নবরুপে বিশ্ব পর্যটন

Share on Facebook

করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। লকডাউনের জেরে বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় সব পর্যটন গন্তব্য। করোনার ধকল কাটিয়ে উঠতে পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়েছে নানা পরিকল্পনা। কারণ করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আসতে আরও অন্তত: তিন বছর লাগতে পারে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সহ বিভিন্ন দেশের গবেষক ও বিজ্ঞানীরা আভাস দিয়েছেন। এ কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিকল্প উপায়ে নতুন নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে অনেক প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শন। শুধু তাই নয়, রয়েছে অনেক মনোরম প্রাকৃতিক আকর্ষণও। সারা বছরই পর্যটকরা এখানে ছুটে যান একটু প্রশান্তির জন্য। তবে করোনার কারণে পর্যটকবিহীন রয়েছে এসব পর্যটন গন্তব্য। পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক অবস্থাও করোনার কারণে টালমাটাল। তাই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে নতুন গতি দিতে বেশ কিছু পরিকল্পনা নিয়েছেন পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো। এর মধ্যে রয়েছে এয়ারলাইন্স, বিমান, হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট, ট্রাভেল এজেন্সী ও ট্যুর অপারেটর কোম্পানী।
সবাই নতুন নতুন নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। নিজেদের কাজের জন্য এবং পর্যটকদের আকর্ষণ করতেই বিশেষ প্যাকেজের ব্যবস্থা করছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা। এছাড়াও তথ্যপ্রযুক্তির প্রচুর ব্যবহার তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে পর্যটন শিল্পের উন্নতি ঘটাতেই এই পদক্ষেপগুলো নেওয়া হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী এয়ারপোর্টগুলোতে ইতিমধ্যেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নানা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। পুরো এয়ারপোর্ট জুড়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার এবং টার্মিনালগুলোতে যাত্রীদেরকে নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থান করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

যাত্রীদের মধ্যে সব সময় এক বা দুই মিটার দূরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি সিকিউরিটি স্ক্রিনিং-এর আগে ও পরে যাত্রীদের ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধোয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, যাত্রীদের পুরো শরীর জীবানুমুক্ত করার যন্ত্রও ব্যবহার করা হচ্ছে। এ যন্ত্র থেকে একটি স্প্রে যাত্রীর গায়ে ছিটিয়ে দেয়া হচ্ছে, যা যাত্রীর ত্বক ও পোশাকের যে কোনো ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া থাকলে মাত্র ৪০ সেকেণ্ডে তো ধ্বংস করে ফেলবে।

কিছু কিছু এয়ারপোর্টে এমন রোবট ব্যবহার করা হচ্ছে, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘুরে ঘুরে পরিস্কার করার কাজ করতে থাকবে। কোনো ভাইরাসের উপস্থিতি টের পেলে আলট্রাভায়োলেট রশ্মি দিয়ে আঘাত হেনে তাদের ধ্বংস করবে। যেসব এয়ারপোর্টে ইলেক্ট্রনিক চেক-ইন-এর যন্ত্র রয়েছে, যাত্রীদের জন্য সেগুলো ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। বেশির ভাগ এয়ারপোর্টে যাত্রীদের জন্য করোনায় স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বিসয়ক বিভিন্ন ধরণের নির্দেশিকা সম্বলিত বিলবোড বা পোস্টার সেঁটে দেয়া হয়েছে।

শুধু তাই নয়, বিভিন্ন এয়ারপোর্টে যাত্রীদের তাপমাত্রা মাপা এবং করোনা টেস্টের ব্যবস্থাও করা হয়েছে, যাতে ১০ মিনিটের মধ্যে ফল জানা সম্ভব হবে। যদিও এসব স্বাস্থ্য-বিধি মেনে ভ্রমণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে যাত্রীদের বিমানবন্দর পার হতে আগের চেয়ে বেশি সময় লাগছে। তবুও এ সময়ে এর কোনো বিকল্পও দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা।

বিমানের ভেতরে ফ্লাইট এটেনডেন্টদের মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যাত্রীদেরও মাস্ক পরে থাকতে হবে। যাত্রীর ট্রে-টেবিল, সিটের হাতল ও সেফটি বেল্ট জীবানুমুক্ত করা বাধ্যতামূলক। কেবিন ক্রদের গাউন, গ্লাভস এবং আই মাস্ক বাধ্যতামূলকভাবে পরতে হবে। এয়ারলাইন্সগুলো সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার অংশ হিসেবে বিমান পুরোপুরি ভর্তি না করে মাঝখানের সিট খালি রাখার ব্যবস্থা করেছে।
আরও একধাপ এগিয়ে ইমিউনিটি পাসপোর্ট চালু করার কথাও ভাবছে কোনো কোনো দেশ।
তবে এর জন্য এয়ারলাইন্সগুলোকে বড় অংকের লোকসানও গুনতে হচ্ছে। আবার লোকসান কমাতে কেউ কেউ বিমানের ভাড়া বাড়িয়ে দেয়ার কথাও ভাবছে। আবার বিপরীত চিত্রও দেখা গেছে কোনো এয়ারলাইন্সের ক্ষেত্রে। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স তো সড়কপথের গাড়ি ভাড়ার চেয়েও কম ভাড়ায় ডমেস্টিক ফ্লাইটে যাত্রী পরিবহনের ঘোষণা দিয়েছে।
এদিকে হোটেলগুলো সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার অংশ হিসেবে অতিথিদের এক রুম পর পর থাকতে দেয়ার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে ভাবছে। অনেকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হোটেল কর্মী ও অতিথিদের হাত পরিস্কার করার বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছে। তবে রিসোটগুলোতে বুফে খাবার, সুইমিংপুল এবং বার খোলা না রাখার বিষয়ে অধিকাংশ মালিক মত দিচ্ছেন। অনেক রেস্টুরেন্ট তাদের খাবার টেবিলগুলো সুনির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বসানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। একইভাবে ট্রাভেল এজেন্সী ও ট্যুর অপারেটর কোম্পানীগুলোও সামাজিকদূরত্ব বজায় রেখে এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার কথা ভাবছেন।

করোনা পরবর্তী সময়ে ডমেস্টিক ট্যুরিজম বা অভ্যন্তরীণ পর্যটনের অনেকটা উন্নতি হবে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, আন্তর্জাতিক পর্যটনে খরচ বেড়ে যাবে।

এমতাবস্থায় মধ্যবিত্ত বেশিরভাগ পর্যটক -যারা বিদেশে ভ্রমণে যেতেন,এসব কারণে তারাও করোনা পরবর্তী সময়ে বিদেশে যাবেন না। বিদেশের ঝক্কি না নিয়ে নিজ দেশে ভ্রমণেই স্বাচ্ছন্দবোধ করবেন তারা। এতে আমাদের দেশের পর্যটন শিল্পে যে ক্ষতি হয়েছে তা কিছুটা হলেও পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।

দেশের সব হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টে সরকারি নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতসহ কিছু পর্যটনস্পটে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। করোনা পরিস্থিতি উন্নতি হলে সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে, তখনই পর্যটকরা ভ্রমণে বের হবেন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে নোনাবিধ পরিকল্পনা করছেন পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো।

এ বিষয়টি মাথায় রেখে আগামী শীতকালীন পর্যটন মৌসুমকে সামনে রেখে প্রস্তুতি নিচ্ছেন পর্যটনখাত সংশ্লিষ্টরা। কারণ, পুরো শীতকালীন মৌসুমটা পর্যটন ব্যবসায়ীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে পর্যটনখাতে প্রাণ সঞ্চার করার চেষ্টা যেমন থাকবে, তেমনি এ খাতের ক্ষতি পুষিয়ে নিতেও প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাচ্ছেন পর্যটনখাত সংশ্লিষ্টরা।

অপরদিকে পর্যটন সংশ্লিষ্ট মিডিয়াগুলোও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাদের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মী ও সাংবাদিকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে কিভাবে কাজ করতে হবে, সে বিষয়ে পর্যটন সংশ্লিষ্ট মিডিয়াগুলোর মালিকরা যাবতীয় নির্দেশনা দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। পর্যটন সংশ্লিষ্ট মিডিয়াগুলোর কর্মী ও সাংবাদিকদের অবশ্যই সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করছে। তারা মাস্ক পরা সহ পর্যাপ্ত পিপিই পরে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করছে। এক্ষেত্রে মিডিয়া কর্মী ও সাংবাদিকদের প্রতিদিন না হলেও অবশ্যই সপ্তাহে একদিন স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো উচিৎ।

আমি মনে করি, এ বিষয়গুলো যথাযথভাবে মেনে কাজ করলে চলমান সংকটে ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রির লোকদের স্বস্তি দেবে।

লেখক : কাজী রহিম শাহরিয়ার, প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ট্যুরিজম এন্ড এভিয়েশন মিডিয়া ফোরাম; প্রধান নির্বাহী, বাংলাদেশ ট্যুরিজম রিসার্চ ইনস্টিটিউট।

Leave a Reply