ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, নিঃসঙ্গ বোধ করেছি কিন্তু ভেঙে পড়িনি

Share on Facebook

পর্যটন বিষয়ক অনলাইন নিউজ পোর্টাল পর্যটনিয়া পর্যটন শিল্পের নানা সমস্যা ও সম্ভাবনা তুলে ধরে আসছে নিয়মিত। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যটন বিষয় নিয়ে পড়ালেখা করছে এমন অনেক ছাত্র যথাযথ তথ্যের অভাবে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে শঙ্কিত। সুতরাং সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে পর্যটনের সাবেক ছাত্রদের বায়োগ্রাফি প্রকাশ করার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। পর্যটন বিষয় নিয়ে পড়ালেখা করার পর তাঁদের আজকের অবস্থান একজন ছাত্রকে হয়তো তার নিজস্ব ক্যারিয়ার গড়তে স্বপ্ন দেখাবে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সাহসী করে তুলবে। সাবেক ছাত্রদের বায়োগ্রাফি হোক শঙ্কিত ছাত্রদের দিকনির্দেশনা আর সাহসী ছাত্রদের প্রেরণা। আমাদের এই পর্বের জ্ঞাতব্য মো. সাইফুল্লাহ রাব্বী।

মো. সাইফুল্লাহ রাব্বী

মো. সাইফুল্লাহ রাব্বী বর্তমানে ড্যাফোডিল ইন্সটিটিউট অব আইটিতে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজম্যান্ট বিভাগে। শৈশবে নিজ জেলা গাইবান্ধায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনের পর চলে আসেন বগুড়া। বগুড়ায় নানাবাড়িতে থেকে এসএসসি এবং এইচএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করায় তার কৈশোরের স্মৃতিতে বগুড়া অমলিন।

ছোটোবেলা থেকেই শুধু বড় নয় বরং ভালো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। সেই স্বপ্ন পূরণে পরিবারের পাশাপাশি নানা-নানি, খালা, মামারা সাহস যুগিয়েছেন। ভালো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেই হবে; সেই  লক্ষ্যে তিনি স্থির করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। বগুড়া থেকে ঢাকা এসে খালার বাসায় বসে শুরু হয় ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবার পরীক্ষা দিয়ে ভর্তির সুযোগ না পেলেও দ্বিতীয়বার তিনি মেধা তালিকায় খ- ইউনিটে ১৬২৫ এবং ঘ- ইউনিটে ৩৭ তম স্থান করে নেন। আইন অথবা অর্থনীতি বিষয় নিয়ে পড়ার ইচ্ছা থাকলেও মেধাতালিকায় কিছুটা পিছিয়ে পরার কারণে সেই ইচ্ছে পূরণ হয় না। তবে ঘ-ইউনিটের  মেধাতালিকায় অনেকটা সামনে এগিয়ে থাকায় সাবজেক্ট পছন্দ করতে কিছুটা সুবিধা হয়। বন্ধুদের সাথে পরামর্শ করে তিনি ভর্তি হলেন ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজম্যান্ট বিভাগে।

১৬ ই ডিসেম্বর ২০১১, হাজী মুহাম্মদ মুহসিন হলের ই-৮ রুম, নতুন জীবনের শুরু এখান থেকেই। লক্ষ্য বহুদূর, হতে হবে ভালো মানুষও। পর্যটন বিষয়ে বাস্তবভিত্তিক জ্ঞান অর্জনের জন্য নিয়মিত ক্লাস করার পাশাপাশি পর্যটন সংশ্লিষ্ট নানা রকম কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়াতে শুরু করলেন। ২০১২ প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষা দেওয়ার কিছুদিন পরেই তিনি কয়েকজন বন্ধুসহ একটা পর্যটন মেলায় কাজ করার সুযোগ খুঁজে নেন। এভাবে আরও কিছু পর্যটন মেলা, সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণ ও একটু অবসর পেলেই কোথাও ঘুরতে বেরিয়ে পরার মধ্যদিয়ে তিনি পর্যটনে আসক্ত হয়ে পরলেন। পর্যটন শিল্পেই ক্যারিয়ার গড়বেন বলে ব্রতী হলেন।

২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ও বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের সাথে কাজ করার সুযোগ পেলেন। ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের ২১ টি ট্যুরিজম ফেয়ার, ১ টি আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও কয়েকটি সেমিনারে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছেন। বিবিএ শেষে ছয় মাসের ইন্টার্নশিপও করেছেন বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের অধীনে। এসবের পাশাপাশি মানুষের সাথে যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য তিনি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে নিজেকে জড়িয়েছিলেন। উত্তরণ নামের একটা সামাজিক সংগঠনে যুক্ত হয়ে পথশিশুদের পড়িয়েছেন কিছুদিন। নেতৃত্ব ও শৃঙ্খলা বিষয়ে পাঠ নেওয়ার জন্য বিএনসিসি-সেনা শাখায় যোগ দিয়ে তিনি যেন ধীরে ধীরে হয়ে উঠছেন পর্যটনের বৈদান্তিক।

একজন সাইফুল্লাহ রাব্বী পর্যটনের নানা বিষয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের সাথে হাইজিন ফুড পোগ্রাম নিয়ে কাজ করেছেন।  টোয়াবের সাথে তিনটি ও আটাবের হয়ে একটি পর্যটন মেলায় কাজ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ব্যানারে ক্যাম্পাস ট্যুরিজম নিয়ে কাজ করেছেন। ট্যুর অপারেশন বিষয়ে তাত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি বাস্তবিক জ্ঞান আহরণের জন্য ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৫০ টির অধিক গ্রুপ ট্যুর পরিচালনা করেছেন।

ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজম্যান্ট বিভাগে বিবিএ পড়ার সময়েই ২০১৫ সালে ট্রাভেল এজেন্সি ও ট্যুর অপারেশন ম্যানেজমেন্টের উপর ৬ মাসের ডিপ্লোমা করে নিজেকে আরও সমৃদ্ধ করেছেন। এরপর এমবিএ পড়ার পাশাপাশি ট্যুর অপারেটর বিজনেস শুরু করার চেষ্টা করে নানা কারণে ব্যার্থ হয়ে একটা ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি নেন।

প্রফেসর মোহাম্মদ আসহান উল্লাহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ ও উৎসাহ দিয়েছেন। তিনিই প্রথম সাইফুল্লাহ রাব্বীকে ২০১৭ সালে শেখ হাসিনা জাতীয় যুব উন্নয়ন ইনস্টিটিউটে ট্রাভেল এজেন্সি এন্ড ট্যুর গাইডিং এর উপরে অতিথি প্রশিক্ষক হিসেবে ক্লাস নেয়ার সুযোগ করে দেন। তার খালুর সহযোগিতায় ট্রাভেল এজেন্সিতেও কিছুদিন কাজ করেছেন। ২০১৭-১৮ আটাব ট্যুরিজম ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে এয়ার টিকেটিং এন্ড রিজার্ভেশন  NTVQF – level 2 কোর্সটি সম্পন্ন করে বেশ কয়েকটি এয়ারলাইনসে ভাইভা দিয়েও চাকরি পেতে ব্যার্থ হন।

লক্ষ্যে অবিচল থেকে সাইফুল্লাহ রাব্বী হতাশ হওয়ার পরিবর্তে আরও দৃপ্ত হন। এই কঠিন সময়ে বিভাগীয় শিক্ষকদের মধ্যে প্রফেসর মুজিব উদ্দিন আহমেদ, প্রফেসর সৈয়দ রাশেদুল হাসান, প্রফেসর বদরুজ্জামান ভূইয়া, সন্তোষ কুমার দেব, নুসরাত ম্যামসহ অনেকেই সাহস যুগিয়েছেন। ভালো মানুষ হতে হবে; নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। মামুন এয়ার  সার্ভিসে (IATA Travel Agency) ম্যানেজার সেলস পদে যোগদান করে নিজের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছেন এমন সময় ইবাইস ইউনিভার্সিটির ট্যুরিজম এন্ড হোটেল ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অতিথি প্রভাষক হিসেবে ক্লাস নেওয়ার প্রস্তাব পেয়ে রাজি হয়ে যান।

২০১৮ সাল থেকে ড্যাফোডিল ইনিস্টিউট অব আইটির ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অতিথি প্রভাষক হিসেবে ক্লাস নেওয়া শুরু করার পর ট্রাভেল এজেন্সির চাকরিটা ছেড়ে দেন। ২০১৮ সালের শেষের দিকে আটাব ট্যুরিজম ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এবং ২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশ হোটেল ম্যানেজমেন্ট এন্ড ট্যুরিজম ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে অতিথি প্রশিক্ষক হিসেবে ক্লাস নেওয়ার সুযোগ পান (এই দুটি প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে এখন অবধি ক্লাস নিচ্ছেন)। এসকল প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা শুরু করে তিনি নিজেও ট্যুর গাইডিং এর উপর  NTVQF level 1  প্রশিক্ষণ নেন। টিকেটিং এন্ড রিজার্ভেশনের উপর NTVQF level 4 কম্পিটেন্ট হয়ে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের প্রথম সার্টিফাইড Assessor হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন ২০১৯ সালে।

এইভাবে প্রশিক্ষণ নেওয়া ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার মধ্যদিয়ে নিজেকে করে তুলেছেন পারঙ্গম। এখন পর্যন্ত পর্যটন খাত সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় নিয়ে তার লেখা ৩০টির বেশি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়। ট্যুরিজমের বিভিন্ন বিষয়ের উপরে প্রফেশনাল ট্রেনিং দিয়েছেন ১০০০ এর অধিক প্রশিক্ষণার্থীকে যাদের অনেকেই বিভিন্ন এয়ারলাইনস, হোটেল, ট্রাভেল এজেন্সি ও ট্যুর অপারেশন ফার্মে কর্মরত আছেন। কেউ কেউ নিজেই ট্যুর গাইডিং, প্রশিক্ষক ও উদ্যোক্তা হিসেবে পর্যটন শিল্পে কাজ করছেন। ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি শিল্পের পেশজীবীদের নিয়ে ট্যুরিজম বিষয়ে গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও পেশাগত দক্ষতার উন্নয়ন নিয়ে কাজ করার লক্ষ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলাদেশ সোসাইটি ফর ট্যুরিজম ইনোভেশন।

বছর দশেক আগে শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন সাইফুল্লাহ রাব্বী। সেদিনের সেই সাইফুল্লাহ রাব্বী থেকে আজকের পর্যটন পেশাজীবি, শিক্ষক, প্রশিক্ষক, প্রবন্ধ লেখক ও ট্রাভেল কনসালটেন্ট সাইফুল্লাহ রাব্বী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পাড়ি দিয়েছেন নানা চড়াই-উতরাই। মহাকালের কাছে প্রায় একদশক হয়তো তেমন বেশি কোনো সময় নয় কিন্তু এই অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ব্যাক্তিগতভাবে অতিক্রম করেছেন বহুপথ। এতোটা পথ পাড়ি দিতে ক্লান্ত হয়ে পরেছেন বহুবার। মাঝে মাঝে নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ বোধ করেছেন কিন্তু কোনোবারই তিনি ভেঙে পরেননি। লক্ষ্যে স্থির থেকে ধৈর্য্য ও একাগ্রতা নিয়ে তিনি শুধু সামনের দিকেই এগিয়ে চলেছেন। তার এই এগিয়ে চলা আরও বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হোক পর্যটনিয়া পরিবার সেই কামনা করে।

Leave a Reply