ট্যুরিজম রিকভারি প্ল্যান

Share on Facebook

পর্যটনযোদ্ধাদেরকে সঙ্গে নিয়ে ট্যুরিজম রিকভারি প্ল্যান বাস্তবায়নের জন্য সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে বাংলাদেশের পর্যটন করোনাযুদ্ধে জয়লাভ করে আবার ঘুরে দাঁড়াবে। কালক্ষেপন না করে এখনি সময় সমন্বিত ও সংযুক্তিমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণের। এই পরিকল্পনা জাতিকে নতুনভাবে বাঁচার উপায় দেখাবে। আমাদের দেশীয় সম্পদ, মানুষের মেধা ও শ্রম দিয়ে কীভাবে ঘুরে দাঁড়নো যায় তার অনেক উদাহরণ আমরা পূর্বে সৃষ্টি করেছি। জাতির পিতার দ্বিতীয় বিপ্লবের পর এবার সময় এসেছে পর্যটনকে উদ্ধার ও উন্নয়নের মধ্য দিয়ে করে তৃতীয় বিপ্লবে জয়লাভের। যুগে যুগে এদেশে জন্মেছেন অনেক ক্ষণজন্মা মানুষ যাঁরা দেশ ও মানুষের জন্য অগণিত অবদান রেখে গেছেন। তাই আমরাও পারি এই মহাদূর্যোগ থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করে একটি মর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে।

সূচনা:
করোনা একটি জনযুদ্ধ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র মতে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এই ইনফ্লুয়েঞ্জা আগামী ৩ বছর স্থায়ী হতে পারে। তবে প্রাদুর্ভাব একইরকম থাকবে না। নিরাপদ দূরত্ব ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে এর বিস্তার রোধের মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছি আমরা। কিন্তু ভাইরাসের কোন চিকিৎসা অদ্যাবধি উদ্ভাবিত না হওয়ায় এর চেয়ে বেশি কিছু করার নাই কারুরই। করোনার বিরুদ্ধে লড়াই অসম, তাই কেবলই কৌশলগত। অদ্যাবধি প্রায় পৌণে ৩ লাখ মানুষের মৃত্যুবরণের মধ্য দিয়ে এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর মানুষ। শেষ পর্যন্ত এর ফলাফল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। তবে করোনা যে সারা পৃথিবীর মানুষকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে তার আলামত আমরা ইতোমধ্যেই বুঝে গেছি। অভূতপূর্ব সামাজিক পরিবর্তনের জন্য পর্যটনে দ্রুত এর নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। আক্রমনের প্রথম ২ মাসেই ২০% পর্যটকের আগমন কমেছে। বাকী দিনে কী হবে, কেউ জানে না! তাই পতনশীল পর্যটনকে উদ্ধার করার জন্য এখনি সময় কিছু বাস্তবোচিত ও কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণের।

ট্যুরিজম রিকভারি কী?
ট্যুরিজম রিকভারি মানে পতনশীল পর্যটনকে পূনরায় পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার কতিপয় সমন্বিত ও সংযুক্তিমূলক পদক্ষেপ। তাই রিকভারির লক্ষ্য ও সময় নির্ধারণ করে সে মতো অগ্রাধিকারমূলক পর্যটন বাজারে পৌঁছুতে হবে। সাথে নিতে হবে স্টেকহোল্ডার ও প্রয়োজনীয় সাধারণ মানুষকে। তথ্যপ্রবাহ ও কৌশল বাস্তবায়নে সততার সাথে চেষ্টা করতে হবে সকলকে। দৃঢ়তার সাথে মিডিয়াকে ব্যবহার করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় তথ্য দ্রুত সরবরাহ করতে হবে। উপর্যুক্ত কাজগুলি ট্যুরিজম রিকভারির আওতাভুক্ত।

টুরিজম রিকভারিতে আমাদের করণীয়:
ট্যুরিজম রিকভারির জন্য ধাপে ধাপে পরিবর্তনশীল অবস্থা বিবেচনা করে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মাথায় রাখতে হবে যেন পর্যটকদের কাছে এইসব বিশ্বস্ততার সাথে গৃহিত হয় এবং তাদের মধ্যে ইতিবাচক মানসিক পরিবর্তন ঘটে। ট্যুরিজম রিকভারির জন্য নিচের ৭ (সাত)টি কৌশল অন্তর্ভূক্ত করা যেতে পারে-

কৌশল ১: কৌশলগত পদক্ষেপ
– পূর্বের পরিকল্পনা বাতিল করে এবং অবস্থা মূল্যায়ন করে দ্রুত নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
– দ্রুত বাজার গবেষণা করে বাস্তবোচিত টার্গেট মার্কেট নির্ধারণ করতে হবে।
– ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে প্রডাক্ট বহুমুখীকরণের দিকে নজর দিতে হবে।
– কমমূল্যের প্যাকেজ সিরিজ ঘোষণা করতে হবে।
– সরবরাহকারীদেরকে নিয়ে স্মার্ট সল্যুশনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
– নতুন বাজার কাঠামোর জন্য যে কোন ধরণের পূনর্গঠনকে স্বাগত জানাতে হবে।

কৌশল ২: আর্থিক সহযোগিতা
– নির্ধারিত সময়ে প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দেওয়া ট্যুরিজম রিকভারির অন্যতম শর্ত। তাই যে কোন মূল্যে তার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
– জনবলকে দ্রুত সংগঠিত করে গড়ে তোলার জন্য স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ, পূণঃপ্রশিক্ষণ ও কম্পিটেন্সি বেজড প্রশিক্ষণে আর্থিক সমর্থন সম্প্রসারিত করতে হবে।
– ব্যয় হ্রাস এবং অপ্রয়োজনীয় বিলাসি সেবায় অর্থের যোগান হ্রাস করতে হবে।
– ঋণের কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
– স্বল্পমেয়াদি নগদ অর্থের যোগান বৃদ্ধির জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

কৌশল ৩: মার্কেটিং
– নির্ধারিত টার্গেট মার্কেটের আস্থা ফেরানোর জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।
– কম খরচে মার্কেটিংয়ের জন্য সামাজিক মাধ্যমগুলিকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে।
– সরবরাহকারীদেরকে মার্কেটিংয়ে সম্পৃক্ত করতে হবে।
– আয় বৃদ্ধিকারক প্যাকেজগুলি বেশি বেশি মার্কেটিং করতে হবে।
– স্থানীয় এবং নিকটতম প্রতিবেশিদের বাজারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
– মার্কেটিংয়ের সময় সুরক্ষা ও নিরাপত্তাকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরতে হবে।

কৌশল ৪: কর্মী ব্যবস্থাপনা
– কর্মী ছাঁটাই পরিহার করতে হবে। প্রয়োজনে সাময়িক ছুটি দিয়ে তাদেরকে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে হবে। কারণ তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কাজে না লাগাতে পারলে রিকভারি বিলম্বিত হবে।
– কর্মীদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো ও ক্ষমতায়িত করার উদ্দেশ্যে তাদেরকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সম্পৃক্ত করতে হবে।
– কর্মীদের অবসরজনিত কারণে তাদের দক্ষতা, মনোবল ও গুরুত্ব ইত্যাদি হ্রাস পেতে পারে। তাই তাদের জন্য কম্পিটেন্সি বেজড প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে।
– কর্মীদের মানসিক শক্তি মূল্যায়ন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
– প্রয়োজনে কর্মীদেরকে সাময়িকভাবে অন্যত্র কাজে যুক্ত করা যেতে পারে।

কৌশল ৫: অপারেশন
– আপাতত নমনীয় ক্যানসেলেশন পলিসি গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে গ্রাহকদের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হবে যা ভবিষ্যত ব্যবসায়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
– অপ্রয়োজনীয় কর্মকান্ড পরিচালনা হ্রাস বা বন্ধ করতে হবে। যেমন ৪ তলা হোটেলের প্রয়োজনীয় ফ্লোর বাদে বাকীগুলি বন্ধ করে দিতে হবে কিংবা রেস্টুরেন্টের একধিক আউটলেট থাকে অপ্রয়োজনীয় আউটলেট বন্ধ করে দিতে হবে।
– কোন পর্যটক অসুস্থ হলে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে হসপিটালে পাঠানোর সেবা চালু করতে হবে।
– পরিচ্ছন্নতা ও সেনিটেশন ব্যবস্থা বাড়াতে হবে।
– ভয় দূর করার জন্য প্রযুক্তিগত ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে।
-সুরক্ষা ও পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে গ্রাহকের আস্থা অর্জনের জন্য তাদের সেন্টিমেন্ট বুঝে কাজ করতে হবে।

কৌশল ৬: জনগোষ্ঠী
– সাধারণ ও স্বাগত জনগোষ্ঠীর নিকট পর্যটনের গুরুত্বের কথা তুলে ধরে পর্যটকদেরকে স্বাগত জানানোর জন্য তাদেরকে পুনরায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
– কোন পর্যটক অস্স্থু হলে তারা কীভাবে পদক্ষেপ নিবেন সে বিষয়ে সচেতন করতে হবে।
– পর্যটনের জন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের সাথে স্বাগত জনগোষ্ঠীর অন্তঃসম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে।
– জনকল্যাণমূলক কাজে পর্যটনকর্মীদেরকে প্রয়োজনে বিনামূল্যে কাজে লাগাতে হবে।
– ইন্ডাস্ট্রি ও ইন্ডাস্ট্রি বহির্ভূত জনগোষ্ঠী, স্থানীয় এনজিও ইত্যাদির মধ্যকার সম্পর্ক পুনর্গঠন করতে হবে। এতে সার্বিক আস্থা বৃদ্ধি পাবে।

কৌশল ৭: যোগাযোগ
– করোনাকালে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে যথাসম্ভব একক যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রাখা উত্তম। এতে তথ্যের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।
– সঠিক, স্বচ্ছ তথ্য সময়মতো পরিবেশন করতে হবে এবং অনুমানভিত্তিক তথ্য পরিবেশন থেকে বিরত থাকতে হবে। দ্রুত উত্তর দিতে হবে যে কোন প্রশ্নের।
– যথাসম্ভব সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করতে। এতে খরচ কমে এবং দ্রুত সকলের কাছে তথ্য পৌঁছায়।
– সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত এবং সুনির্দিষ্টভাবে পর্যটনের বিষয়ক সকল তথ্য পরিবেশন করতে হবে।

ট্যুরিজম রিকভারিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা:
করোনাযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ পর্যটন শিল্পকে পুনরায় ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য রাষ্ট্রকে প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিতে হবে। তা না হলে জিডিপিতে ধস নামবে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে। রাজনৈতিক, ডলার ও অর্থনৈতিক কুটনীতি ব্যাপকভাবে মার খাবে এবং সর্বোপরি দেশে এক অরাজক সামাজিক অবস্থার সৃষ্টি হবে। এ থেকে বাঁচানোর জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে এগিয়ে এসে উপর্যুক্ত কৌশলসমূহ বাস্তবায়নের জন্য নিচের পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করতে হবে। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডকে সরকারের পক্ষ থেকে এই দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে।

ক) পর্যটনযোদ্ধাদেরকে সংগঠিত করে “ডেসটিনেশন রিকভারি প্ল্যান” তৈরি করতে হবে। পর্যটনযোদ্ধা হলো পর্যটনের সাথে প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ ও আবেশিতভাবে সম্পৃক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসমূহ।
খ) স্টেকহোল্ডাদেরকে হেলথ এন্ড হাইজিন বিষয়ক প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে, যেন ভ্রমণকারীরা পরিচ্ছন্ন সেবার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী হন। সাথে সাথে দেশে বিদেশে স্বাস্থ্যতথ্য প্রচার করাও অত্যন্ত জরুরি।
গ) চাহিদা নিরূপণ সাপেক্ষে স্টেকহোল্ডাদেরকে আর্থিক, প্রশিক্ষণ ও মানসিক সকল প্রকার সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। এই উদ্দেশ্যে একটি আপদকালীন তহবিল গঠন করা অত্যন্ত প্রয়োজন।
ঘ) দরিদ্র ও প্রান্তিক পর্যটন কর্মীদেরকে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে ধরে রাখা এবং প্রয়োজনে অন্য কোথাও সাময়িকভাবে কাজে যুক্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যে কোন মূল্যে পর্যটনকর্মীদের এই শিল্পে ধরে রাখতে হবে। কারণ এরা চলে গেলে এদের অর্জিত দক্ষতাও চলে যাবে। ফলে শিল্প আরেকটি সংকটে পড়বে।
ঙ) পর্যটন প্রতিষ্ঠানগুলিকে আগামী ২-৩ বছরের জন্য সহনীয় করনীতির আওতায় আনতে হবে।
চ) দেশীয় ও প্রতিবেশি দেশগুলিকে প্রাধান্য দিয়ে এবং সেই মোতাবেক প্যাকেজ তৈরি করে মার্কেটিংয়ের জন্য নতুন ও সমন্বিত মার্কেটিং পলিসি বাস্তবায়ন করতে হবে। বিশেষত বিদেশে বাংলাদেশের ট্যুর অপারেটরদের কাউন্টারপার্টদেরকে উৎসাহ প্রদানের জন্য ফেমিলিয়ারাইজেশন ট্রিপে আমন্ত্রণ জানানো জরুরি।
ছ) পর্যটন প্রযুক্তি ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে তরুণদেরকে পর্যটনের সাথে যুক্ত করে সমস্যা সমাধান ও উন্নয়নের নতুন পথে যাত্রা শুরু করতে হবে।
জ) সমস্ত স্টেকহোল্ডার ও স্কলারদেরকে নিয়ে ট্যুরিজম রিকভারি কার্যক্রম পর্যালোচনার জন্য একটি “জাতীয় রিকভারি মনিটরিং কমিটি” গঠন করতে হবে যার মাধ্যমে সরকারের কন্ঠ হবে দৃঢ় ও সচকিত।
ঞ) সারাদেশের পর্যটনসম্পদ ও পর্যটন প্রতিষ্ঠানগুলিকে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে সমন্বয়ের আওতায় আনতে হবে। তা না হলে সম্পদের প্রয়োজনীয় ও যথাযথ ব্যবহার করা যাবে না।

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে এ কথা পরিস্কারভাবে প্রতীয়মান হয় যে, করোনাকালে আমাদের পর্যটন যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা নানাবিধ কৌশল ও পদক্ষেপের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা সম্ভব যদি আমরা দ্রুততম সময়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করি।

 

লেখকঃ মোখলেছুর রহমান

আহবায়ক, সম্মিলিত পর্যটন জোট।

Leave a Reply