অপ্রিয় আলাপ : পর্যটনের বিভ্রান্তি, বিভ্রান্তির পর্যটন- ২

Share on Facebook

২৭ অক্টোবর ২০১৫, ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় দুদিনব্যাপী আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ ঐতিহ্য ও পর্যটন সম্মেলন। জাতিসংঘের পর্যটন সংস্থা (ইউএনডব্লিউটিও) এবং বাংলাদেশ সরকারের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এই সম্মেলনের আয়োজন করে। জাতিসংঘের পর্যটন সংস্থার প্রধানসহ বিশ্বের ১৩টি দেশের পর্যটনমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এতে অংশ নেন।  সম্মেলন উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকে গতিশীল করতে আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৬ সালকে পর্যটন বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেন।

বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড পর্যটন বর্ষ ২০১৬ পালনের কার্যক্রমগুলো পরিচালনা করে। পর্যটন বর্ষের প্রথম দিন বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন জানান, বাংলাদেশকে পুরো বিশ্বের কাছে পর্যটন গন্তব্য হিসেবে পরিচিত করাই এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য। ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পর্যটক মন্ত্রীদের বৈঠক ২০১৭ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হবে। তাই  ২০১৬ সালকে পর্যটন বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হলেও কার্যক্রম চলবে ২০১৮ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ তিন বছর।

পর্যটন বর্ষের লক্ষ্য প্রসঙ্গে মন্ত্রী জানান, তিন বছরে সর্বমোট ১০ লাখ বিদেশি পর্যটককে বাংলাদেশে নিয়ে আসা, পর্যটন খাত থেকে ৩০০ মিলিয়ন বা ৩০ কোটি ডলার আয় এবং পর্যটন খাতে নতুন তিন লাখ কর্মক্ষেত্র তৈরি করার লক্ষ্য নির্ধারণের কথা।

২০১৮ সালে ৫-৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকায়  দশম ইসলামিক কনফারেন্স অব ট্যুরিজম মিনিস্টারস(আইসিটিএম) সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওআইসিভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর পর্যটনমন্ত্রীদের এই সম্মেলনের শেষ অধিবেশনে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাকে ২০১৯ সালের জন্য ‘ওআইসি সিটি অব ট্যুরিজম’ ঘোষণা করে। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে বৈশ্বিক ক্রেডিট কার্ড সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান মাস্টারকার্ড ও মুসলিম পর্যটনবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্রিসেন্ট রেটিং পরিচালিত জরিপের তথ্য অনুযায়ী মুসলিম পর্যটকদের ভ্রমণ গন্তব্যস্থল হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮তম।

২০১৯ সালের ১১ জুলাই  ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে দুই দিনব্যাপী ‘ওআইসি সিটি অব ট্যুরিজম-২০১৯’এর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় ওআইসির এসিসটেন্ট সেক্রেটারি মুসা কুলাকলিকায়াসহ ৩০টি ওআইসি সদস্য দেশের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

এমন সব বড় বড় অর্জনে আনন্দিত হওয়ার পাশাপাশি একটু অপ্রিয় আলাপ করা যাক,  পর্যটন বর্ষে সর্বমোট ১০ লাখ বিদেশি পর্যটককে বাংলাদেশে নিয়ে আসা, পর্যটন খাত থেকে ৩০০ মিলিয়ন বা ৩০ কোটি ডলার আয়, পর্যটন খাতে নতুন তিন লাখ কর্মক্ষেত্র তৈরি, মুসলিম পর্যটকদের পছন্দের গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলা- কতটা  বাস্তবায়িত হয়েছে।  উত্তর খুঁজার জন্য খুব বেশী দূর যাওয়ার প্রয়োজন নেই, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকের সুপারিশগুলি যথেষ্ট।

চলতি অক্টোবর মাসের ৪তারিখে জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত <span;>সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির <span;>বৈঠকে যে সুপারিশগুলো করা হয়-
১.  পর্যটন শিল্পে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলোকে কাজে লাগানো।

২.  পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে বিদেশি পর্যটকদের জন্য ‘ডেডিকেটেড ক্যাসিনো’সহ তাদের বিনোদন উপযোগী ব্যবস্থা রেখে স্থাপনা নির্মাণের জন্য কমিটি সুপারিশ করেছে।

৩. পর্যটন শিল্প বিকাশের স্বার্থে আন্তর্জাতিক পর্যটন সংস্থাসহ দেশি-বিদেশি ট্যুর অপারেটরদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করে তাদের সহযোগিতা গ্রহণ।

৪. পর্যটন শিল্পে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে।

৫. বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের জন্য ভিসা ও ইমিগ্রেশন পদ্ধতি সহজীকরণ।

৬. পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কমিটি কর্তৃক সুপারিশ করা হয়।

৭. কক্সবাজারের পর্যটন করপোরেশনের মোটেল শৈবাল, প্রবাল ও উপলকে একত্রিত করে মাস্টারপ্ল্যানের মাধ্যমে আধুনিক, আকর্ষণীয় এবং উন্নত সুযোগ সুবিধা সংবলিত পর্যটন স্থাপনা নির্মাণ।

৮. কুয়াকাটার পর্যটন এলাকা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে অগোছালো স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করে মাস্টারপ্ল্যানের মাধ্যমে আধুনিক, আকর্ষণীয় এবং উন্নত সুযোগ সুবিধা সংবলিত পর্যটন স্থাপনা নির্মাণ।

১৯৯২ হতে ২০২১ অর্থাৎ ২৯বছর বা ২০১০ হতে ২০২১ অর্থাৎ ১১ বছর পরও একই কাসুন্দি ঘাঁটা হচ্ছে। সংসদীয় কমিটি সভা করে উপরোল্লিখিত যে সুপারিশগুলো করেছে তার সবই জাতীয় পর্যটন নীতিমালায় ১৯৯২ এবং জাতীয় পর্যটন নীতিমালা ২০১০এর আওতাভুক্ত। নীতিমালার আলোকে পর্যটনের বিকাশ হলে এক দশক পর কমিটিকে এসব সুপারিশ করতে হয় না। লজ্জাজনক সত্য হলো যে, নীতিমালা প্রণয়নের প্রায় তিন দশক বা নূন্যতম এক দশক পরও একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে পর্যটন। এসব সুপারিশের পরিবর্তে নীতিমালা কতটা কার্যকর হয়েছে, কতটা বাস্তবায়িত করা যায়নি, প্রতিবন্ধকতাগুলো কি কি- এসব নির্ণয়ে কোনো আগ্রহ নেই, দায় নেই।

সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি আ. স. ম. ফিরোজ গণমাধ্যমকে জানান, ‘আমরা আজকের বৈঠকে যেসব সুপারিশ ও নির্দেশনা দিয়েছি, এটার অগ্রগতি নিয়ে ৬ মাস পর আবারও বসবো। ওই সময় আমরা দেখতে চাই তারা আমাদের নির্দেশনার কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছে।’ তিন দশকের কথা আপাতত তোলা থাক, বর্তমান সরকারের প্রণীত জাতীয় পর্যটন নীতিমালা- ২০১০ বাস্তবায়নের ধীর গতির কারণগুলোর নির্মোহ বিশ্লেষণ এবং কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ছাড়া ‘আমরা দেখতে চাই তারা আমাদের নির্দেশনার কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছে’ – শুধু দেখাই হবে, কাসুন্দি ঘাটা ছাড়া কাজের কাজ কিছু হবে না।

বৈঠকের পর কমিটির সভাপতি আ. স. ম. ফিরোজ গণমাধ্যমকে বলেন, <span;>কক্সবাজারের তিনটি মোটেলে (উপল, শৈবাল, প্রবাল) মোট সাড়ে ১৫ একর জমি। এর অবস্থানও একেবারেই বিচের কাছে। কিন্তু সেখানকার মোটেল তিনটিতে সেই ধরনের সুযোগ সুবিধা নেই। বেশিরভাগ রুমগুলো নন-এসি। পর্যটকরা সেখানে থাকতে চান না। এ জন্য আমরা তিনটি মোটেলকে একত্র করে বড় সব ধরনের সুযোগ সুবিধা সংবলিত স্থাপনা তৈরির সুপারিশ করেছি।  সভাপতির বক্তব্য পড়ে হাসবো না কাঁদবো এ সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে কিছুক্ষণ স্তব্দ হয়ে রইলাম।

একটি আশ্রায়ণ কেন্দ্রকে মোটেলে পরিণত করে ১৯৭২ সালে চালু হয় ‘উপল’। তখন কক্স বাজারে কোনো আবাসিক হোটেল বা মোটেল ছিল না। প্রায় পাঁচ দশক হতে চললো- উপলের কোনো সংস্কার করা হয়নি।  ১৯৮৩ সালে শুরু হয় শৈবাল, ৩৫০ একর ভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হোটেলটির সংস্কার করা দূরের কথা, জমি রক্ষা করতে পারছেনা পর্যটন কর্পোরেশন। ইতিমধ্যে কক্সবাজার ক্রিকেট স্টেডিয়ামকে ৫০একর জমি প্রদান করেছে, কিন্তু এখনও মূল্য বুঝে পায়নি। কাজে লাগানোর ব্যর্থতায় পর্যটন গন্তব্য সাবরাংয়ে হাজার একর জমির মালিকানা হারিয়েছে পর্যটন কর্পোরেশন, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)কে ইপিজেড নির্মাণের জন্য সরকার বিনামূল্যে বরাদ্ধ করেছে।

পর্যটন করপোরেশন একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হলেও হোটেল, মোটেল, বার থেকে তারা মুনাফা করতে পারছে না। সবগুলো বার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে লিজ দেওয়া হয়েছে, পর্যটন কর্পোরেশন ব্যর্থ হলেও বারগুলো লিজে নিয়ে মুনাফা করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। হোটেল মোটেলগুলোর কোনো সংস্কার নেই, এসিও ঠিকমত চলে না, সার্ভিস নিম্ন মানের- এসব তথ্য মিথ্যা নয়। কিন্তু এসবের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে, পেশাদার ও যোগ্য ব্যক্তিদের যোগ্য স্থানে বসানোর পরিবর্তে তিনটি মোটেলকে একত্র করে বড় সব ধরনের সুযোগ সুবিধা সংবলিত স্থাপনা’ নির্মাণে পর্যটন শিল্পের কোনো ফায়দা হবে না, অপচয়ের মচ্ছব হবে।

কমিটির সভাপতি আরও বলেন, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতটিও দেশের অনন্য। এখানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। ব্রিজটি উদ্বোধন হলে ঢাকা থেকে সেখানে যেতে মাত্র সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগবে। এ জন্য আমরা বলেছি সেখানে আগামী ৬ মাসের মধ্যে এমন স্থাপনা তৈরি করা হোক, যাতে করে ৫ হাজার লোক থাকতে পারে। অতি উত্তম প্রস্তাব, কিন্তু কুয়াকাটা পর্যটন গন্তব্যের পর্যটক ধারণ ক্ষমতা কত- তা কি নির্ণয় করা হয়েছে। যদি না করা হয়ে থাকে তবে কোন তথ্য বা পরিকল্পনার ভিত্তিতে ৫হাজার লোক থাকার মত স্থাপনা নির্মাণের তাগিদ।

ইতোমধ্যে কৃতিত্বের সাথে সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে পরিবেশগতভাবে হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত ৪ কিলোমিটারে সীমাবদ্ধ হয়ে কারওয়ান বাজারের ভিড়ে পরিণত হয়েছে,  পর্যটন বান্ধবের পরিবর্তে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে অধিকাংশ আবাসিক হোটেল।  এখন কুয়াকাটায় ঢাকার গুলিস্তানের জনারণ্যের আবেশ তৈরীর পরিবর্তে পরিকল্পিতভাবে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহন করা হোক।

প্রিয় পাঠক, একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পারেন। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের পরিচালনায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো মুনাফা করতে ব্যর্থ হলেও ওইসব প্রতিষ্ঠান বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় মুনাফা করে কোন কৌশলে। এমন কোন গোপন মন্ত্র আছে যা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো জানে কিন্তু পর্যটন কর্পোরেশনের জানা নেই।

Leave a Reply