১৩৫ টি দেশের মাটি ছুঁয়ে দেখা প্রথম বাংলাদেশী নারী

Share on Facebook

১৯৭৯ সালের ১২ ডিসেম্বর
লক্ষ্মীপুরে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ
করেন নাজমুন নাহার। দাদা আলহাজ ফকীহ আহমদ উল্লাহ ইসলামিক স্কলার ছিলেন। ১৯২৬-১৯৩১
সাল পর্যন্ত ফকীহ আহমদ উল্লাহ আরব দেশগুলোতে সফর করেন। তিন ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে
সর্বকনিষ্ঠ নাজমুন নাহার বেড়ে
ওঠেন সবার আদর ও ভালোবাসায়।

জন্মের পর থেকেই নাজমুনকে
পুরো পৃথিবী ভ্রমণের একটি স্বপ্নই তাড়িত করত, ছোটবেলার সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করেছেন তিনি। সংশয়-বিপত্তিকে
তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে এরই মধ্যে নাজমুন ঘুরেছেন ১৩৫টি দেশ। বাংলাদেশের মেয়ে
নাজমুনের পায়ের স্পর্শ পেয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মাটি। নাজমুন ঘুরে ঘুরে
মিশেছেন বিচিত্র স্বভাবের মানুষের সঙ্গে, পূর্ণ করেছেন তার অভিজ্ঞতার
ঝুলি। পাখির মতো,
প্রজাপতির ডানার মতো ছোটবেলা থেকেই সীমানাহীন উড়তে চাইতেন
নাজমুন। সব বাধাকে হার মানিয়ে এই প্রজন্মের ইতিহাস সৃষ্টিকারী মানুষটির জীবনের
দৃঢ় সংকল্প তাঁকে ঘর ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পথে পথে। ১৯ বছরের কঠিন অভিযাত্রায় বাংলাদেশের পতাকা
হাতে ভ্রমণ করে ফেলেছেন পৃথিবীর ১৩৫টি দেশ। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় একাকী ভ্রমণ
করেছেন এতটা পথ।

আজ কবির কবিতার বাস্তব
উদাহরণ হয়েছেন তিনি। সর্বাধিক রাষ্ট্র ভ্রমণকারী প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ইতিহাসের
পাতায় লিপিবদ্ধ হয়েছেন নাজমুন নাহার। ২০১১-২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি তাঁর মাকে
নিয়েও ঘুরেছেন ইউরোপ ও আমেরিকার ১৪টি দেশ। আল্পস পর্বতমালা থেকে শুরু করে বহু
দর্শনীয় স্থানে ঘুরেছেন মাকে নিয়ে।

২০০০ সালে প্রথম
দেশের বাইরে পা রাখেন প্রতিবেশী ভারতে। এরপর এশিয়ার কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করেন। ২০০৬ সালে
উচ্চশিক্ষার জন্য যান ইউরোপের দেশ সুইডেনে। ভর্তি হন লুন্ড ইউনিভার্সিটিতে। এরপরই
অবারিত হয় নাজমুনের দিগন্ত। ২০০৭ সালে ফিনল্যান্ড দিয়ে ইউরোপ ভ্রমণ শুরু। এরপর
পূর্ব আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্র, আরব ও ওশেনিয়া অঞ্চল, পশ্চিম আফ্রিকা—১৯ বছরে ১৩৫টি দেশ ভ্রমণ। রেখেছেন প্রতিটি মহাদেশে পা। ১৩৫তম দেশ হিসেবে
কোস্টারিকা ভ্রমণ করেন নাজমুন।

নাজমুন নাহারের
স্বপ্ন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরপূর্তির মধ্যেই জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত
১৯৩টি দেশ ভ্রমণের। আরও স্বপ্ন, স্বাধীনতা না পাওয়া সাতটি দেশ ভ্রমণেরও। দুইশ দেশে পা রাখলেই
পৃথিবীর প্রথম মানবী হিসেবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে ঠাঁই হবে এই পরিব্রাজকের।

নাজমুন পৃথিবীর
এক দেশ থেকে অন্য দেশে হাজার হাজার মাইল সড়কপথে একা ভ্রমণ করে চলেছেন নিজ দেশের
পতাকা হাতে। এর আগে নারী হিসেবে শতাধিক স্বাধীন দেশ ঘোরার স্বীকৃতিস্বরূপ জাম্বিয়া
সরকারের কাছ থেকে পেয়েছেন ‘ফ্ল্যাগ
গার্ল’ (পতাকাকন্যা) উপাধি।

মেয়ের এই
অভাবনীয় সাফল্যে দারুণ খুশি মা তাহের আমিন। তিনি বলেন, ‘নাজমুন যখন আমার গর্ভে
ছিল, তখন প্রায়ই আমি আকাশে ওড়ার স্বপ্ন দেখতাম। ওর মধ্যে
ছোটবেলা থেকে আমি ভিন্নতা লক্ষ করেছি। ছোটবেলা থেকেই নাজমুনের মধ্যে একটা উৎসাহ
এবং কৌতূহল কাজ করত। যে কোনো কিছু নিয়ে জানার আগ্রহ ছিল প্রচুর। চাঁদ, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে অনেক প্রশ্ন করত।
পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ছিল অনেক। সময়ানুবর্তী এবং পরিশ্রমী ছিল।’

২০১৮ সালের ১
জুন নাজমুন একশ দেশ ভ্রমণের মাইলফলক সৃষ্টি করেন পূর্ব আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়েতে।
বাংলাদেশের পতাকা হাতে জাম্বিয়ার সীমান্তবর্তী লিভিংস্টোন শহরে অবস্থিত পৃথিবীর
বিখ্যাত ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের ব্রিজের ওপর দিয়ে পায়ে হেঁটে জিম্বাবুয়েতে পৌঁছান।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ১৩৫তম দেশ হিসেবে ভ্রমণ করেন কোস্টারিকা।

নাজমুন স্কুল
কলেজ শিক্ষার পাঠ লক্ষ্মীপুরে শেষ করেছেন। এর পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ২০০৬ সালে শিক্ষা
বৃত্তি নিয়ে সুইডেনের লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যান এবং এশিয়ান স্টাডিজ বিষয়ে
উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। এছাড়া তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ‘হিউমান রাইটস অ্যান্ড
এশিয়া’ বিষয়ে স্কলারশিপ পেয়ে আরেকটি ডিগ্রি অর্জন করেন।

উপাধি ও
পুরস্কারের ঝুলি দিন দিন ভরে উঠেছে নাজমুনের। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে পেয়েছেন আন্তর্জাতিক
‘পিচ
টর্চ অ্যাওয়ার্ড,’ ও ‘ডটার অব দ্য
আর্থ’ উপাধি। এর আগে পেয়েছেন ‘অনন্যা
শীর্ষ দশ অ্যাওয়ার্ড,’ ও ‘তারুণ্যের
আইকন’ উপাধি, ‘আর্থ কুইন অ্যাওয়ার্ড,’
‘গেম চেঞ্জার আওয়ার্ড,’ ‘অতীশ দীপঙ্কর
আওয়ার্ড,’ ‘রেড ক্রিসেন্ট মোটিভেশনাল অ্যাওয়ার্ড’।

নাজমুনের জন্মই হয়েছে যেন ভ্রমণের মাধ্যমে বিশ্বমানবতার কাছাকাছি পৌঁছানো ও মানুষের জন্য কাজ করে যাওয়ার জন্য। দু’শো দেশের মাটিতে পা রাখার স্বপ্ন দেখা বিশ্বপরিব্রাজক এই মানবীকে পর্যটনিয়া পরিবার জানাচ্ছে জন্মদিনের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা।

Leave a Reply