পর্যটনের লক্ষ্যহীন যাত্রা

Share on Facebook

প্রয়োজনীয় নীতিমালা, সম্বনিত পরিকল্পনা এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাব সত্বেও বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের ব্যাপক বিকাশ ঘটছে। সমস্ত খাত-উপখাত মিলিয়ে এই শিল্পে অন্তত পয়তাল্লিশ লক্ষ পেশাজীবি কর্মরত রয়েছে। এই শিল্প নির্ভর মানুষের সংখ্যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অন্তত দুই কোটি। বিশ কোটি মানুষের দেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ যে শিল্প নির্ভর ওই শিল্পকে গুরুত্বহীন বিবেচনা করার সুযোগ নেই। কিন্তু বাংলাদেশে পর্যটন শিল্প যতখানি গুরুত্ব দাবি করে ততখানি গুরুত্ব আজ পর্যন্ত পায়নি। পর্যটন শিল্পকে গুরুত্ব না দেওয়ার ফলে সংশ্লিষ্ট খাতসহ দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে ক্ষতির সার্বিক পরিমাণ নির্ধারণেও যেনো অনীহা রয়েছে। নীতি নির্ধারক পর্যায়ে আন্তরিকতার অভাব না থাকলেও বিদ্যমান সীমাবদ্ধতায় পর্যটনে বাংলাদেশের অবস্থা খুবই নাজুক।

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ বিনির্মানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন গড়ে তুলেছিলেন সেই স্বপ্ন আজও অধরাই রয়ে গেল। সুজলা-সুফলা আর ছবির মতো সুন্দর গ্রামীণ জীবনকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে পারলে বাংলাদেশ হতো দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য। ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রত্নতত্ত্ব আর ধর্মীয় পর্যটনে উন্নতি করারও যথেষ্ট অবকাশ ছিল। শুধুমাত্র পর্যটনের ওপর ভ’র করে বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং পরিচিতি কোথায় গিয়ে পৌঁছাতে পারতো তা বোঝার জন্য স্বপ্ন দেখার প্রয়োজন নেই, পার্শ্ববর্তী দেশ ইন্ডিয়া, নেপাল, এমনকি ভূটানের দিকে তাকিয়ে খাতা কলমে হিসেব করলেই যথেষ্ট।

হিমালয় পর্বতমালা নেপালের প্রধান পর্যটন আকর্ষণ। হিমালয় কেন্দ্রিক পর্যটকদের লক্ষ্য করে ছোট ছোট গুরুত্বহীন গন্তব্যগুলোকেও আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলা হয়েছে। পর্যটন খাতের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে কার্যকর পরিকল্পনার মাধ্যমে গন্তব্যগুলোতে পর্যটন কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করেছে। যেমন ত্রিশূলী নদীতে র‍্যাফটিং, লাস্ট রিসোর্টে বাঞ্জি জাম্পিং, চিতোয়ান ভিলেজে জংগল সাফারি ইত্যাদি।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ভৌগোলিক বৈচিত্র্যময়তায় ভরপুর। বলা হয়ে থাকে ভারত হলো অর্ধেক পৃথিবী। পাহাড়, পর্বত, নদী, সাগর থেকে শুরু করে মরুভূমি পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় সব রকম পর্যটন আকর্ষণই দেশটিতে আছে। পর্যটন আকর্ষণে প্রাচুর্যপূর্ণ দেশটি পর্যটনে যতটা সমৃদ্ধ হতে পারতো বাস্তবে ততটা পারেনি। কিন্তু বিগত এক দশকে ধরে পর্যটন শিল্পে গুরুত্ব দিয়েছে, গবেষণা ও উন্নয়নে ভালো করছে। ধারণা করা হচ্ছে ২০৩০ সালের পর ভারতও বৈশ্বিক পর্যটনে নিজের অবস্থান যথেষ্ট পোক্ত করতে সক্ষম হবে। উল্লেখ্য, ভারতে আগত বিদেশি পর্যটক সংখ্যায় বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। দেশটিতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক বিদেশি পর্যটক আসে আমেরিকা থেকে। ভারতের টেকসই পর্যটন উন্নয়নে সবচেয়ে বড অবদান মেডিক্যাল ট্যুরিজমের। সাম্প্রতিক সময়ে মেডিক্যাল ট্যুরিজমে ভালো করা দেশগুলোর মধ্যে ভারত অন্যতম।

ভূটান পর্যটন নীতি অন্যদের তুলনায় ব্যাতিক্রম। শান্তি, সমৃদ্ধি আর পর্যটনে তারা পৃথিবীর সবদেশ থেকে আলাদা। সারা দুনিয়া যেখানে নিজস্ব জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে অস্থির ভূটান সেখানে গুরুত্ব দিচ্ছে জিডিএইচ প্রবৃদ্ধি। অর্থাৎ গ্রোস ডোমেস্টিক প্রডাকশনের চেয়ে তারা গ্রোস ডোমেস্টিক হ্যাপিনেসে বিশ্বাসী। নিজদের শান্তি ও সংস্কৃতিকে বিদেশি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে তারা সার্কভুক্ত দেশগুলোর বাইরের পর্যটকদের প্রতি বরং বাড়তি ব্যয় চাপিয়ে দিচ্ছে। তবুও ভূটানে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলছে।

বাংলাদেশে নেপালের মতো কোনো সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ নাই, ভারতের মত ভৌগলিক বৈচিত্র নেই, ভূটানের মত ব্যতিক্রম সংস্কৃতিও নেই। এ তো গেলো না থাকার কথা, অথচ ক্ষুদ্র এ বদ্বীপে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নিরবচ্ছিন্ন সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন প্রবাল দ্বীপ, হাওর, বাওর, জলাশয়, লাউয়াছড়ার মত বহু উদ্যান, যতদূর চোখ যায় চা বাগান আছে, আছে সবুজ পাহাড়ের সারি, ইসলাম, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ সব স্থান।

দুঃখজনক সত্য হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নিরবচ্ছিন্ন সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন আর পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়কেও আমরা যথাযথভাবে পর্যটনের বিশ্ব বাজারে বিপনন করতে পারিনি। এছাড়া দেশে এতো এতো পর্যটন আকর্ষণ আছে যেগুলো পর্যটন বান্ধব করে গড়ে তুললে এবং বিপনন করলে নেপাল, ইন্ডিয়া, ভূটান, মালদ্বীপ, কিম্বা থাইল্যান্ড, মালেয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মত বাংলাদেশও হতো এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য।

সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায় পর্যটন শিল্পের বীজকে বৃক্ষে পরিণত করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় মনোযোগ দিতে আমরা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছি, এই ব্যর্থতা লাঘবের চেষ্টার গতিও খুব ধীর। অথচ সমন্বিত পর্যটনশিল্প গড়ে উঠলে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিনত হত। জীবনযাত্রার মান উন্নত হতো, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেত, শিক্ষার হার বেড়ে যেতো। অন্যদিকে কমতো দারিদ্র আর বেকারত্বের হার। বঙ্গবন্ধু আপন দূরদর্শিতায় নির্ভর করে যুদ্ধবিধস্ত স্বাধীন রাষ্ট্রে গড়ে তুলেছিলেন বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন, তিনি প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে পর্যটন শিল্পের গুরুত্ব যতটা অনুধাবন করেছিলেন, অর্ধ শতাব্দী পরে এসেও সেটার যথাযথ বাস্তবায়ন নেই। এমনকি পর্যটন যে একটি রপ্তানিযোগ্য শিল্প এই বোধেরই উদয় হয়নি রাষ্ট্রীয়ভাবে।

আজ আত্মজিজ্ঞাসার সময় এসেছে, ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে পর্যটনের বিশাল সম্ভাবনা থাকা স্বত্বেও কেন আজও তাকে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলতে হচ্ছে, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও কেন পর্যটন পরিপূর্ণ শিল্পের মর্যাদা লাভ করে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছেনা। পর্যটন সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতার অভাব না থাকার পরও কেনো সুদিনের দেখা মিলছে না পর্যটনে।

 

আবু রায়হান সরকার

সম্পাদক, পর্যটনিয়া

Leave a Reply