আয়ুর্বেদ, জনস্বাস্থ্য ও পর্যটন

Share on Facebook

আয়ুর্বেদের জন্ম কবে তার সন তারিখ ঠিকঠাক বলা না গেলেও একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, আনুমানিক ৫০০০ বছর আগে আমাদের মাটি থেকে জন্ম নেওয়া এই চিকিৎসা বিজ্ঞান আজও আমাদের জন্য বড় রক্ষাকবজ। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চিরায়ত চিকিৎসা পদ্ধতিকে মূলধারায় আনার নির্দেশ প্রদান করেছেন।

গত ২২ এপ্রিল ২০২০ তারিখে আমাদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অলটারনেটিভ মেডিক্যাল কেয়ারের লাইন ডাইরেক্টর ডা. মো. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার সাথে সম্পৃক্ত সকল কর্মকর্তাদেরকে প্রচারের অনুরোধ জানিয়ে বলা হয়েছে যে, আদা ও লবঙ্গ মিশ্রিত গরম পানি, কালোজিরা/মধু, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফলমূল গ্রহণ করুন যা করোনা প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে। হাল আমলে এমন একটি সরকারি বিজ্ঞপ্তি সংগত কারণেই আমাদের নজর কেড়েছে।

আমরা অনেকেই না জেনে অথবা ভুল জেনে আয়ুর্বেদ সম্পর্কে বিজ্ঞের মতো ভুল ব্যাখ্যা দেই। কেউ বলি আয়র্বেদ দেরিতে কাজ করে, কেউ মুখে না বললেও অন্তরে পোষণ করি যে আয়ুর্বেদ হিন্দুদের চিকিৎসা ব্যবস্থা ইত্যাদি। কিন্তু একথা হয়তো অনেকেই জানি না যে, আয়ুর্বেদ মানে আয়ু বৃদ্ধি করার বিদ্যা। ১৮১০ সালে কলকাতা থেকে ছাপানো আয়ুর্বেদের বিশাল এক বইয়ে পড়েছিলাম যে, Ayurveda is the science of all life sciences. এতবড় একটা কথা হজম করতে আমার একটু সময় লেগেছিলো।

জেনে অনেকেই অবাক হবেন যে, ক্যান্সার, প্যারালাইসিস, আর্থ্রাইটিস্ ইত্যাদি ব্যাধির (Disorder) চিকিৎসা যতটুকু হয় আয়ুর্বেদেই হয়। নিউরোলজিক্যাল ৩ শতাধিক রোগের চিকিৎসা আয়ুর্বেদ ছাড়া সম্ভব নয়। চোখের অন্তত ২৪টি জটিল রোগের চিকিৎসা আয়ুর্বেদ ছাড়া আর কেউ করতে পারে বলে আমি সন্ধান করে পাই নাই। আয়ুর্বেদে ব্যবহৃত মুক্তাভষ্ম ব্যতীত আপনাকে আর কেউই ফর্সা করতে পারবে না, আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি। যারা বলে তারা মিথ্যা বলে। আয়ুর্বেদীয় পদ্ধতিতে প্রস্তুতকৃত লৌহভষ্ম এলোপ্যাথিক আয়রন সিরাপের চেয়ে উত্তম, তা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। অথচ শুধু না জানার জন্য আমরা প্রতিনিয়ত যে সকল সংকটে পড়ছি তা থেকে মুক্তি চেয়ে আয়ুর্বেদের কাছে ফিরে যেতে পারছি না।

আয়ুর্বেদ শিক্ষা:
আয়ুর্বেদে যার চিকিৎসা নাই, সম্ভবত চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্য কোন শাখায় তার চিকিৎসা নাই – এমন ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য একমাত্র আয়ুর্বেদই দিতে পারে। আমাদের মধ্য থেকে সৃজিত এই মহান চিকিৎসা বিজ্ঞানকে শক্তভাবে আঁকড়ে না ধরা মোটেও উচিত হয় নাই। যদি হতো তাহলে আমাদের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্য ভিন্নরূপ হতো।

ভারতে ৪টি আয়ুর্বেদিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এ ছাড়া বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন শত শত কলেজে আয়ুর্বেদে উচ্চশিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে। আর আমাদের দেশে কেবল একটি সরকারি কলেজ দীনহীনভাবে এবং একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় জোড়াতালি দিয়ে ব্যাচেলর অব আয়ুর্বেদিক মেডিসিন এন্ড সার্জারি (বিএএমএস) ডিগ্রি দিচ্ছে। দেশে একটি আয়ুর্বেদিক হাসপাতাল না থাকার জন্য এদের ইন্টার্ণশীপ হয় এলোপ্যাথিক হসপিটালে। অতি পরিতাপের বিষয় যে, দেশে একটি পরিপূর্ণ আয়ুর্বেদিক হসপিটাল করা সম্ভব হলো না! অপরদিকে ১১ (এগার) টি আয়ুর্বেদিক ডিপ্লোমা কলেজ চলছে বড়ই বেহাল অবস্থায়। সরকারের কোন নজর নাই, পুষ্ঠপোষকতা নাই – চরম অবহেলা। অথচ এদের কাঁধে চেপে চলছে পুরো আয়ুর্বেদের চিকিৎসা ব্যবস্থা। সীমিত পরিমাণে আয়ুর্বেদের চিকিৎসকদেরকে সাধারণ হসপিটালে নতুন পদ সৃষ্টি করে পদায়ন করা হলেও কী সেবা পাচ্ছেন মানুষ, কে জানে?

বাংলাদেশে অন্তত একটি পাবলিক আয়ুর্বেদিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া উচিত। এই প্রয়োজনীয়তা বুঝতে না পারার কারণ বোধগম্য নয়। আর এর অধীনে প্রতিটি বিভাগীয় শহরে অন্তত একটি করে সরকারি আয়ুর্বেদিক ডিগ্রি কলেজ স্থাপন করা জরুরি। সরকারের উচিত অবিলম্বে কমপ্লিমেন্টারি এন্ড অলটারনেটিভ মেডিসিন পলিসি ঠিক করা। মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের আদলে আয়ুর্বেদ চিকিৎসকদের লাইসেন্স প্রদান ও মান নিয়ন্ত্রণের জন্য আয়ুর্বেদিক কাউন্সিল গঠন করা এখন সময়ের দাবী। কৃষি ও বন মন্ত্রণালয়কে চাহিদা নির্ধারণ করে দিয়ে সে মতো ঔষধি উদ্ভিদ উৎপাদন করার নির্দেশ প্রদানও জরুরি। পাশাপাশি ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলিকে কঠোর মান নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন তারা আয়ুর্বেদিক ঔষধ প্রস্তুতির স্বীকৃত পদ্ধতি পরিহার করে শর্টকাট মেথডে তা উৎপাদন না করেন। এতে ঔষধের মান ১০০% বিনষ্ট হবে। ঔষধ প্রশাসনে আয়ুর্বেদে শিক্ষিত ও অন্তরিক কর্মকর্তাদেরকে পদায়ন করতে হবে। তা না হলে ঔষধে খনিজ ভষ্ম (Mineral Ashes) ব্যবহার, ঔষধ উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রণের উপর অহেতুক বাধা সৃষ্টি করে আয়ুর্বেদের ঔষধকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন। এই সব কিছুর জন্য দেশে এখন পরিপূর্ণ আয়ুর্বেদিক শিক্ষা ও গবেষণা ব্যবস্থা গড়ে তোলা অত্যাবশ্যকীয়। যে কোন মূল্যে মেধাবী ছাত্রদেরকে আয়ুর্বেদ শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

আয়ুর্বেদ ও জনস্বাস্থ্য:
আমাদের অনেকের ধারণা যে, আয়ুর্বেদ বুঝি এলোপ্যাথিক চিকিৎসার মতো কেবলই ঔষধ প্রয়োগের ব্যবস্থা। আয়ুর্বেদ কেবলই একটি চিকিৎসা ব্যবস্থা নয়, জীবনশৈলীও বটে। বায়ু, পিত্ত ও কফের ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে সুস্বাস্থ্য রক্ষার অমোঘ বাণী ঘোষণা করেছে আয়ুর্বেদ। এই সত্য গণমানুষকে শিখিয়ে দিতে পারলেই আমাদের জনস্বাস্থ্য অনেকভাবে রক্ষা পেতো। আয়ুর্বেদ আহার (অর্থাৎ খাবারের পরিমাণ, সময় এবং উপাদান) ও বিহার (অর্থাৎ জীবনধারা) মেনে নিরোগ থাকার জন্য মানুষকে আহবান জানাচ্ছে সেই আদি আমল থেকে। আয়ুর্বেদ মতে পৃথিবীতে ৯ (নয়) ধরণের মানুষ আছে এবং এদের প্রত্যেকের ডায়েট ভিন্ন। বলাই বাহুল্য যে, এসব না জানার জন্য আমরা একই ধরণের খাবার খেয়ে নানাবিধ রোগ ও ব্যাধিতে (Disease & disorder) আক্রান্ত হচ্ছি। আমরা আজকাল স্বাস্থ্যবিধি বলতে বুঝি, ফরমালিনমুক্ত খাবার, লাইফবয় দিয়ে হাত ধোয়া আর টিস্যু পেপার ব্যবহার করা। চুন থেকে পান খসলেই দৌঁড়াই ডাক্তারের কাছে প্রেসক্রিপশন কেনার জন্য। তারপর হরেক রকমের হাজার হাজার টাকার টেস্ট! সবশেষে নিয়ম করে দামি ও ক্ষতিকর (!) ঔষধ খেয়ে যাই। অথচ মজার ব্যাপার হলো, আয়ুর্বেদ মতে শুধু নাড়ী টিপেই বলে দেওয়া যায় অনেক রোগ-ব্যাধির কথা। যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হার্টের ব্লক ইত্যাদিসহ কত রোগের কথা যে বলে দেওয়া যায় তার ইয়ত্তা নাই। মজার ব্যাপার এই যে, Secret of Pulse নামক ২২৬ পাতার একটি বই ভারত থেকে সংগ্রহ করে ১৯৯৬ সালে আমেরিকা থেকে ছাপা হয়। আয়ুর্বেদ মতে, পায়খানা ও প্রস্রাব পরীক্ষার পদ্ধতি অতি প্রাচীন। ভাবুন তো আপনার দাদা-নানা কিংবা তাঁদের বাবা-মা জীবনে কতবার ডাক্তারের কাছে গেছিলেন এবং কত টাকার ঔষধ খেয়েছিলেন। আর তাঁরা কী আপনার চেয়ে বেশি না কম সুস্থ্য ছিলেন? জেনে হয়তো ভালো লাগবে যে, করোনাকালীন সময়ে গত এক মাসে ঔষধের দোকানগুলিতে ঔষধ বিক্রয় ৫০% হ্রাস পেয়েছে কেবল ডাক্তারের কাছে অযথা না যেতে না পারার জন্য।

আয়ুর্বেদিক পর্যটন:
করোনাকালে আমাদের আরেকটি শিক্ষা হলো, বর্তমানের স্বাস্থ্য পর্যটন আগামী দিনে আয়ুর্বেদিক পর্যটনে মোড় নিবে। বিষয়টি বুঝিয়ে বলছি। আমাদের ঔষধের ৯৫% কাঁচামাল বিদেশ থেকে কিনে আনতে হয়। করোনা পরবর্তী সময়ে নানাবিধ কারণে অনেক পশ্চিমা দেশের এইসব কাঁচামাল তৈরির সক্ষমতা কমবে। ফলে একটা বড় সংকটে পড়ার সমূহ আশঙ্কা বিরাজমান। অন্যদিকে আয়ুর্বেদিক সকল ঔষধ তৈরি করা হয় উদ্ভিদ, প্রাণি ও খনিজ পদার্থ থেকে যার অনেকগুলি বাংলাদেশে সহজলভ্য। আর যেগুলি পাওয়া যায় না, সে সব ভারত থেকে আমদানি করলেই চলবে। কাঁচামালের সহজলভ্যতা ও ঔষধ তৈরির সহজ পদ্ধতি আমাদেরকে এমন একটি জায়গায় দাঁড় করাতে পারে, যার ফলে অন্তত স্থানীয় মানুষ আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার সাথে সম্পৃক্ত হবে। আমরা যদি ধীরে ধীরে উপজেলা শহরগুলিতে আয়ুবেদিক হসপিটাল, আয়ুর্বেদিক রিসোর্ট এবং পর্যটন গ্রামগুলিতে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতি সম্প্রসারিত করতে পারি তাহলে সারা দেশে আয়ুর্বেদিক পর্যটন একটি নতুন প্রডাক্ট হতে পারে। এই জাতীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা পশ্চিমা দেশের অনেক পর্যটকদেরকে আকৃষ্ট করবে। ভ্রমণকালে তারা বাংলাদেশ থেকে প্রাকৃতিক জীবনাচার, আয়ুর্বেদিক খাদ্য, রন্ধনকৌশল এবং সহজ প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতি সম্বন্ধে শিখবে। উল্লেখ্য যে, কেবল কেরালায় আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা গ্রহণ করার জন্য প্রতিদিন কলকাতা, মিজোরাম, পাঞ্জাব, মধ্যপ্রদেশ, আয়ারল্যান্ড, মালয়েশিয়া, নরওয়ে, জাপান, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, তানজানিয়া, ওমান, বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার রোগী গমন করেন।

বাংলাদেশে প্রায় ৫ শতাধিক রিসোর্ট রয়েছে, যার অধিকাংশই পর্যটক পাচ্ছে না – লোকসান গুনছে। এদের নামকরণ রিসোর্ট হলেও প্রায় সবগুলিতেই রিসোর্টের বৈশিষ্ট্য বিশেষত বিনোদন ও চিকিৎসার বিষয়গুলি অনুপস্থিত। শহরের বাইরে অবস্থিত এই পর্যটন আবাসগুলিকে একটি ব্যবস্থাপনার আওতায় এনে আয়ুর্বেদিক রিসোর্টে পরিণত করতে পারলে একদিকে যেমন দেশে আয়ুর্বেদিক পর্যটনের বিকাশ ঘটবে, অন্যদিকে পর্যটন অর্থনীতিতে এদের বিপুল অবদান সকলকে আকৃষ্ট করবে। তাই বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের দায়িত্ব হলো বাংলাদেশ ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক বোর্ডের সহযোগিতা নিয়ে এগুলিকে আয়ুর্বেদিক রিসোর্টে পরিণত করা।

উপসংহার:
করোনাকালীন সংকট আমাদেরকে বহুমাত্রিক সমস্যায় ফেললেও কিছু জীবনমূখী শিক্ষা দিচ্ছে। আমরা এবার প্রথমবারের মতো মানতে বাধ্য হচ্ছি যে, আমরা প্রকৃতির সন্তান এবং তারই অংশ হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। প্রকৃতির সাথে সাংঘর্ষিক কোন কাজই মানুষের জন্য মঙ্গলময় নয়, বরং অনেক বেশি ক্ষতিকারক। তাই আমাদেরকে ফিরতে হবে প্রকৃতির কাছে। আধুনিকতার নামে কৃত্রিম খাদ্য, চিকিৎসার নামে শরীরের উপর অত্যাচার ইত্যাদি পরিহার করে এবং আয়ুর্বেদের মতো প্রাকৃতিক এবং পরীক্ষিত জীবনশৈলীর কাছে ফেরত যেতে হবে। শিক্ষা, গবেষণা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এর উৎকর্ষ সাধনেরও সময় এসেছে। এবারও যদি আমরা এই শিক্ষা গ্রহণ না করি এবং বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ি, তাহলে নিশ্চয়ই ভাগ্যকে দোষ দিয়ে প্রশান্তি খুঁজতে হবে – যা মূর্খরা চিরদিনই করে থাকে।

 

লেখক: আহ্বায়ক, ‘সম্মিলিত পর্যটন জোট’ এবং সভাপতি, বাংলাদেশ ট্যুরিজম ফাউন্ডেশন।

Leave a Reply