জ্যোৎস্না ছড়ানো চাঁদের গল্পে মাহফুজ

Share on Facebook

পর্যটন বিষয়ক অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘পর্যটনিয়া’ পর্যটন শিল্পের নানা সমস্যা ও সম্ভাবনা তুলে ধরে আসছে নিয়মিত। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যটন বিষয়ে অধ্যয়নরত অনেক ছাত্র-ছাত্রী যথাযথ তথ্যের অভাবে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে শঙ্কিত। সুতরাং সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে পর্যটনের সাবেক ছাত্র-ছাত্রীদের ‘ক্যারিয়ার স্টোরি’ প্রকাশ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে পর্যটনিয়া। পর্যটন বিষয়ে পড়ালেখা করে তাঁদের আজকের অবস্থান একজন ছাত্রকে হয়তো তার নিজস্ব ক্যারিয়ার গড়তে স্বপ্ন দেখাবে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সাহসী করে তুলবে। পর্যটনের সাবেক ছাত্রদের ‘ক্যারিয়ার স্টোরি’ হোক শঙ্কিত ছাত্রদের দিকনির্দেশনা আর সাহসী ছাত্রদের প্রেরণা। আমাদের এই পর্বের আয়োজন আব্দুল্লাহ আল মাহফুজকে নিয়ে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। বর্তমানে তিনি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংক লিমিটেডে প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন।

আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ বেড়ে ওঠেন ঢাকার উত্তরা থেকে খুব কাছাকাছি রানাভোলা নামক একটি গ্রামে। শহরের খুব কাছাকাছি গ্রাম তাই আধুনিকতার ছাপ স্পষ্ট। রানাভোলা শহুরে তথাকথিত আধুনিকতার কালোছায়া থেকে মুক্ত ফলে মহল্লার সবাই সবাইকে নাম ধরেই চেনে। এমন একটা সুন্দর গ্রামে সামাজিক পরিবেশে মুরুব্বীদের সালাম-আদাব দিয়েই তার বেড়ে ওঠা। কামারপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ময়মনসিংহে যান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতে। পারিবারিক আবহে বড় হওয়া তাই একটু ছুটিছাটা পেলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে তিনি চলে আসেন মায়ের কাছে। ন্যায়নিষ্ঠ ও সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত মাহফুজ স্থানীয় বন্ধুদের কাছে যেমন জনপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের কাছেও তেমনি জনপ্রিয়। স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় যখন যেখানেই পড়েছেন সেখানকার যেকোনো ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন মানেই তার অনিবার্য উপস্থিতি। মাহফুজের সৃজনশীলতায় প্রতিটি অনুষ্ঠানে যোগ হয় নতুন মাত্রা।

বড়ভাই ও মায়ের সাথে মাহফুজ

পৃথিবীর সবকিছুর মতোই ছাত্র জীবনেও একদিন বেজে ওঠে বিদায়ের সুর। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে কৃষি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদের অধীন ফার্ম পাওয়ার এন্ড মেশিনারিজ বিষয়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষের পথে। এখন ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবনা করার সময়। বন্ধুদের অনেকেই নিয়মিত পড়ালেখার পাশাপাশি ব্যাংকের চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, কেউ কেউ আরও উন্নত জীবন গড়ার প্রত্যয়ে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তবে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বন্ধু প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। মা অনুরাগী মাহফুজ জানেন মাকে ছেড়ে তিনি দেশের বাইরে গিয়ে থাকতে পারবেন না। তিনি আরও জানেন যে, তুমুল প্রতিযোগিতামূলক বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া যায় কিন্তু চাকরি প্রাপ্তির বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না। তাহলে তিনি কী করবেন! শেষমেশ বড় ভাইয়ের পরামর্শে গ্রাজুয়েশন শেষ করে এমবিএ পড়তে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে। সান্ধ্যকালীন এমবিএ, সন্ধ্যার পরে ক্লাস। জীবনের প্রথম এমন ধরণের ক্লাসের অভিজ্ঞতা নেওয়ার পূর্বক্ষণে অস্থির হয়ে বসে আছেন মাহফুজ। ভিতরে ভিতরে তোলপাড় করে যাচ্ছে রোমাঞ্চকর অনুভূতি। তবে ক্লাস শুরুর আগেই সবচেয়ে বড় বিস্ময় হয়ে আবির্ভূত হলো তারই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কয়েকজন মুখচেনা বন্ধু। তারা অন্য ডিপার্টমেন্টের ছাত্র ছিল বলে এতোদিন সেভাবে আলাপ না থাকলেও এখানে প্রথম দিনেই চুম্বক আকর্ষণের মতো জমে উঠলো বন্ধুত্ব। পুরাতনদেরকে নতুন করে পাওয়ার মধ্যে একটা শক্তি আছে। ক্লাস শেষ হলেও আড্ডা শেষ হয় না।

স্ত্রীকে নিয়ে মাহফুজ

পুরাতন বন্ধু নতুন ক্যাম্পাস, সময়ের সাথে সাথে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও কিছু নতুন বন্ধু তৈরি হলো। ক্লাস, পরীক্ষা, পড়ালেখা আর আড্ডার মধ্য দিয়ে দু’বছর সময় চলে গেল যেন চোখের পলকেই। ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে এই দু’বছরে প্রতিটি ক্লাস উপভোগ্য ছিল তার কাছে। বাংলাদেশে নতুন চালু হওয়া এই বিষয়ে ক্লাস করতে করতে স্বপ্নের ডালপালা ছেয়ে গেছে মনের আনাচে-কানাচে। ভর্তির সময়েও পর্যটন বিষয়ে কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও তা কেটে গেছে বিভিন্ন ধাপে। বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বিকাশমান শিল্প হচ্ছে পর্যটন শিল্প। বাংলাদেশে পর্যটন জাগরণ ঘটবে মাহফুজদের হাত ধরে, একথা চিন্তা করতেই বুকের ছাতি যেন আরও চওড়া হয়ে ওঠে তার। ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে পড়তে এসে তাকে পড়তে হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পর্যটনের ইতিহাস। পড়তে হয়েছে এয়ারলাইন্সের ইতিহাস। পড়তে হয়েছে আতিথিয়েতার গুরুত্ব, আতিথিয়েতা প্রদর্শন কলা আরও পড়তে হয়েছে জমকালো ও বিলাসবহুল পাঁচ তারকা হোটেলের জব রেসপন্সিবিলিটিজ। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোর্স নিয়ে পড়ার সময় ডিপার্টমেন্টে ছোটো ছোটো ইভেন্ট আয়োজন করতে হয়েছে। যদিও এসব ইভেন্ট আয়োজনে তিনি আগে থেকেই সিদ্ধহস্ত তবু্ও বিষয়গুলো ছিল উত্তেজনায় পরিপূর্ণ। ট্যুর অপারেশন ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়ার সময় তাত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি ব্যবহারিক জ্ঞানার্জনের তিনি ভ্রমণ করেছেন নিঝুম দ্বীপ পর্যন্ত। ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকসহ আগেরদিন রাতে বাসে রওনা দিয়ে সি ট্রাক-টেম্পু-ট্রলারে করে দূর্গম পথে যখন তারা নিঝুম দ্বীপে গিয়ে পৌঁছলেন তখন পরের দিনের সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। নিঝুম দ্বীপের গোধূলিবেলায় মহিষের পাল ফিরে আসে নদীর ওপারের চর থেকে এপারের বাথানে, সন্ধ্যায় পাখিরাও নিড়ে ফিরে দ্বীপের ঝাউবনে যেখানে বাস করে অগণিত হরিণ। ঝুপ করে নেমে আসা সন্ধ্যা মিশে যায় রাতে। রাতের নীরবতা জুড়ে শনশন বাতাস নদীতটে, এরকম আরও কতো ভ্রমণের মিষ্টি মধুর অভিজ্ঞতা মাহফুজকে করে তোলে পর্যটনগ্রস্থ। ফ্রন্ট অফিস ম্যানেজমেন্ট কোর্স উপলক্ষে একদিন শেরাটন হোটেল পরিদর্শনে যান তিনি। জাকজমকপূর্ণ ঢাকা শেরাটন হোটেল ও বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের কর্মচাঞ্চল্যতা মাহফুজকে এতোটাই মুগ্ধ করে যে, সেদিনই তিনি চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন, চাকরি করলে তিনি এরকম পাঁচ তারকা হোটেলেই চাকরি করবেন।

আদরের ছেলে-মেয়েদের সাথে বাবা মাহফুজ

এমবিএ লাস্ট সেমিস্টার, পড়ালেখা শেষের পথে। হসপিটালিটি ইন্ডাস্ট্রিতে ক্যারিয়ার গড়ার উড়ন্ত সূচনার দারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন মাহফুজ। ঠিক এমনি একটা সময়ে বিয়েশাদীর মতো গুরুত্বপূর্ণ ও শুভ কাজটি সম্পন্ন করতে হয় তাকে। দীর্ঘদিনের প্রেয়সীকে ঘরে তুলে সুখে দিন কাটলেও যেন শান্তি পাচ্ছেন না মাহফুজ। তিনি নিজেও যেমন এখনো ছাত্র তেমনি নববধূও এখনো ছাত্রী। বিয়ের পরে নতুন বউকে তেমন কিছুই দিতে পারেনি এখনো। দূরে কোথাও না হোক অন্তত সারাদিন ফ্যান্টাসি কিংডম থিম পার্কে ঘোরাঘুরি করে রাতে বাইরে খেয়ে বাসায় ফিরবেন এই আর্থিক সংগতিটুকুও এখন নাই মাহফুজের। একদিন সব অনটন ঘুচে যাবে শুধু এতোটুকু আশা নিয়েই তারা যাবতীয় চাওয়া-পাওয়াগুলো চেপে রেখে সংসারে এঁকে যাচ্ছেন সুখের উপপাদ্য। হেমন্তের মিহি কুয়াশায় বিভোর মাঝরাত। ভরা পূর্ণিমা। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে ঘর। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার চুড়ান্ত ফলাফল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মাহফুজ। আগামীকাল চাকরিতে যোগদান করবেন নাকি পাঁচ তারকা হোটেলে চাকরির জন্য আরও কয়েকমাস অপেক্ষা করবেন সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। জানালার পর্দার ফাক দিয়ে রওনকের নিষ্পাপ মুখের উপরে পড়েছে চাঁদের আলো। মেয়েটা কতো কষ্টই না সহ্য করছে তবুও মুখ ফুটে কিছু বলে না। নতুন সংসারে এটা-সেটা টুকটাক কতো কিছুই তো দরকার। বিলাসিতা নয় একান্ত দরকারি জিনিসপত্রের কথাও বলতে চায় না, পাছে না দিতে পারার গ্লানিতে ভোগে মাহফুজ! জানালা থেকে ফিরে নববধূর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ ভিজে ওঠে। ছোটো ছোটো সুখে টইটুম্বুর সংসার কিন্তু সামান্য কিছু নগদ টাকার অভাবে শান্তি নাই। এমন নয় যে, টাকার অভাবে সংসারে অশান্তি। বরং ছোটখাটো অভাব গুলো মাহফুজের চোখের আড়ালে রাখতেই যেন অধিক সুখ রওনকের।

স্ত্রী, পুত্র ও কন্যাকে সাথে নিয়ে মাহফুজ

ছোট্ট সংসারে শান্তির সুবাতাস বয়ে দিতেই জনাব আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ ব্যাংকের চাকরিতে যোগদান করতে যান উত্তরা থেকে গুলশান। যেতে যেতে ভাবেন, এখন থেকে সকালের নাশতায় দু’জনের জন্য থাকবে দুটো আস্ত ডিম। দুপুরের খাবারে কোনো কোনোদিন থাকবে পাকা টমেটো দিয়ে পাবদা মাছের ঝোল, একটু আলুভর্তা কিংবা কাচকলা দিয়ে ইলিশের সালুন। ইচ্ছে করলেই তারা এখন থেকে খেতে পারবেন চিংড়ি মাছের মালাইকারী বা হাঁসের মাংসের দোপেঁয়াজা। ছুটির দিনগুলোতে বাজারের দুশ্চিন্তা দূরে ঠেলে দিয়ে দুজনে মুখোমুখি বসে কফি খেতে পারবেন। কল্পিত সুখের কাছে ঝাপসা হয়ে আসে পাঁচ তারকা হোটেলে ক্যারিয়ার গড়ার রঙ্গিন স্বপ্ন। তারপর কেটে গেছে সাত-আট বছর। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংক লিমিটেডে প্রবেশনারি অফিসার পদে ঢুকে এখন তিনি প্রিন্সিপাল অফিসার পদে কর্মরত। বিলাসবহুল হোটেলে চাকরি নিয়ে ক্যারিয়ার গড়তে না পারার কষ্টটা তিনি লাঘব করছেন ব্যাংকের কাস্টমারদেরকে আন্তরিক সেবা প্রদানের মাধ্যমে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান হলেও ব্যাংক পুরোপুরি সেবা নির্ভর একটি প্রতিষ্ঠান। ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিষয় পড়ে অর্জিত আতিথিয়েতা কলা দিয়ে তিনি সমস্ত গ্রাহকদেরকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন পরম মমতায়। ব্যাংকের মতো সেবা নির্ভর খাতে জনাব আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ একদিন সফলতার চুড়ায় পৌঁছে যাবে পর্যটনিয়া পরিবার তা কায়মনোবাক্যে কামনা করে।

Leave a Reply