রহস্যময়ীর সঙ্গে দেখা

Share on Facebook

কথায় বলে, মানুষের সুখের দিন খুব দ্রুত বয়ে চলে। প্যারিসেও আমার স্বপ্নের দিনগুলো সুখ স্রোতের মতো পার হয়ে যাচ্ছিল। এদিকে ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে আসছে। ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড তাগিদ অনুভব করছি, ‘ছবির দেশ কবিতার দেশে’র যা দেখার দ্রুত দেখে নাও। জীবনে আর আসা হয় কি না হয়! আবার আমার রয়েছে প্রচণ্ড আলসেমি। আমার অঙ্গে অঙ্গে নিয়ত বাজে যে কথা, ‘আজ নয় কাল হবে’। এই অলসতার জন্যই জার্মানি ও ইতালি ভ্রমণ বাতিল করেছি। বরং ড্রিজলিংয়ের সেই ভোরে মনে হয়েছিল ঘুমের থেকে ভালো কিছু পৃথিবীতে নেই। এই নিয়ে আমার স্বামী বেশ উষ্মা প্রকাশ করলেন। যাই হোক, যত অলসই হই না কেন প্যারিসে গিয়েছি অথচ লিসা আপার সঙ্গে দেখা করব না, এ বোধ হয় কেউ স্বপ্নেও ভাবেন না। আমার তো মনে হয়, অনেকে তাঁর প্রেমে দিওয়ানা হয়ে প্যারিসে ছোটেন। সুতরাং তাঁর সঙ্গে দেখা করার দিনক্ষণ ঠিক করে ফেললাম।

ফিরোজ ভাই (বাংলাদেশ এমবাসির কমার্শিয়াল কাউন্সিলর) এবং তাঁর ড্রাইভার নন্দশ্রীসহ বাহন থাকার কারণে প্যারিসের অলিগলি আমাদের নিজেদের চিনে যেতে হয়নি। ল্যুভর মিউজিয়াম কীভাবে যাব, সে চিন্তা ড্রাইভার নন্দ শ্রীর ওপর ছেড়ে দিলাম। এখানে একটা কথা বলে রাখি, প্যারিস যদি কেউ যান আর আপনার সামনে যদি থাকে মাসের প্রথম রোববার অথবা জুলাইয়ের ১৪, তাহলে সোনায় সোহাগা। এই দুদিন সকলের জন্য লুভ্যর মিউজিয়ামে প্রবেশ ফ্রি। আপনিও ১৬ ইউরোর বদলে ফ্রিফ্রি মিউজিয়াম দেখে আসতে পারবেন। তবে সে হলে হাতে সময় নিয়ে যেতে হবে কারণ শুধু বাঙালি নয়, ইউরোপবাসীও ফ্রি পেলে আলকাতরা খেতে পারে। এই দুইদিন আপনাকে দীর্ঘ কিউ পার হয়ে মিউজিয়ামে ঢুকতে হবে। এমনও হতে পারে দুই থেকে চার ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। তো আমাদের সামনে যেহেতু এমন সুযোগ ছিল না সেহেতু আমরা টিকেট কাটার প্রস্তুতি নিয়েই গেলাম।

ল্যুভর মিউজিয়ামে সাপ্তাহিক ছুটি মঙ্গলবার। এ ছাড়া ১ জানুয়ারি, ১ মে এবং ২৫ ডিসেম্বর মিউজিয়াম বন্ধ থাকে। সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আপনি সেখানে ঘুরতে পারবেন। তবে বুধ ও শুক্রবার রাত ৯টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত মিউজিয়াম খোলা থাকে।

সামনে থেকে ল্যুভর মিউজিয়াম

সেদিন সম্ভবত সোমবার ছিল। অন্যদিনের মতোই ঝিরঝিরে বৃষ্টি। আমার স্বামী আগেও ল্যুভর মিউজিয়াম দেখেছেন। তিনি বললেন, দুদিনেও এই মিউজিয়ামের সবকিছু দেখে শেষ করা সম্ভব নয়। অথচ আমরা হাতে মাত্র ছয় ঘণ্টা নিয়ে বেরোব। ব্রেকফাস্ট করে দ্রুত রেডি হলাম। যেহেতু শাড়ি-টিপ পরার হ্যাপা নেই, যেকোনো ড্রেসের ওপর ওভারকোট চাপিয়ে নাও। সুতরাং রেডি হবার জন্য তেমন তাড়া খেতে হলো না। যদিও আমি শাড়িতেও খুব দ্রুত রেডি হতে পারি। সকাল ৮টার দিকে আমরা রওনা হলাম। পথে বংলাদেশ এমবাসিতে ফিরোজ ভাইকে নামিয়ে নন্দশ্রী আমাদেরকে নিয়ে লাবুর্জে ফেয়ার গ্রাউন্ডে নিয়ে গেলেন। সেখানে স্বামী ও মোর্শেদা আপার সরকারি দায়িত্ব। তবে বসে থাকা ছাড়া তেমন কাজ নেই। মেলায় লোকজনের ভিড় নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ থেকে যে কজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী মেলায় অংশ নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যেও ঢিলেঢালা ভাব।

ফেয়ার গ্রাউন্ডে সময় কাটিয়ে দুপুর ১২টার দিকে আমরা রওনা হলাম সেই মোহনীয় নারীর সঙ্গ লাভের উদ্দেশ্যে। রহস্যময় হাসির জন্য বিশ্বব্যাপী যিনি নন্দিতা। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’। এখানে একটা বিষয় জানিয়ে রাখি, প্যারিসের একমাত্র নদী শেইন। এবং আপনি যেদিকেই যাবেন, সেদিকেই এই নারীর লতানো শরীর দেখতে পাবেন। ল্যুভর মিউজিয়ামও এই নদীর ধার ঘেঁষে আড়াআড়ি অবস্থান নিয়েছে। মাত্র ১৫ মিনিটে আমরা সেই নয়নাভিরাম কাচের পিরামিডের সামনে পৌঁছে গেলাম। যদিও আমরা গাড়িতে সেখানে গিয়েছিলাম, তথাপি আপনাদের সুবিধার জন্য মেট্রোর খবরও জানিয়ে রাখি। যেকোনো জায়গা থেকে আপনি ৭ নম্বর মেট্রো ধরে পিরামিড বা ল্যুভর স্টেশনে নামতে পারেন। পিরামিডে নামলে কিউয়ের জন্য মিউজিয়ামে প্রবেশ করতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে এ ক্ষেত্রে ল্যুভর স্টেশনে নামা বুদ্ধিমানের কাজ হবে, কারণ সে ক্ষেত্রে আপনি আন্ডারগ্রাউন্ড দিয়েই সরাসরি মিউজিয়ামে প্রবেশ করতে পারেন।

বলেছিলাম, সকালে ছিল ঝিরঝিরে বৃষ্টি কিন্তু যখন আমরা সেই স্বর্গদ্বারে পৌঁছলাম তখন আকাশ ঝকঝকে। ঠিক আমাদের দেশের শরতের দুপুরের মতো গাঢ় নীলের। প্রাচীন রাজপ্রাসাদতুল্য ল্যুভর মিউজিয়াম আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্বমহিমায়। সামনে সেই ক্রিস্টাল পিরামিড, যেটি আমার সামনে এক অপার বিস্ময় নিয়ে হাজির হয়েছিল। আমরা দ্রুত তিনভাঁজ মনুষ্য সারিতে দাঁড়িয়ে গেলাম। এবং চিরাচরিত বাঙালি কায়দায় সামনে থেকে সামনে জায়গা করে ফেললাম। আমার সামনে একদল শিশু-কিশোর কিচিরমিচির করছে। নীল বেগুনির মিশেল ড্রেস। সম্ভবত কোনো স্কুল থেকে তাদেরনিয়ে আসা হয়েছে। চুলে ঝুঁটি বাঁধা এক কিশোরীর কাছে জানতে চাইলাম, হোয়াট ইজ ইয়োর নেইম বেবি? বড়সড় বেবিটি হাঁ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, কিছুক্ষণ পর ঝুঁটি নেড়ে। বলল, ‘বজু বজু’। এই একটা ঝামেলা এরা ফ্রেঞ্চ ছাড়া অন্য ভাষা জানেই না, এমনকি খুব কম মানুষ পেয়েছি যারা ইংরেজি বুঝে বলতে পারে। আর ততদিনে আমিও জেনে গিয়েছি ‘বজু’ সবার নাম নয়, বরং কারো সঙ্গে দেখা হলে এটা বলেই তাঁরা স্বাগতম জানায়।

যাই হোক, ধান ভানতে শিবের গীত বাদ দিই। সিকিউরিটি পেরিয়ে আমরা যখন পিরামিডের ভেতরে প্রবেশ করলাম, তখন বেলা খানিকটা হেলে পড়েছে। পিরামিডের অভ্যন্তরে আমি অথচ বন্ধু আত্মীয় সেটা জানবে না, সে কি হয়? সুতরাং কিছু সময় চলল ফটোসেশন, সেলফি।

পেছনে সেই বিস্ময়কর কাচের পিরামিড

এই পিরামিডটি ল্যুভরকে অনন্য সৌন্দর্য সংযোজন করেছে। ১৯৮৪ সালে ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরার নির্দেশে এর ডিজাইন কাজ শুরু হয়। তবে পিরামিডের এই সংযোজন শুধু সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য নয়, বরং প্রয়োজন থেকে এসেছে। সময়ের ব্যবধানে ল্যুভরের গুরুত্ব ও খ্যাতি বেড়ে যাওয়ায় এর দশনার্থী বেড়ে যায় প্রচুর। সমস্যা হয়ে যায় মূল প্রবেশপথ নিয়ে। বাড়তি দর্শনার্থীদের চাপ সামলাতে গলদঘর্ম অবস্থা ল্যুভরের। তখনই প্রবেশ লবি হিসেবে এই পিরামিড স্থাপন করা হয়। ধাতব ফ্রেম ও স্বচ্ছ গ্লাসের তৈরি বড় পিরামিডের আশপাশে আরো তিনটি বিভিন্ন সাইজের ছোট পিরামিড রয়েছে। বড় পিরামিডের নিচেই ল্যুভর মিউজিয়ামের মূল প্রবেশ লবি। এই পিরামিডের ভেতরের সিঁড়ি বেয়ে আমরা নিচে নেমে এলাম আন্ডারগ্রাউন্ডে। সেখানেই টিকেট কাউন্টার।

লুভ্যর মিউজিয়ম গড়ে ওঠার ইতিহাস বিশাল। সেই ইতিহাস রচনা করে আমি পাঠকের বিরক্তি উৎপাদন করতে চাই না। শুধু বলে রাখি, এই মিউজিয়ামের মোট আয়তন ছয় লাখ ৫২ হাজার স্কয়ার ফুট। এর চারটি ফ্লোর এবং তিনটি উইং। ডেনন, সুলি ও রিচিলিও। বিভিন্ন উইংয়ে দেশ বা মহাদেশভিত্তিক চিত্রকলা ভাস্কর্য দিয়ে সাজানো হয়েছে। সেসব অনেক বড় প্যাঁচালের বিষয়। আসুন, আমরা আগে ল্যুভরের বিখ্যাত কিছু ভাস্কর্য, চিত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই।

সিঁড়ি বেয়ে উঠেই সামনে যে ভাস্কর্যটি দেখলাম, সেটা প্রথম দৃষ্টিতে আমার কাছে মুণ্ডুবিহীন ডানাওয়ালা পরীর মতো মনে হলো। ছোটবেলা মায়ের কাছে যার গল্প শুনেছিলাম। কিন্তু আমার বিশেষজ্ঞ স্বামী বললেন,এটা ‘উইংড ভিক্টরি অব সামোথ্রেস’। হেলেনীয় যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাস্কর্য। মার্বেল পাথরের তৈরি এই অতুলনীয় মুণ্ডুবিহীন পরীর দিকে তাকিয়ে আমি সামনে এগোলাম।

উইংড ভিক্টরি অব সামোথ্রেস’

সামনে শিল্পের মহাসমুদ্র কী দেখব আর কী মনে রাখব বলুন! ফ্লোর, দেয়াল, রুফ যেদিকে তাকাও সেদিকেই শুধু শিল্প আর শিল্প। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে গেলে সাত দিনেও সব দেখা শেষ হবে না, সুতরাং চোখ বুলিয়ে যেতে লাগলাম ইতালিয়ান, গ্রিক, ঈজিপশিয়ান গ্যালারিগুলোতে। দেখতে দেখতে বারবার হারিয়ে যাচ্ছিলাম কখনো সেই প্রস্তরখণ্ডের যুগে, কখনও রেনেসাঁর যুগে, কখনো বা ক্রুসেডের যুদ্ধক্ষেত্রে। ভাবছিলাম, মানুষ তিল তিল করে এই যে সভ্যতা গড়ে তুলেছিল, হয়তো স্বেচ্ছাচারিতার কারণে নিজেরাই আবার সব ধ্বংস করেছে বা করবে।

প্রায় প্রতি গ্যালারিতেই ভাস্কর্য বা চিত্রকলার সবটাতেই পৌরাণিক দেবদেবীর আধিক্য দেখা গেল। উড়ন্ত দেবদেবীর সংখ্যাও কম নয়। বাইবেলের নানা চরিত্র যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে প্রাক রেনেসাঁস যুগের লোকগাঁথা। জেসাস, ভার্জিন মা মেরির পাশাপাশি ইতালীয় রেনেসাঁ বা মিসরীয়দের গ্রিক চিত্রকলার সমাহার। মোটকথা পুরো বিশ্বের প্রাচীন বা মধ্যযুগের সাক্ষ্য বহন করছে ল্যুভর মিউজিয়াম। তবে মিউজিয়ামের একটা বড় ধরনের নেগেটিভ বিষয় বোধ করছিলাম প্রতিমুহূর্তে। প্রত্যেক চিত্রকলা বা ভাস্কর্যের পাশে যে বর্ণনা রয়েছে, সেগুলো ফরাসি ভাষায় লেখা। সুতরাং সে সম্পর্কে পুরো ধারণা নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। শেষঅবধি মনে একটা প্রশ্ন বা অভিযোগ থেকেই গেল, পৃথিবীর নানা দেশ থেকে আসা মানুষের সংখ্যাই এখানে বেশি, তাহলে ইংরেজি কেন নেই?

পুরো দেয়ালজুড়ে এমন কত কত যে সৃষ্টি!

ল্যুভর মিউজিয়ামে প্রবেশ করে দর্শনার্থীরা সাধারণত মোনালিসার দিকে আগে ছোটেন। কিন্তু আমরা তাড়াহুড়ো করছিলাম না। শেষের আকর্ষণ হিসেবে রেখে দিয়েছিলাম। এর মধ্যে ভিঞ্চির আঁকা একটা তৈলচিত্র আমাকে খুব মুগ্ধ করল ‘দ্য ভার্জিন অ্যান্ড চাইল্ড উইদ সেইন্ট অ্যানি’। চিত্রটিতে মেরির মা এবং ভার্জিন মা মেরিকে খুব মায়াময় ভঙ্গিতে দেখা যায়। চিত্রটিতে যিশু মেষ শাবকের সঙ্গে খেলছেন।

হাঁটতে হাঁটতে মাঝেমধ্যেই দেখতে পাচ্ছিলাম চিত্রকরেরা বসে ছবি আঁকছেন। একখানে দুজন বৃদ্ধা শিল্পীকে দেখে থামলাম। দেয়ালে ঝোলানো চিত্রকলা থেকে তাঁরা দুজনে গভীর মনোযোগে নিজের হাতের ক্যানভাসে ছবি ফুটিয়ে তুলছেন অবিকল।

বিভিন্ন গ্যালারি ঘুরতে গিয়ে ভাস্কর্য বা পেইন্টিংগুলোর বেশিরভাগ নগ্ন নারী। সুনীলের সেই মার্গারিটার কথা মনে হলো ‘ফরাসিরা সবাই তো নগ্ন মেয়ে আঁকে’। এত সুন্দর এত নিখুঁত সেসব মোমের মতো নারী শরীর অথচ কেন জানি আমি প্রাণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। হয়তো এশীয় নারী অবয়ব আমার অধিক পছন্দের। নগ্ন পুরুষ ভাস্কর্যের মধ্যেও পুরুষালি ভাব অনুপস্থিত।

এমন অসংখ্য চিত্রকলায় প্রকাশিত নারী

আমি সুনীল আর মার্গারিটা দেখা রেনোয়ার আঁকা ডায়না খুঁজছিলাম। কিন্তু তাঁরা তো আসলে দেখেছিলেন ল্যুভরের পাশের কোনো প্রদর্শনীতে। অবিকল সেটা পেলাম না তবে ‘ডায়না অব ভার্সাইলস’ নামের ভাস্কর্য দেখলাম। মার্বেল পাথরের তৈরি। সুনীলের বর্ণনা অনুযায়ী এই ডায়না নগ্ন নয় এবং তাঁর পায়ের কাছে মৃত হরিণ নয়, জীবন্ত হরিণ।

ভাস্কর্য ‘ডায়না অব ভার্সাইলস’

সময় শেষ হয়ে আসছিল, তখনো আমাদের অনেক কিছু দেখার বাকি। এবার আর লিসা আপুকে না দেখে উপায় নেই। আমরা জানতাম, মোনালিসার অবস্থান ডেনন উইংয়ের দোতলায়। কিন্তু এই জানার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আপনি দেখবেন যেদিকে মানব স্রোত প্রবহমান, সেদিকেই ‘মোনালিসা’ সেই মানব স্রোত ধরেই আমরা এগোলাম এবং সত্যি আমি তাকে দেখিলাম, চোখ ভরে দেখলাম। বুকে দুহাত ভাঁজ করা ভ্রূহীন সেই নারীকে। ঠোঁটের আগায় রহস্যময় হাসি অথবা ব্যঙ্গ! কিন্তু একি! আমার মধ্যে কোনো ধরনের বিস্ময় তৈরি হলো না; বরং এমন আশাহত জীবনে খুব কমই হয়েছি।

আমার ঘরের ফ্রেমে ঝোলানো যে ‘মোনালিসা’ আকারে চেহারায় অবিকল তাঁকে দেখতেই এত পিপাসা? তাঁকে রাখা হয়েছে বুলেট প্রুফ কাচের দেয়ালের মধ্যে। সামনে কালো ফিতা দিয়ে ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে, যাতে করে মোনালিসা প্রেমিকেরা তাঁকে ছুঁতে না পারেন। এই জায়গাটাতে ভিড় লেগেই থাকে। ভিড়ভাট্টা ঠেলে আমি আর মোর্শেদা আপা যতটা সম্ভব তাঁর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। হতাশ হই আর যাই করি বন্ধুবান্ধবদের তো বলতে হবে এই রহস্যময়ী নারীর কত কাছে ছিলাম আমরা!

লেখকের সঙ্গে রহস্যময়ী মোনালিসা

মোনালিসার বিপরীত পাশে পুরো দেয়ালজুড়ে একটি চিত্র আমাকে মোহিত করল। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে আমি সেটাই দেখছিলাম। ‘ভেরোনিস’ আঁকা তৈলচিত্র ‘দ্য ওয়েডিং এট ক্যেনা’ বাইবেলের একটি গল্প থেকে নেওয়া চিত্রটিতে যিশু পানিকে ওয়াইনে পরিণত করছেন। গল্পটি আমার স্বামী আমাকে না বললে হয়তো বুঝতে পারতাম না।

 ‘দ্য ওয়েডিং এট ক্যেনা’

যাই হোক, এরপর আমরা গেলাম ভেনাসের কাছে। সৌন্দর্য এবং প্রেমের দেবী ‘ভেনাস দ্য মিলো’। যার আরেক নাম ‘আফ্রোদিতি’। মার্বেলের তৈরি এই ভাস্কর্যটি ১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তৈরি হয়েছিল প্রাচীন গ্রিসে। কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না, ঊর্ধ্বাঙ্গ নিরাভরণ এই অসম্ভব আবেদনময়ী দেবীর দুবাহু ভাঙা কেন? যথারীতি আমার সবজান্তা স্বামী জানালেন এই মূর্তিটি ভাঙা অবস্থায় পাওয়া যায় ভূমধ্যসাগরের ‘মিলো’ নামের এক দ্বীপে। এক কৃষক মূর্তিটি খুঁজে পান, পরে ফরাসি নৌসেনারা সেটি নিয়ে আসেন।

‘ভেনাস দ্য মিলো’

আরো কী দেখলাম? কী দেখিনি? কী যত্ন করে ইতিহাসের উৎসের একটি একটি অমূল্য অক্ষর জোগাড় করেছেন তাঁরা! কী মমতায় আগলে রেখেছেন সেসব। আর অক্ষরের পাশে অক্ষর সাজিয়ে সৃষ্টি করেছেন ইতিহাস। এককথায় ভাস্কর্য, চিত্রকলা, ব্যবহৃত নানা তৈজসপত্র, মুদ্রা, মিসরীয় মমি সবকিছুর মধ্য দিয়ে প্রাচীন থেকে হাল আমলের জীবন, ধর্ম, যুদ্ধ সবকিছু চোখের সামনে নান্দনিকভাবে উন্মুক্ত করে রেখেছে লুভ্যর মিউজিয়াম।

আমরা সেসবের অনেক কিছু দেখলাম আবার অনেক কিছু দেখার সময় পেলাম না। তবে সেসবই যাঁরা না দেখেছেন, তাঁরা বুঝবেন না কেন আমি বলতে পারি, ধন্য এই জীবন, সার্থক এ জনম।

শেষ বিকেলের ল্যুভর

সন্ধ্যা নেমে এসেছিল। আমরা ধীরে ধীরে সেই সভ্যতা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামলাম। তখনো নন্দশ্রী আমাদের নিতে হাজির হয়নি। ফটকের ওপাশেই শেইন সুন্দরী লতানো শরীর নিয়ে শুয়ে আছে। একটু এগোতেই লাভ লক ব্রিজ। এই ব্রিজ সম্পর্কে অনেক পড়েছি। প্রেমি জুটি এখানে তালা লাগিয়ে চাবি ছুড়ে ফেলে দেয় নদীতে। যেন সেটি কেউ খুঁজে না পায়। আর তাঁদের বন্ধন অটুট থাকে আজীবন। ক্রমে সেই তালার পরিমাণ এত বেড়ে গিয়েছিল যে ব্রিজ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়। ফলে ফ্রান্স সরকার সব তালা সরিয়ে ফেলে। আমরা সেই লাখ লাখ লাভলক দেখতে পাইনি। তবে নতুন করে কিছু তালা লাগানো হয়েছে দেখতে পেলাম। ইচ্ছে ছিল আমিও একটা তালা লাগিয়ে ছুড়ে ফেলে আসি চাবি। পড়ে থাকুক সেখানেই, শেইনের বুকে অনাদিকাল। কিন্তু বিধিবাম! আমি কোনো তালা সঙ্গে নেইনি। অতঃপর আমরা লাভ লকের বুকে বেঞ্চে বসলাম।

শেইন নদীর লাভলক ব্রিজে এমন তালা লাগানো শুরু হয়েছে আবার।

সূর্য ডুবেছে। আমরা যেখানে বসে আছি আলো আঁধারের খেলা। দুপাশের স্ট্রিট বাতির আলো এসে পড়ছে শেইনের বুকে। কিছু কিছু প্রমোদতরণী ধীর লয়ে আমাদের অতিক্রম করে যাচ্ছে। সেখান থেকে অচেনা অদ্ভুত ঘোরলাগা স্প্যানিশ গান ভেসে আসছে, আসছে এস্রাজের শব্দ। আলোর বিকিরণে শেইন নদীর স্রোতগুলো করোগেটেড সোনালি সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলছে। আচমকা যেন দূরে কোথাও নীল রঙের হাজার জোনাকি ঝিকিমিকি জ্বলে উঠল। বুঝলাম রাতের লাস্যময়ী লৌহমানবী তার খরিদ্দার ভঞ্জনে প্রদীপ জ্বেলেছে।

দূরতম সেই নীলের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আমি কাছের শেইনের দিকে তাকাই। সেই মুহূর্তে মনে ভাসে আমার গাঁয়ের মহাকবির স্মৃতি, এই শেইনকে দেখেই যার মন কেঁদেছিল নিজের নদীটির কথা ভেবে। আমার আর তাঁর নদীটি যে একই!

নন্দশ্রীর ডাকে যখন আমরা সেই নদীর বুক ছেড়ে আসি তখন আমার মাথায় ঘুরছে,

সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে!

সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;

সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে

শোনে মায়া—মন্ত্রধ্বনি) তব কলকলে

জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে!

বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,

কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?

Leave a Reply