ভাবমূর্তি ও ভূমিকা: করোনাকালে পুলিশ

Share on Facebook

অনেক দিন আগের কথা। মানুষ তখন আর গাছের কোটরে বাস করত না, কিন্তু আমি কলেজ হোস্টেলে বাস করতাম।

এইচএসসি পরীক্ষায় রেওয়াজ অনুযায়ী আমাদের সরকারি তিতুমীর কলেজে সিট পড়ে। মফস্বলের ছেলে, আমাদের কাছে হোস্টেল ছিল অনেকটা এতিমখানার মতোই। সবই করতে হতো নিজ দায়িত্বে। হোস্টেলে মাসিক ৩০০ টাকা জমা দিয়ে দুই বেলা খাওয়ার সুবন্দোবস্ত থাকলেও সকালের নাস্তা তৈরি হতো না। ফলে সারা বছরই শম্ভুদার ওপর নির্ভর করতে হতো। পরীক্ষার সময়ও শম্ভুদা নীলক্ষেত রেস্টুরেন্ট থেকে নাস্তা এনে খাওয়াত। নাস্তা শেষ করে দলে দলে কলেজের সামনে পার্কিং থেকে ৮–১০ জন একেকটি টেম্পো রিজার্ভ করে পরীক্ষাকেন্দ্রের উদ্দেশে রওনা হতাম।

সারা রাস্তায়ই হইচই করতাম।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর গেটে এসে দেখতাম টেম্পো দাঁড়িয়ে আছে। ফেরার পথে অকারণ চিৎকার–চেঁচামেচি বেড়ে যেত। পরীক্ষার ক্লান্তি আর হোস্টেলে ফিরলেই ডাইনিং রুমে গরম ভাত আর অমৃতের মতো সুস্বাদু এক টুকরো মাছ কিংবা মাংসের ঝোল। ডালে তো কোনো রেশনিং নেই। পঞ্চম কিংবা ষষ্ঠ পরীক্ষা শেষে চার–পাঁচটি টেম্পোতে হইচই করতে করতে ফিরছিলাম। অন্যান্য দিনের মতোই অকারণে মহাখালী রেলগেটের পুলিশের কয়েকজন সদস্যকে ‘ঠোলা’, ‘ঠোলা’ বলে গালি দিচ্ছিলাম। পুলিশের সদস্যরা উত্তেজিত না হয়ে হাসছিলেন।

আমাদের এক বন্ধু এতে উত্তেজিত হয়ে হাতের নাগালে থাকা এক পুলিশ সদস্যকে ঘুষি মারে। এবার পুলিশও উত্তেজিত হয়, আমরা পালিয়ে আসতে পারলেও পুলিশ ওই টেম্পোর ছাত্রদের আটক করে। তখন তো আর মুঠোফোন ছিল না, আমরা কলেজে ফিরে কর্তৃপক্ষকে জানালে, তাদের মধ্যস্থতায় বন্ধুরা ছাড়া পায়।

আমার সন্দেহ কিছু উত্তম মধ্যম দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ওই বন্ধুরা অস্বীকার করায় সেটি রহস্যই থেকে গেছে। ফাইনাল পরীক্ষার আগেও হরতাল–অবরোধে (তখন প্রায়ই ৪৮ বা ৭২ ঘণ্টা হরতাল হতো) রাস্তায় এসে অকারণেই পুলিশকে আধলা ইট মারতাম। আর গালিগালাজ তো ফ্রি। ঠোলাই ছিল বোধ হয় ওই সময়কার সবচেয়ে ভদ্রোচিত গালি। পরীক্ষা শেষে অফুরন্ত সময়, হোস্টেলে থাকার সুযোগ নেই। রেজাল্ট বেরোতে দেরি হবে, ঢাকায় থাকার জায়গা নেই, অগত্যা বাড়িতে। খাই, দাই আর মনের সুখে ঘুরে বেড়াই। একদিন শুনলাম, পুলিশের সিআই আসবে, প্রবল উত্তেজনা। অবশেষে সিআই সাহেব এলেন, চেয়ারম্যান চাচার বিরুদ্ধে সরকারি গম আত্মসাতের গুরুতর অভিযোগ। আমাদের পুরোনো বাড়িতে তখন সরকারি গম গুদামজাত করা হতো। কাজেই সেই বাড়িতে স্টক চেকিং হলো সবার সামনেই। স্টক সঠিক, অভিযোগ বিদ্বেষপ্রসূত।

বাড়ির উঠানে সিআই (ওসি-ইন্সপেক্টর) সাহেবকে ঘিরে এলাকার গণ্যমান্যরা গল্পগুজবে মত্ত। সিআই সাহেব গল্প করছেন যে প্রতিরাতেই নৌকা ভরে ভরে আত্মসাৎ করা সরকারি গম সিন্ধির ঘাটে মহাজনের গুদামে যায়। আমার কাছে বিষয়টি গোলমেলে লাগে। আমি বলি যে যদি জানেনই, তাহলে ধরেন না কেন। প্রশ্নটা সহজ, কিন্তু উত্তরটা যা আসে তাতে উপস্থিত সবাই বিচলিত হয়। আমার মা–বাপ তুলে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে ওঠেন সিআই সাহেব। কলেজে পরীক্ষা শেষ, এলাকার সবাই খুবই ভদ্র ছেলে বলে জানে। উপস্থিত সবাই ব্যথিত হয়, কিন্তু সিআই সাহেব বলে কথা। তবে আমি প্রতিবাদ করি, সঙ্গে আমার আরেক সহপাঠী আত্মীয়। আমি তো প্রায় গ্রেপ্তারই হয়ে যাই, কিন্তু সবার বিশেষ অনুরোধে সিআই সাহেব দয়াপরবশ হয়ে আমাকে ছেড়ে দেন। এখনো সেই দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভাসে, বিনা কারণে এতটা অপমান আমার জীবনে আমাকে আর কেউ করেনি।

পুলিশে চাকরির বিষয়ে বরাবরই আমার মায়ের মত ছিল না। মায়ের কথা ছিল, পুলিশের চাকরিতে মানুষ খারাপ হয়ে যায়। যাইহোক, চাকরিতে যোগদানের পর যখন ট্রেনিংয়ে যাই, তখনো মায়ের কথা ছিল, যেন গালিগালাজ না শিখি। ট্রেনিংয়ের ছুটিতে যখন বাড়িতে গেছি, তখন অনেকেই প্রশ্ন করত, কী কী গালি শেখায়। পুলিশের ট্রেনিং সিলেবাসে যে ‘আদর্শ গালি শিক্ষা’ নেই, এটা অনেকেই বিশ্বাস করত না। যেকোনো চাকরিতে যোগদানের আগে বোধ হয়, ব্যতিক্রম ছাড়া সবারই এক ধরনের ‘idealistic attitude’ থাকে। আমারও তা ছিল, কিন্তু প্রশিক্ষণকালে নিয়মকানুনের সঙ্গে আগেকার ধ্যান-ধারণার একটা সংঘর্ষের মধ্য দিয়েই একজন মানুষ ধীরে ধীরে পুলিশে পরিণত হয়।

প্রশিক্ষণলদ্ধ জ্ঞান নিয়ে একজন যখন মাঠে কাজ করতে যায়, তখন দেখা যায় যে বইয়ে পড়া আইনকানুন আর অনগ্রাউন্ড বাস্তবতা আলাদা। আমার ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটেছে, দেখতে দেখতে চব্বিশ শেষ করে পঁচিশ বছর পূর্ণ করতে যাচ্ছি। গালি শেখা কিংবা গালি দেওয়া কোনোটাই আমার হয়ে ওঠেনি, সবার সঙ্গে মার্জিত ব্যবহারেরই চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন ইউনিটে চাকরিকালে আমার সহকর্মীদেরও সেভাবে চালানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সন্তুষ্ট হতে পারিনি। পুলিশের আচরণে পরিবর্তন আনাটাই ছিল সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং, যেটা সন্তোষজনক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। মানুষকে হয়রানি, অকারণ দুর্ব্যবহার, সামান্য কারণে তুই–তোকারি কিংবা গালিগালাজ বন্ধ করাটা যথেষ্টই কষ্টকর ছিল।

১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে Robert Peel যে বলে গিয়েছিলেন,
‘The police are the public and the public are the police…’।

এত বছরেও আমরা তা হতে পারিনি। আমরাই দাবি করি যে ‘পুলিশ জনতার বন্ধু’, কিন্তু বন্ধুত্ব তো একপক্ষীয় নয়। মানুষ পুলিশকে বন্ধু ভাবতে পারেনি। ফলে চাকরিতে যোগদানের আগে পুলিশ সম্পর্কে যে perception ছিল, তা বলা যায় অনেকটাই অপূর্ণ ছিল। সন্দেহ নেই যে ২৪–২৫ বছর আগে পুলিশের যে অবস্থা ছিল, তার অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। সরকারি উদ্যোগ, পুলিশ নেতৃত্বের বিরামহীন প্রচেষ্টা, মানুষের সচেতনতাবোধ, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নজরদারি ও চাপ ইত্যাদি কারণে পুলিশের সব দায় মওকুফের দিন অনেক আগেই শেষ হলেও প্রকৃত অর্থে পুলিশ জনগণের বন্ধু হয়ে উঠতে পুরোপুরি পারেনি। চলতি বছরের শুরুর দিকে পুলিশ সপ্তাহের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল, ‘মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার, পুলিশ হবে জনতার’। এই স্লোগান শুনে অনেকে টিপ্পনি কেটেছে, পুলিশ কি তাহলে এত দিন জনতার পুলিশ ছিল না! আর যদি এত বছরে তা না হয়ে থাকে, তবে মাত্র এক বছরে কীভাবে জনতার পুলিশ হবে। আমি তো বলি, না, প্রকৃতপক্ষেই পুলিশ জনতার পুলিশ ছিল না। তবে আমার মনেও সন্দেহ ছিল, মাত্র এক বছরে পুলিশের পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব! শতাব্দীর চলমান অভ্যাসগুলো রাতারাতি বদলে ফেলে জনতার পুলিশে পরিণত করার কাজটি অসম্ভব না হলেও নিতান্তই কঠিন।

করোনার এই নিদানকালে দেখতে পাই, পুলিশের কনস্টেবল একা পরিত্যক্ত লাশ ভ্যানে তুলে নিজে ভ্যান চালিয়ে থানায় নিয়ে যাচ্ছেন। দেখি, সংজ্ঞাহীন বৃদ্ধার সাহায্যে পথচারী কেউ না এগোলেও পিপিই পরিহিত পুলিশ সদস্য বৃদ্ধার মাথায় পানি ঢালছেন। করোনার সন্দেহে মৃতদেহের সৎকারে কেউ এগিয়ে আসছে না, পুলিশ সদস্যরা কবর খুঁড়ে জানাজা শেষে দাফন করছেন। বাড়িওয়ালা কিংবা অন্য ভাড়াটিয়া চিকিৎসাকর্মী কিংবা অন্য কোনো ফ্রন্ট লাইনারকে বাড়ি ছাড়ার চাপ দিচ্ছে, সেখানেও পুলিশ। ঘরে খাবার নেই, চক্ষুলজ্জার খাতিরে ত্রাণ নিতে পারছে না, গোপনে ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছে পুলিশ। মূলত হাসপাতালের দরজা থেকে কবরস্থান পর্যন্ত সবখানেই পুলিশ। প্রভু কিংবা শাসক হিসেবে নয়, বন্ধুবেশেই পুলিশ। শতাব্দীর চেনা পুলিশ হঠাৎ করেই লাপাত্তা, কোথা থেকে যেন একদল নতুন পুলিশ। অনেকের কাছেই আবার চেনা চেহারা, কিন্তু অচেনা আচরণ; যেন এক অবিশ্বাস্য পরিবর্তন। চাকরিতে যোগদানের সময় মনে মনে পুলিশের যে মূর্তি কল্পনা করেছিলাম, আজ চব্বিশ বছর পর সেই পুলিশ দেখলাম। এই পুলিশে আমি সন্তুষ্ট, এই পুলিশের একজন হিসেবে আমি এখন গর্ব বোধ করি।

জনতার পুলিশ হতে গিয়ে চ্যালেঞ্জও কম নিতে হয়নি। ইতিমধ্যে করোনায় জীবন উৎসর্গ করেছেন আট পুলিশ সদস্য। জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছেন একাধিক সহকর্মী, আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যাও আড়াই হাজার ছাড়িয়ে গেছে, প্রতিদিন যোগ হচ্ছে অন্তত তিন ডিজিটের সংখ্যা। জানি, আমাদের আরও মূল্য দিতে হবে, তবুও আপনাদের নিরাপত্তার খাতিরেই আমরা বাইরে থাকব, প্রয়োজনে আরও মূল্য দিয়েই আপনাদের বন্ধুত্ব অর্জন করব। চ্যালেঞ্জ আরও আছে, ওই যে ছেলেবেলায় পড়েছি, ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন।’ করোনাকাল একদিন শেষ হবে, পুলিশের দায়িত্বের ধরন পাল্টাবে। পুলিশও কি পাল্টে যাবে, ফিরে যাবে পুরোনো চেহারায়? করোনাকালে যে নতুন পুলিশের জন্ম হয়েছে, জনতার পুলিশে পরিণত হয়েছে, তা ভবিষ্যতে ধরে রাখাটাই পুলিশ নেতৃত্বের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। আমি বিশ্বাস করতে চাই, আমি বিশ্বাস করি, জনতার পুলিশ জনতার দিকেই থাকবে, জনগণের সঙ্গে বন্ধুত্বটা আরও পাকাপোক্ত হবে।

পুলিশ তো আজ জনতার কাছে এসে গেছে, জনতা কি এখন পুলিশকে সহযোগিতা করবেন না? আপনারা কি চান না, করোনায় আর কোনো পুলিশ সদস্যের মৃত্যু না হোক, আর কোনো স্ত্রী স্বামী বা সন্তান পিতা কিংবা মা সন্তানকে না হারাক? আপনারা কি চান না, পুলিশ আক্রান্তের সংখ্যা শূন্যে নেমে আসুক? যদি তা–ই চান, তাহলে পুলিশের কাজ কমিয়ে দিন, অতি প্রয়োজন ছাড়া ঘরেই থাকুন, যে যেখানে আছেন সেখানেই ঈদ করুন। করোনায় বেঁচে থাকলে জীবনে অনেক ঈদ করতে পারবেন, শপিং করতে পারবেন। জানি, আপনারা কষ্ট করেছেন, আর কয়েকটা দিন কষ্ট করুন। নতুন সকাল আসবেই। একদিন ঘুম থেকে জেগে শুনবেন, কোনো একটা করোনা ভ্যাকসিনের পরীক্ষায় সফলতা এসেছে, করোনার ওষুধ বেরিয়ে গেছে।

পৃথিবীর নানা প্রান্তে পরীক্ষা চলছে, সাফল্য সময়ের ব্যাপার মাত্র। করোনা নখদন্তহীন হয়ে যাবে। কিন্তু যত দিন তা নয়, তত দিন—
১. ঘরে থাকা মানেই করোনামুক্ত থাকা, করোনাকে এড়িয়ে যাওয়া;
২. প্রয়োজনে বাইরে গেলে মাস্ক পরুন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন;
৩. বাইরে গেলেই আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়বেই, সে ক্ষেত্রে করোনা মোকাবিলার শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করুন;
৪. করোনা ভয়ানক সংক্রামক হলেও প্রাণঘাতী নয়, কাজেই আক্রান্ত হলেও মনোবল না হারিয়ে করোনাকে পরাজিত করুন;
৫. হাঁচি, কাশির শিষ্টাচার মেনে চলুন, আশপাশের লোককে বাঁচান;
৬. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ মেনে চলুন;
৭. আপনার সুস্থতা আপনার কাছেই, তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। নিজে বাঁচুন, পরিবার ও প্রতিবেশীকে বাঁচান।

আমি বিশ্বাস করি, সুদিন আর বেশি দূরে নয়, করোনার বিরুদ্ধে মানুষের জয় হবেই। কেননা ‘বুকের গভীরে আছে প্রত্যয়, আমরা করবো জয়! একদিন…।’

মনিরুল ইসলাম: অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (কাউন্টার টেরোরিজম ও ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান), ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, ঢাকা।

Leave a Reply