হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল- গেরিলা ১৯৭১ ফেসবুক পেজ থেকে

Share on Facebook

হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, নামটির সাথে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের এক অবিচ্ছেদ্য ইতিহাস। ১৯৭১ সালে এখানেই দুই দফা (৯ই জুন এবং ১১ই আগস্ট) আক্রমণ চালিয়েছিলেন সেক্টর দুইয়ের অধীন ক্র্যাক প্লাটুন খ্যাত গেরিলারা। অত্যন্ত সফল এ দুটি অভিযানের মাধ্যমেই মূলত বাঙালির প্রতিরোধ যুদ্ধ সম্পর্ক জানতে সক্ষম হয় পুরো পৃথিবী।

১, মিন্টো রোড রমনা, ঢাকা – ১০০০ ঠিকানায় ১৯৬৬ সালে ৩০০টি কামরা নিয়ে হোটেলটির যাত্রা শুরু হয়েছিল, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) প্রথম পাঁচ তারকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের। স্থপতি উইলিয়াম বি ট্যাবলারের চমৎকার নকশার এ হোটেলটি আজও চমৎকার স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন। যদিও পরবর্তীতে বেশ কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়েছে।

১৯৮৩ সাল পর্যন্ত ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল গ্রুপ এটি পরিচালনা করতো। সে বছর এটি পরিচালনার দায়িত্ব শেরাটন নিয়ে নিলে,এর নাম হয় শেরাটন ঢাকা হোটেল। ২০১১ সালে শেরাটন ঘোষনা দেয় যে তারা তাদের কার্যক্রম শেষ করবে এবং বাংলাদেশ সরকারকে এটি পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে দিবে, তারপর এটির নাম হয় রূপসী বাংলা হোটেল।

২০১৩ সালে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল গ্রুপ পুনরায় আমাদের ইতিহাসের সাথে জড়িত এই হোটেলের দায়িত্ব নেবার ঘোষনা দেয়। বর্তমানে, এটি সংস্কার করার পর ‘ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকা’ নামে চালুর অপেক্ষায় আছে।

★ ৪৭ বছর আগে, ৯ই জুন ১৯৭১ বুধবার। অবরুদ্ধ ঢাকার বাসিন্দা’দের ভেতর ভয় ও মৃত্যুশঙ্কা তবুও মানুষ আশাবাদী হতে পেরেছিল সেদিন। কারন, মৃত্যুপুরী ঢাকায় স্বাধীনতাকামী দুর্ধর্ষ গেরিলাদের প্রথমবারের মতো সরব উপস্থিতি।

এদিন পাকি হার্মাদ’দের উপস্থিতির মাঝে পরাধীন ঢাকাবাসী প্রত্যক্ষ করেছিল ঢাকার প্রথম গেরিলা অপারেশন। অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল, বিশ্বব্যাংকের সহায়তা মিশন এবং ইউএনএইচসিআরের প্রধান প্রিন্স সদরুদ্দীন আগা খানকে পাকিস্তানি জান্তাকে আর্থিক সাহায্য প্রদান থেকে বিরত রাখা এবং বিশ্ববাসী’কে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যা ও নির্যাতনের বিষয়ে সচকিত করা।

সেদিন সেক্টর দুইয়ের অধীন ঢাকা কেন্দ্রিক গেরিলা বাহিনীর দুর্ধর্ষ সদস্য বাদল,কামরুল হক স্বপন,আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এবং হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক ইন্টারকন্টিনেন্টালে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটান।

★১১ই আগস্ট ১৯৭১, পরিচালিত হয়েছিল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সকল নিরাপত্তার বেড়াজাল ছিন্ন করে পরিচালিত হয় দ্বিতীয় দুর্ধর্ষ অবিশ্বাস্য গেরিলা অপারেশন।

এই অভিযানটি ছিল প্রথমটির চাইতে বিপদজনক ও গেরিলারা নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে সফল হয়েছিলেন। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল দ্বিতীয় অপারেশনের মূল নায়ক ছিলেন শহীদ মো. আবু বকর বীরবিক্রম ও আবদুস সামাদ বীর প্রতীক।প্রথম দফা গ্রেনেড হামলার পর থেকেই হোটেলে কড়া পাহারা। অকারণে দূরের কথা, প্রয়োজনেও সেখানে ঢোকা বেশ কষ্টসাধ্য। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন, যে করেই হোক অপারেশন করতে হবে। একটা উপায়ও বের হলো।

থাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের একটা অফিস ছিল হোটেলের শপিং আর্কেডে। আবদুস সামাদ খবর পান, ব্যবসায়িক মন্দার কারণে তা ওই হোটেলেরই ছোট এক কক্ষে স্থানান্তর হবে। তিনি নিয়নসাইন ও সাইনবোর্ড তৈরির ব্যবসা করতেন। হোটেলের বেশির ভাগ দোকানের নিয়নসাইন তাঁর করা। তিনি কাজটি নিয়ে নেন এবং এর সূত্র ধরেই হোটেলে কয়েক দিন রেকি করেন। তারপর সবাই মিলে আলোচনা করে, সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বারের বিপরীত দিকে পুরুষদের প্রসাধনকক্ষের কোণে বিস্ফোরক রাখা হবে।

১১ আগস্ট সকালে, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ বকরের, এক সহযোদ্ধা বায়তুল মোকাররম মার্কেট থেকে একটি ব্রিফকেস কিনে আনেন। ব্রিফকেসের ভেতরে তাঁরা সাজিয়ে রাখেন ২৮ পাউন্ড ‘পিকে’ (প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ) ও ৫৫ মিনিট মেয়াদী টাইমার। তারপর বিকেলে গাড়িতে চেপে রওনা হন শহীদ আবু বকর বীর বিক্রম, আবদুস সামাদ বীর প্রতীক, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রম ও গোলাম দস্তগীর বীর প্রতীক। হোটেলের গাড়ি পার্কিংয়ে পৌঁছে শহীদ আবু বকর ও সামাদ হোটেলের ভেতরে ঢোকেন। বাকি দুজন গাড়িতে স্টেনগান নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন।

হোটেল লাউঞ্জের মূল দরজা দিয়ে না ঢুকে ‘সুইস এয়ারের’ অফিস কক্ষের দরজা দিয়ে তাঁরা ভেতরে যান। এ ব্যাপারে সহায়তা করেন ওই অফিসেরই এক কর্মচারী। ব্রিফকেস হাতে শহীদ বকর প্রসাধনকক্ষের একেবারে কোণার কক্ষে ঢুকে দরজা আটকে দেন। সামাদ বাইরে থাকেন কাভার হিসেবে। ভেতরে তিনি টাইমার চালু করে ব্রিফকেস রাখেন কমোডের পেছনে। তারপর দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে রেখেই দেয়াল টপকে বেরিয়ে আসেন। দুজন সোজা চলে যান অপেক্ষমাণ গাড়ির কাছে। গাড়িতে ওঠামাত্র দ্রুত সেটি বেরিয়ে যায়।

ঠিক ৫৫ মিনিট পরই ঘটে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। হোটেলের লাউঞ্জ, বার, শপিং আর্কেড ও আশপাশের কক্ষের কাচ টুকরা টুকরা হয়ে ভেঙে পড়ে। ছিটকে যায় দরজা, ভেঙে পড়ে কক্ষের ভেতরের ও লাউঞ্জের লাগোয়া দেয়াল। ২০ জনের অধিক আহত হয়, তন্মধ্যে ১৫ জন হাসপাতালে স্থানান্তরিত হন, তার মাঝে ৪ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল। পাকি অমানুষদের দম্ভ চুরমার হয়ে যায়।পরদিন বিশ্বজুড়ে বড় বড় পত্রিকায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে মুক্তিবাহিনীর অভিযানের সচিত্র খবর প্রকাশিত হয়। অবরুদ্ধ ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদেও প্রকাশিত হয় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের গেরিলা হামলার সংবাদটি।

মুক্তিযুদ্ধের আগে ও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা এ হোটেল থেকে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের শেষভাগে এই হোটেল ‘নো ওয়ার জোন’ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল।

★★(ছবিটি ১৯৬৬ সালে তোলা। এ ছবিটি থেকে সে সময় এর পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া সম্ভব।)

Leave a Reply