এবার শীতে হোক কৃষি পর্যটন

Share on Facebook

হেমন্তের বেলা ফুরাবার আগেই শুরু হয় শীত। হেমন্তের গোধুলীর খাম খুলে বেরিয়ে আসে আবছায়া কুয়াশা- জানান দেয় শীত আসছে। শীত আসে, শীতের শরীর জুড়ে তখনও লেগে থাকে সদ্য ফুরানো পাকা ধানের নবান্নের ঘ্রাণ। শীতের বয়স বাড়ে, কুয়াশা ঘন হয়। সন্ধ্যা হতে সকাল পর্যন্ত হাওয়ায় কনকনে ঠাণ্ডা, তারপর মিঠে রোদের সারাবেলা। এমন চমৎকার আবহাওয়া সাথে নিয়ে আমাদের দেশে শীত আসে ছুটির আমেজ নিয়ে, উদযাপনের উপলক্ষ্য হয়ে, বেড়ানোর উৎসব হয়ে। শীতে আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে শান্ত সমুদ্র, কুয়াশা আর মেঘের চাদরে ঢাকা রহস্য পাহাড় আর পিছুটানের ভালবাসার প্রিয় গ্রাম। এবার শীতে সমুদ্র আর পাহাড়ে বেড়ানোর মত করেই হোক কৃষি পর্যটন।

বাংলাদেশের গ্রামগুলো খুব দ্রুতেই বদলে যাচ্ছে। প্রত্যন্ত বহু গ্রাম পর্যন্ত এখন চলে গেছে আঁকা-বাঁকা পাকা সড়ক বা মেঠোপথ। গ্রামে গ্রামে পৌছে গেছে সোলার প্যানেলের বিজলী বাতির আলো। তবুও গ্রাম এখনও শহর হয়ে উঠেনি- ইট-কাঠ-পাথরের অশৈল্পিক কঠোর নির্মাণে নিজেকে হারিয়ে ফেলে নাই। এখনও গ্রামীন পথের দু’পাশে শস্য-শ্যামলা বাংলার চিরায়ত রূপ। কখনো পাকা সড়ক বা মহাসড়কের দুপাশে আদিগন্ত ফসলের মাঠ অক্ষত রেখে বুক চিড়ে চলে গেছে চেনা গন্তব্যে। কিছু দিন আগেও বাংলাদেশের অর্থনীতির বৃহত্তম খাত ছিলো কৃষি। যদিও শিল্পায়নের ফলে অর্থনীতিতে কৃষির অবদান খুব ধীরে হলেও ক্রমহ্রাসমান, তবু আজও কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে মোট কর্মসংস্থানের চল্লিশ শতাংশই কৃষির সাথে সম্পৃক্ত। দেশে শস্য, মাছ আর গবাদিপশু চাষের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈচিত্র সাধিতে হয়েছে। এমন দেশে বাস করে কৃষি পর্যটন না করাটা অপরাধ নয়- তবে ওই যে কথায় বলে ‘মক্কার মানুষ হজ্জ পায় না’ তার সাথে মিলে যায়।

কৃষি পর্যটন কিন্তু নতুন কিছু নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধ বিধ্বস্ত পৃথিবীতে অকৃত্রিম শান্তির খোঁজে পশ্চিমা দেশগুলোর পর্যটকদের কাছে কৃষি পর্যটন জনপ্রিয় হতে শুরু করে। বাজার গবেষণা সংস্থা ফিউচার মার্কেট ইনসাইটের দাবী অনুযায়ী ২০১৯ সালে বৈশ্বিক কৃষি পর্যটনের বাজারের আকার ছিল ৬৯,২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বার্ষিক গড়ে ১১.৩ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৯ সালে কৃষি পর্যটনের বৈশ্বিক বাজারের আকার ৬২২.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌছবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া, ইউক্রেন, আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপিনস, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত, নেপাল, উগান্ডা, আফ্রিকা, পর্তুগাল, ব্রাজিলসহ বহু দেশ সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কৃষি পর্যটন গন্তব্য হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলছে, ভিনদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে।

যে দেশের মানুষের মনে বিস্ময়মিশ্রিত অনন্ত জিজ্ঞাসা- ‘মানুষ আমি আমার কেন পাখির মত মন!’- সে দেশের মানুষের কাছে পর্যটন সংস্কৃতি নতুন কিছু নয়। এটা বলা অত্যুক্তি হবে না যে আমাদের দেশে কৃষি পর্যটনের চর্চা প্রাচীন, প্রায় নগরভিত্তিক সভ্যতা গড়ে ওঠার সমসাময়িক। কারণ আমাদের অধিকাংশের শিকড় আর পিছুটান গ্রামে জলে-হাওয়ায় আর মাটির বুকে প্রোথিত। নগরজীবনের ব্যস্ততা হতে মুক্তির জন্য আর ফসলের মৌসুমে গ্রামে ছুটে যাওয়ার প্রবণতা প্রাচীন। তবে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধনে সংগঠিতভাবে কৃষি পর্যটনের চর্চা গড়ে উঠেনি এটা অস্বীকার করলে ভুল হবে।

কৃষি পর্যটন কি- এই প্রশ্নের উত্তর একই সাথে সহজ ও জটিল। সহজ উত্তর হলো কৃষিকে কেন্দ্র করে যে পর্যটন তাকেই কৃষি পর্যটন বলে। তবে কৃষি পর্যটন শুধু বেড়ানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। কৃষি পর্যটনের উদ্দেশ্য মূলত কৃষক, কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি এবং ওই অঞ্চলের গ্রামীণ শিল্প- সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে যাওয়া, জ্ঞান আহরণ করা।

আমাদের দেশে কৃষি পর্যটন কেমন করে সম্ভব, এখানে তো ফার্ম হাউজ নেই- প্রায়ই এই প্রশ্নটির মুখোমুখি হতে হয়। আমাদের কৃষিতে পশ্চিমের মত ফার্ম হাউজের সংস্কৃতি নেই। তবে সাম্প্রতিক সময়ে গ্রামের নিকটবর্তী স্থানে বিভিন্ন রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। রিসোর্টের বিকল্প হিসেবে আছে আত্নীয় স্বজন বা অবস্থাসম্পন্ন কৃষকের বাড়ি। আমাদের সংস্কৃতি অনুযায়ী দিন যাপনের জন্য এসব স্থানে আথিতেয়তার ঘাটতি হয় না। তবে কৃষি পর্যটনের মূখ্য উদ্দেশ্য অনুযায়ী নিজের আনন্দ লাভের সাথে কৃষককে লাভবান করার কথাটি মনে রাখতে হবে।

বাংলাদেশের কৃষি পর্যটন আনন্দদায়ক হবে কি- প্রশ্নের উত্তরটা খুঁজার চেষ্টা করি। ধরা যাক, ধরা যাক কৃষি পর্যটনের উদ্দেশ্যে এক শীতের বিকেলে আমরা গ্রামে পৌছলাম। থাকার ব্যবস্থা হয়েছে ফার্মহাউজ বা কৃষকের বাড়িতে। সেখানে পৌছানোর সাথে সাথে ক্লান্তি দূর করার জন্য পরিবেশন করা হলো খেজুর গুড়ের চা, নারকোলের নাড়ু, নকশী পিঠা। যাদের মিষ্টি খাওয়া পছন্দ নয়, তাদের জন্য সর্ষে তেলে মাখা ঘড়ে ভাজা মুড়ি। শীতে ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে। ভ্রমণের ক্লান্তি দূর করতে বাড়ি বা রিসোর্টের ভেতরই আলাপ আলোচনায় সময় কাটানো যাক। রাতের খাবারে ভাত, দেশী মুরগি মাংসের ঝোল, শীতের সবজির ভাজি আর ভর্তা। রাতে লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুম- কারণ আগামীকাল খুব ভোরে জাগতে হবে, আসল পর্যটন আগামীকাল সকাল থেকে শুরু হবে, তার জন্য শক্তি সঞ্চয় করা যাক।

কৃষি পর্যটনের প্রথম দিনটা শুরু হবে খুব ভোরে। কৃষকের জেগে ওঠার আগে জেগে উঠতে হবে। অবশ্য জেগে ওঠার জন্য ঘড়িতে এলার্ম দেওয়ার প্রয়োজন নেই, কুম্ভকর্ণ না হলে পাখিদের সম্মিলিত সংগীতের সুরে বিছানায় শুয়ে থাকা অসম্ভব হবে। ঘর ছেড়ে বারান্দায় আসতেই একরাশ ঠাণ্ডা বাতাস শীতের জানান দিবে। কুয়াশায় চার দিকে আবছায়া, ঘোর লাগা সময়। ওই দিকে রান্নাঘরে অতিথিদের জন্য সকালের নাস্তা বানানোর প্রস্তুতি চলেছে। গ্রামের অধিকাংশ কৃষক আজও সকালের নাস্তা হিসেবে ভাতকেই পছন্দ করে, তবে সাধারণত শহরের মানুষ ভাত খেয়ে অভ্যস্ত নয়। তাই অতিথিদের নাস্তায় তৈরী হচ্ছে আটা বা ময়দার রুটি, সবজি ভাজি, পোষা মুরগি ডিম আর শীতের বিশেষ আয়োজন রসের ক্ষীর।

নাস্তা খাওয়া শেষে যাওয়া হবে ফসলের মাঠে। বর্ষায় ফসলের মাঠ কাদায় মাখামাখি থাকলেও শীতে শুকনো থাকে। শীতে মূলত সবজি চাষ করা হয়। ফুলকপি, বাঁধাকপি, মটরশুটি, টমেটো, গাজর, শসা, ঢ্যাঁড়স, লালশাক, পালংশাক, পুঁইশাক আর শিমের ক্ষেতে ঘুরে কেটে যাক সারা বেলা। শুধু বেড়ানো আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করায় সীমাবদ্ধ না থেকে নিজের কৌতূহল মিটাতে জেনে নেই চাষের কলা-কৌশল, প্রাচীন চাষ পদ্ধতির সাথে বর্তমান পদ্ধতির মিল বা অমিল আর ফসলের লাভ-ক্ষতি ও কৃষকের আনন্দ-বেদনার তথ্য। বর্তমানে নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি অতি জরুরী, একমাত্র কৃষকই বলতে পারবেন অধিক লাভের জন্য কারা ক্ষতিকর/মাত্রাতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে আর কারা করে না। কিভাবে খাবার জন্য নিরাপদ করে শস্য চাষ করা হয় তা নিজ চোখে দেখার অভিজ্ঞতা অতুলনীয়। কৃষকের সাথে ফসলের মাঠে হাত লাগানো, একদিনের জন্য সহজেই শখের কৃষক বনে যাওয়া যায়।

খুব বেশী খুতখুতে না হলে দুপুরের খাওয়াটা কোনো ক্ষেতের পাশে বসেই খেয়ে নেওয়া যায়। তবে কোনোভাবেই যেনো ক্ষেতের ক্ষতি না হয়, প্লাস্টিকসহ অপঁচনশীল দ্রব্য ক্ষেতের আশপাশে ফেলে পরিবেশের ক্ষতি করা যাবে না। কৃষি পর্যটনের প্রথম দিনটা শীতের মিঠে রোদে আর শীত শীত হাওয়ায় সবজির ক্ষেতে ক্ষেতে ঘুরেই কাটিয়ে দেওয়া যায়।

শীতের রাতে গ্রামে গানের আসর বসে। গরম গরম পিঠা খেতে খেতে গান উপভোগ করা যায়। কুয়াশার চাদর ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ছড়িয়ে পড়েছে জোছনা, আর এক গ্রাম্য গায়ক হৃদয়ের সকল দরদ কণ্ঠে এনে গাইছে গভীর প্রেমের গান. পরম সৃষ্টিকর্তাকে না পাওয়ার অপার আক্ষেপ বা নিজের অক্ষমতার বয়ান- মনে হবে এই রাত শেষ না হোক। জীবনের বাকী ক’টা দিন এভাবেই কেটে যাক। কিন্তু বৃত্ত ভাঙা সহজ নয়, বৃত্ত ভেঙে মানুষ বৃত্তের কাছেই ফিরে আসে- এসব দার্শনিকতা মাথায় নিয়ে ঘুমোতে যেতে হবে। কারণ কৃষি পর্যটনের দ্বিতীয় দিনটা কাটবে মাছের সাথে, নদী আর পুকুরের সাথে।

ফুলকপি আর আলু দিয়ে শোল মাছ, মটরশুটি ও টমেটোর সাথে কৈ-মাছ, আলু-বেগুন-টমেটোর সাথে রুই বা কাতলা মাছ, আলু শিম দিয়ে বোয়াল মাছের সখ্যতা শীতকালেই গাঢ় হয়। মাছের ঘরে বেড়াতে না গেলে গতকাল সবজির ক্ষেতে বেড়ানোটা অপূর্ণ থেকে যাবে। গ্রামের পুকুরে মাছ চাষ খুব জনপ্রিয়। বিশ্বের প্রধান মাছ উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রধানতম। নদীর মাছ তো আছেই। মাছ শিকারে অভ্যস্ত হলে ছিপ নিয়ে পুকুরের ঘাটে আয়েশ করে বসে যাওয়া যায়। অথবা জাল ফেলে মাছ তোলা হবে। মাছ চাষীদের কাছে জেনে নেওয়া যাক মাছ চাষের ফাকফোকড়। কোন মাছ ভালো আর কোন মাছ পাতে তোলা উচিত না। কাছাকাছি নদী থাকলে জেলেদের মাছ ধরার কলা কৌশল দেখার সুযোগ হারানো ঠিক হবে না, সাথে নৌভ্রমণ তো হলোই। নিজের হাতে ধরা বা নিজের চোখের সামনে ধরা মাছের সাথে তরকারির মিশেলে জমপেশ খাওয়া দাওয়া হতে পারে। রাতে খোলা উঠানে বার-বি-কিউও হতে পারে।

তৃতীয় দিনটা নিজের মত করে কাটানো যাক- তবে শীতে কৃষি পর্যটনে যাওয়া হবে কিন্তু সর্ষে ফুলের হলুদ রাজত্বে প্রবেশ করা হবে না- এটা রীতিমত অপরাধ। তবে তৃতীয় দিনটাতে প্রয়োজনীয় কিছু কাজ যেমন কৃষকের কাছ থেকে পছন্দনীয় সব্জি কেনা যেতে পারে। নিজ হাতে ক্ষেত বা গাছ থেকে সবজি তোলার আনন্দ আর কোন আনন্দের সাথেই তুলনীয় হতে পারে না। পছন্দের মাছ আর অন্যান্য কৃষিজাত পণ্যও কেনা যেতে পারে। সবথেকে ভালো হয় কৃষকদের সাথে চুক্তিভিত্তিক নিরাপদ ফসল উৎপাদনের চুক্তিতে গেলে- এতে কৃষক পণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে লাভবান হবে আর ক্রেতা নিশ্চিন্তে নিরাপদ খাদ্য মুখে তুলতে পারবো।

কৃষি পর্যটনের অতি সামান্য একটা খসড়া পরিকল্পনা দেওয়া হলো। অঞ্চল অনুযায়ী পরিকল্পিতভাবে অন্তত ৩ থেকে ৭ দিনের মেয়াদে আরও চমৎকারভাবে কৃষি পর্যটন করা যায়।

কৃষি পর্যটনে লাভ কি- কৃষি পর্যটনে লাভ বহুমুখী। প্রথমত প্রকৃতি এবং পরিবেশকে জানা হয়। দ্বিতীয়ত উৎপাদকের সাথে ভোক্তার সরাসরি যোগসূত্র রচিত হয়। তৃতীয়ত কৃষি পর্যটনের মাধ্যমে কৃষকের বাড়তি মুনাফার সুযোগ তৈরী হয়। কারণ সে যে সেবা ও পণ্যসমূহ প্রদান করে তার পর্যটককে ওইসব সেবা ও পণ্যের বাণিজ্যিক অর্থমূল্য পরিশোধ করতে হয়। পর্যটকের লাভ বহুমুখী, তবে তার যে অভিজ্ঞতা হয় তা অর্থমূল্যে পরিমাপযোগ্য নয়।

কুয়াশাচ্ছন্ন শীত বা মেঘমুখর বর্ষা, উদাসী হেমন্ত বা মুখর বসন্ত- বাংলাদেশের প্রতিটি ঋতুই কৃষি পর্যটনের জন্য উপযুক্ত। তবে ঋতুভেদে কৃষি পর্যটনের ধরণ, লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য হবে ভিন্ন হবে। এবার শীতে হোক কৃষি পর্যটন প্রকৃতির সান্নিধ্য আর টাটকা খাবার ও গ্রামীণ ঐতিহ্যের আন্তরিক আতিথেয়তায়। গাঢ় শীতে আপনজনদের সাথে নিয়ে কৃষি পর্যটন হোক আনন্দময় উষ্ণতার।

Leave a Reply