স্কুবা ডাইভিং চালু করার জন্য দরকার গবেষণা

Share on Facebook

মুজিবুর রহমান

মুজিবুর রহমান। শৈশবে মানিকগঞ্জ জেলা শহরের বড়ব্রীজ থেকে স্থানীয় নদীতে ঝাঁপ দেয়ার মধ্যে দিয়ে দুরন্তপনা শুরু। এরপর এডভেঞ্চার আর সাদা পোশাকের প্রতি তীব্র ভালোবাসা থেকে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীতে কর্মজীবন শুরু। নৌ বাহিনীতে কর্মরত থাকা অবস্থায় দীক্ষা নেন স্কুবা ডাইভিং’র উপর। অবসর জীবনে তিনি ২০০৭ সালে গড়ে তোলেন ডাইভারদের সংগঠন ঢাকা ডাইভার্স ক্লাব। ডাইভিং’র উপর উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তিনি জার্মানি যান। সেখানে ডাইভিং ইন্সট্রাকটর ওয়ার্ল্ড এ্যাসোসিয়েশন ডাইভার্স ইন্সটিটিউট থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে আসেন। তিনি বর্তমানে “ডাইভিং ইন্সট্রাকটর ওয়ার্ল্ড এ্যাসোসিয়েশন”র কান্ট্রি ডিরেক্টর। এছাড়াও তিনি দেশের সেরা সাঁতারুদের মধ্যেও অন্যতম। তিনি একে একে দুইবার পাড়ি দিয়েছেন বাংলা চ্যানেল। পর্যটনিয়ার সাথে স্কুবা ডাইভিং নিয়ে একান্ত আলাপে মুজিবুর রহমান –

পর্যটনিয়াঃ শুভ সকাল। কেমন আছেন।

মুজিবুরঃ আলহামদুলিল্লাহ্‌। আপনি কেমন আছেন।

পর্যটনিয়াঃ আলহামদুলিল্লাহ্‌। স্কুবা ডাইভিং নিয়ে কথা বলতে এসেছি। স্কুবা ডাইভিং আসলে কী?

মুজিবুরঃ স্কুবা ডাইভিং কী সেটা বলার আগে বলে নেই ডাইভিং দুই রকম। একটা হলো স্কুবা (SCUBA) ডাইভিং আরেকটা হলো সারফেস সাপ্লাইড বা এসডিডিই ডাইভিং। এসডিডিই (SDDE) ডাইভিং হলো সার্ফেস ডিমান্ড ডাইভিং ইকুইপমেন্ট নিয়ে যে ডাইভ দেয়া হয়। অর্থ্যাত সারফেস সাপ্লাইড ডাইভিং’এ পানির নিচে যদি ডাইভারের কোনো সমস্যা হয় তাহলে সেটা পানির উপর থেকেও সমাধান করা যায়। যেমনঃ যদি ডাইভারের অক্সিজেন শেষ হয় তাহলে পানির নিচে ডাইভারের কাছে অক্সিজেন সাপ্লাই দেয়া যায়। আর স্কুবা ডাইভিং হলো, সেলফ কন্টেইন্ড আন্ডার ওয়াটার ব্রিদিং এপারেটাস। একজন মানুষ অক্সিজেনের সিলিন্ডার বহন করে পানির নিচে শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণ করার মাধ্যমে যে ডাইভিং দেয় তাকে স্কুবা ডাইভিং বলে। স্কুবা ডাইভিং’এ ডাইভারের অক্সিজেন শেষ হলে নিচে থেকে সাপ্লাই দেয়ার সুযোগ নাই।

পর্যটনিয়াঃ স্কুবা ডাইভিং কি তাহলে পর্যটকদের জন্য যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ?

মুজিবুরঃ সংজ্ঞাগত দিক দিয়ে প্রাথমিকভাবে বলা যেতে পারে সার্ফেস সাপ্লাইড ডাইভিং স্কুবা ডাইভিং’র চেয়ে কিছুটা সুবিধাজনক। কিন্তু তাই বলে স্কুবা ডাইভিংকে ঝুঁকিপূর্ণ বলা ঠিক হবে না। পর্যটকদের সুবিধার জন্য স্কুবা ডাইভিং’এ একজন পর্যটকের সাথে একজন করে ইন্সট্রাক্টর থাকে। পর্যটক যতক্ষণ পানির নিচে থাকবে ইন্সট্রাক্টরও ততক্ষণ পানির নিচে থাকবে। তাই ভয় পাওয়ার কিছু নাই।

পর্যটনিয়াঃ স্কুবা ডাইভ কি যেকেউই দিতে পারে?

মুজিবুরঃ স্কুবা ডাইভিং দেয়া হচ্ছে কোন উদ্দ্যেশে তার উপর নির্ভর করবে যেকেউই স্কুবা ডাইভ দিতে পারবে কি-না। রিক্রিয়েশনাল ডাইভ বয়স আর শারীরিক ফিটনেস থাকলে হয়তো যেকেউই দিতে পারবে কিন্তু প্রফেশনাল ডাইভ যেকেউ দিতে পারবে না। প্রফেশনাল ডাইভ দেয়ার জন্য যথেষ্ট প্রশিক্ষণ থাকা জরুরী। কোনো পর্যটক যখন স্কুবা ডাইভ দিতে যায় তখন তার উদ্দ্যেশ্য থাকে সাগরের তলদেশে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ দেখা, নানা রকমের প্রবাল দেখা বা জীববৈচিত্র দেখা। মোটকথা পর্যটকের ডাইভিং হলো রিক্রিয়েশনাল ডাইভিং তথা বিনোদনের জন্য ডাইভিং। কিন্তু প্রফেশনাল ডাইভিং এর উদ্দেশ্য কিন্তু বিনোদন নয়। প্রফেশনাল ডাইভারদের সবসময় একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকে পানির নিচের নানা রকম তথ্য সংগ্রহ করা। এই তথ্যের উপর ভিত্তি করেই হয়তো নির্মান করা হবে কোনো নদীর উপর কোনো ব্রীজ, কোনো পাওয়ার স্টেশন অথবা কোনো নদী বা সমুদ্রবন্দর। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, প্রফেশনাল ডাইভারদের জন্য নানা রকম প্রশিক্ষণের দরকার আছে।

পর্যটনিয়াঃ তাহলে তো পর্যটকদের জন্যেও মোটামুটি একটা প্রশিক্ষণ দরকার আছে, কী বলেন?

মুজিবুরঃ হ্যাঁ, পর্যটকদের জন্যেও একটা মোটামুটি প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা আছে। তবে সেই ট্রেনিং তেমন জটিল কিছু নয়। পর্যটকদের সাথে যেহেতু পানির নিচে একজন করে ইনস্ট্রাকটরও নামে তাই পর্যটকের প্রশিক্ষণ মূলত কিছু সিগন্যাল বুঝতে পারার প্রশিক্ষণ। পানির নিচে যেহেতু কথা বলার সুযোগ নাই তাই সিগন্যাল দিয়ে আলাপ চালিয়ে নিতে হয়। ননভারবাল কমিউনিকেশন চালানোর জন্য কিছু ইশারা ইঙ্গিতই মূলত প্রশিক্ষণ।

পর্যটনিয়াঃ প্রফেশনাল ডাইভারদের জন্য কেমন প্রশিক্ষণের দরকার?

মুজিবুরঃ প্রফেশনাল ডাইভারদের জন্য একেবারে প্রথম ধাপের যে প্রশিক্ষণ দরকার তার নাম হলো, বেসিক স্কুবা ডাইভিং কোর্স। এরপর আছে এডভান্স স্কুবা ডাইভিং কোর্স, মাস্টার স্কুবা ইনস্ট্রাকটর কোর্স, কোর্স ডাইরেক্টর ইত্যাদি। কোর্স ডাইরেক্টর কমপ্লিট করার পর চাইলে যেকেউ স্কুবা ডাইভিং সম্পর্কে যেকোনো কোর্স পরিচালনা করতে পারবে।

পর্যটনিয়াঃ পর্যটকদের ডাইভিং এর জন্য একজন করে ইনস্টারক্টর দরকার। দেশে কি যথেষ্ট ইনস্ট্রাক্টর আছে?

মুজিবুরঃ দেশে যথেষ্ট ইনস্ট্রাক্টর নাই। তবে ইনস্ট্রাকটরের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। আমাদের দেশে যেহেতু স্কুবা ডাইভিং এখনো সেভাবে চালু হয় নাই তাই সেজন্য স্কুবা ডাইভার সংকটের কথাও বলা যাচ্ছে না। তবে পর্যটনের বাইরেও স্কুবা ডাইভারের প্রয়োজনীয়তা আছে, রাষ্ট্রের নানা কাজে তাই ডাইভার তৈরীও হচ্ছে। নদীবন্দর তৈরী করতে বা কোনো নদীর উপর ব্রীজ নির্মান করতে নদীর তলদেশ সম্বন্ধে অনেক তথ্য দরকার হয়, এগুলো কাজে ডাইভারের কোনো বিকল্প নাই। দেশের উন্নয়নের সাথে রাস্তাঘাট, ব্রীজ, বন্দর বাড়ছে, ডাইভারও বাড়ছে চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে।

পর্যটনিয়াঃ পর্যটনে বাংলাদেশে স্কুবা ডাইভিং এর ভবিষ্যৎ কেমন?

মুজিবুরঃ বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপে স্কুবা ডাইভিং এর যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। কিন্তু বছরের মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে সাগর উত্তাল থাকে তাই সে সময়ে সেখানে স্কুবা ডাইভিং করা খুব ঝুঁকিপূর্ণ। সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাইরে কাপ্তাই লেক আছে সেখানেও করা যেতে পারে, এছাড়াও টাংগুয়ার হাওর, বগালেক বা লালা খালেও স্কুবা ডাইভিং চালু করা যায় কি না গবেষণা করে দেখা যেতে পারে। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ, এদেশের অনেক নদীর পাশ দিয়েই আজকাল পর্যটন গড়ে উঠছে। সুতরাং নদী ভিত্তিক পর্যটন ও স্কুবা ডাইভিং’এ ভবিষ্যৎ বেশ ভালো বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।

পর্যটনিয়াঃ যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা স্বত্বেও স্কুবা ডাইভিং চালু হচ্ছে না কেন?

মুজিবুরঃ দেখেন, স্কুবা ডাইভিং এর জন্য বিভিন্ন ধরণের ইকুইপমেন্ট দরকার হয়। এই ইকুইপমেন্টগুলো বেশ ব্যায়বহুলও। একজন পর্যটকের সাথে যেহেতু একজন করে ইনস্ট্রাকটর যেতে হয় তাই ইকুইপমেন্ট দরকার হয় দ্বিগুণ। আমার ধারণা এই সময়ে স্কুবা ডাইভিং চালু করার জন্য বিনিয়োগকারীরা খুব একটা আগ্রহ দেখাবে না। কারণ বছরে তিন চার মাস ব্যবসা করে বাকি আট নয় মাস বসে থাকলে বিনিযোগকারী তার রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট খুব একটা পাবে না। যা পাবে তা যথেষ্ট হবে না। আবার অল্প বিনিয়োগ করেও স্কুবা ডাইভিং ব্যবসা পরিচালনা করা সম্ভবও না। এজন্যই ওয়াটার স্পোর্টস হিসেবে স্কুবা ডাইভিং চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।

পর্যটনিয়াঃ তাহলে আমাদের আশপাশের দেশ যেমন ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপ বা থাইল্যান্ডের পাতায়ার মতো আমাদের দেশে স্কুবা ডাইভিং পরিচালনা করার জন্য কী করা যেতে পারে?

মুজিবুরঃ দেখেন পাতায়া বা বালি দ্বীপে সারাবছরই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকেই পর্যটক আসা-যাওয়া করে। এই পর্যটন গন্তব্যগুলো আমাদের সেন্টমার্টিন দ্বীপের মতো বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বন্ধ থাকে না। সুতরাং সেখানে স্কুবা ডাইভিং ব্যবসা চালু রাখতে বিনিয়োগকারীকে কোনো বেগ পেতে হয় না। ঐসব গন্তব্যগুলোতে বিনিয়োগে ঝুঁকি নাই বললেই চলে। বিনিয়োগকারী তার মুনাফা অর্জন করে ডাইভারদের বেতন ভাতাও দিতে পারছে। আমাদের দেশে স্কুবা ডাইভিং চালু করার জন্য গবেষণা করতে হবে।

যদি গবেষণা করে দেখা যায় আমাদের বগা লেক, কাপ্তাইলেক বা টাংগুয়ার হাওর স্কুবা ডাইভিং করার জন্য উপযুক্ত জায়গা তাহলে অফ সিজনে হয়তো সেন্টমার্টিন থেকে এই স্পটগুলোতে এসে স্কুবা ডাইভিং চালু করলে বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ ঝুঁকির মধ্যে পরবে না। যেহেতু আমাদের দেশে অনেক নদী আছে, লেক আছে হাওর আছে, এগুলোকে কেন্দ্র করে পর্যটনও গড়ে উঠছে দ্রুত, স্কুবা ডাইভিং করার মতো পরিবেশ খুঁজে পেলে পৃথিবীর বাকিসব দেশের মতো আমাদের দেশেও স্কুবা ডাইভিং চালু থাকবে সারাবছর।

পর্যটনিয়াঃ আশাকরি সরকার গবেষণা করে স্কুবা ডাইভিং চালু করার পরিবেশ প্রতিবেশ খুঁজে বের করবে। বাংলাদেশের পর্যটনে ওয়াটার স্পোর্টস হিসেবে স্কুবা ডাইভিং খুব শীঘ্রই যুক্ত হোক। সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ মুজিবুর ভাই।

মুজিবুরঃ আপনাকে ধন্যবাদ।

Leave a Reply