা কোনো মন্তব্য করতে রাজী হয়নি। তবে কাতার বিশ্বকাপ বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা সুপ্রিম কমিটি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া সমর্থকদের আচরণ সংক্রান্ত নথিটি সম্পর্কে ফিফা অবগত রয়েছে। তবে এমন কোনো নথি সুপ্রিম কমিটি বা কাতার অনুমোদন করে নাই।

ফিফা বা সুপ্রিম কমিটির বক্তব্য যাই হোক না কেনো পশ্চিমা পর্যটকদের প্রতি কাতার বিশেষ নমনীয়তা প্রদর্শন করবে- এটা নিশ্চিত। কারণ বিশ্বকাপ দেখতে আসা অ-আরব পর্যটকদের প্রতি নমনীয় আচরণ প্রদর্শনের মাধ্যমে নিজেকে পর্যটক বান্ধব পর্যটন গন্তব্য হিসেবে ব্রান্ডিং করার সুযোগ ব্যবহারে কোনো ছাড় দিবে না কাতার।

কাতার বিশ্বকাপ : ক্রীড়া পর্যটনে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিবে মধ্যপ্রাচ্য

Leave a Reply