পর্যটন শিল্পের টেকসই উন্নয়নে পালনীয় নৈতিকতা

Share on Facebook

জাতিসংঘ গত বছর ২০১৭ এ পালন করছে International Year of Sustainability  বা আন্তর্জাতিক টেকসই উন্নয়ন বর্ষ। আর এ থীমকে অনুসরণ করে United Nations World Tourism Organizations (UNWTO)  বা জাতিসংঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থা পালন করেছে International Year of Sustainable Tourism যার অর্থ হচ্ছে আন্তর্জাতিক টেকসই পর্যটন উন্নয়ন বর্ষ। ২০১৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘উন্নয়নের জন্য চাই টেকসই পর্যটন’। গত ২০১৫ সালে সহস্্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পার হয়ে এখন বিশ্ববাসীর আগামী ১৫ বছরের অর্থাৎ ২০৩০ সাল পর্যন্ত উন্নয়নের নীতি হচ্ছে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট  বা Sustainable Development Goal (SDG) । টেকসই উন্নয়নের জন্য জাতিসংঘ আওতাভূক্ত বিভিন্ন সংস্থা কিছু নীতিনৈতিকতা যোগ করেছে। এ সংক্রান্ত বিষয়ে প্রকাশ করছে বিভন্ন প্রকাশনা। যেমন UNWTO প্রণয়ন করেছে Global Code of Ethics বা বিশ্বব্যাপী পর্যটন শিল্পে পালনীয় আচরণবিধি। এগুলো টেকসই পর্যটন উন্নয়নের জন্য অত্যান্ত জরুরী। এ শিল্পের সাথে জড়িত সকল অংশীজনের (stakeholders)  জন্য প্রযোজ্য। আমরা যদি বলি পর্যটন শিল্পের অংশীজন হচ্ছে সার্ভিস প্রোভাইডার, ট্যুর অপারেটর, হোটেল-মোটেল-বোটেল এবং বার এর মালিক, ট্র্যাভেল এজেন্সি, পর্যটক, সাইট ম্যানেজার, জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান, ট্রান্সপোর্ট মালিক এরকম প্রায় আরো ২০-২৫ টি সেক্টর।

গ্লোবাল কোড অব এথিক্স পর্যটক অর্থাৎ সেবা গ্রহিতা এবং সেবা প্রদানকারী উভযেরই মেনে চলতে হবে।  যেমন: কোন সার্ভিস প্রোভাইডার যেমন হোটেল-মোটেল-বোটেল এবং রেস্টুরেন্ট-বার-রিসোর্ট এর সার্ভিসে মালিক শিশুদের ব্যবহার করবেন না। কিংবা শিশুদের পর্যটন শিল্পে কোন প্রকার যৌনহয়রানীমূলক কাজে এনগেজ করবে না। পর্যটকরা শিশুশ্রম ভোগ করবে না। শিশুদেরকে যৌনহয়রানী করবে না। পর্যটকদের কোন অবস্থায় ট্যুর অপারেটর ঠকাবে না, কোন নারী পর্যটকের যৌন হয়রানী করবে না ইত্যাদি।

টেকসই পর্যটন উন্নয়নের আরেকটি দিক হচ্ছে প্রকৃতি-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্রের সংরক্ষণ, স্থানীয় জনগনের আর্থিক উপার্জন এবং সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা। পর্যটকরা যখন কোন ডেস্টিনেশনে বেড়াতে যাবে খেয়াল রাখতে হবে সে যেন প্রকৃতির কোন প্রকার সামান্যতম ক্ষতি না করে। এমন কাজ করবেনা যা স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়। এ জন্য বলা হয়েছে – ট্র্যাভেল, ইনজয় এন্ড রেসপেক্ট। আবার পর্যটকদের খেয়াল রাখতে হবে যাতে তাঁদের ব্যয়কৃত টাকা স্থানীয় জনসাধারণও উপকার পাচ্ছে। এ জন্য স্থানীয় সম্প্রদায় কর্তৃক প্রস্তুতকৃত খাবার আস্বাদন এবং স্যুভেনির ক্রয় করতে পারে। এক্ষেত্রে যতটা কম দরকষাকষি করা উচিত। কারণ ২-৩ টাকা বেশি দামে স্থানীয় খাবার এবং স্যুভেনির পর্যটকরা ক্রয় করলে এ টাকাটা সরাসরি স্থানীয় মানুষই পাচ্ছে যারা হচ্ছে স্থানীয় পর্যটন আকর্ষণ এবং সম্পদের মালিক এবং বংশপরম্পরায় এগুলো রক্ষা করে আসছে।

বাংলাদেশে টেকসই পর্যটন উন্নয়নের জন্য বিশ্ব পর্যটন সংস্থার সাথে ইতোমধ্যে অনেকগুলো কর্মসূচি পালন করছে। এর মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হচ্ছে গত ১৬-১৭ মে ২০১৭ চট্টগ্রামে দুই দিনব্যাপী বিশ্ব পর্যটন সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় ‘ক্রাইসিস কমিউনিকেশন’ এর উপর সেমিনার এবং বিশ্বব্যাপী পালনীয় ‘আন্তর্জাতিক টেকসই পর্যটন উন্নয়ন বর্ষ’ পালনের জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। এবং পরেরদিন  UNWTO এর ২৯তম কমিশন ফর সাউথ এশিয়া এবং কমিশন ফর এশিয়া এন্ড দ্য প্যাসিফিক এর সম্মেলন। বাংলাদেশ এতে অনেক লাভবান হয়েছে। সাথে ছিল চট্টগ্রাম বিভাগের উপর বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন কর্তৃক প্রকাশিত একটি পিক্টোরিয়াল বই। বর্ণিত সেমিনারে UNWTO এর মহাসচিব ড. তালেব রিফাই  ও সাবেক মাননীয় পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এর হাতে ১০ হাজার ইউরোর চেক হস্তান্তর করেন এ দেশের ওয়াইল্ডলাইফ ট্যুরিজম এর উন্নয়নের জন্য। ক্রাইসিস কমিউনিকেশন সেমিনারে বলা হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে আছে। এর জাতীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার পরিকল্পনার সাথে ট্যুরিজমকে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। এভাবে পর্যটন শিল্পের আশু বিভিন্ন দুর্যোগ সহজেই মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। এবং এটি টেকসই উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশ UNWTO প্রণীত এষড়নধষ Global Code of Ethics বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রথমত এটিকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে এবং সরকারের আইন মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মুদ্রণ করে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের নিকট প্রেরণ করা হয়েছে। গ্লোবাল কোড অব এথিক্স বইটিতে পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষা করে পর্যটন উন্নয়ন, পর্যটন শিল্পে জোরপূর্বক শ্রম বন্ধ, শিশুশ্রম বন্ধ, শিশুদের যৌনহয়রানী বন্ধসহ স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনসহ নানাবিধ বিষয়ে গুরুত্বসহকারে স্থান পেয়েছে। এখানে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন, প্রতœবস্তুসহ পর্যটন আকর্ষণ রক্ষা, স্থানীয় জনসাধারণের পর্যটন শিল্পে অংশ্রগহণে জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং পর্যটন কর্মকান্ডের মাধ্যমে জীবিকায়নের উদ্বুদ্ধকরণের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া, টেকসই পর্যটন উন্নয়নের জন্য করণীয় বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। বর্ণিত আচরণবিধিতে পশু-পাখির বংশবৃদ্ধি ব্যাঘাত বন্ধ করা, বহন ক্ষমতার বাইরে পর্যটকদের আমন্ত্রণ জানানোর উপর বিধিনিষেধ আরোপ করার সুপারিশ করেছে। এছাড়া, উক্ত আচরণবিধিতে নারী, শিশু, বয়স্ক এবং প্রতিবন্ধী মানুষের পর্যটন গন্তব্যে সহজ গমনাগমনের জন্য অবকাঠামোর সৃষ্টির উপর গুরুত্বারোপ করেছে। আরো বলা হয়েছে কোন পর্যটকদের প্রতি সহিংস আচরণ থেকে বিরত থাকতে হবে। এরকম পরিবেশ তৈরী করতে হবে যাতে পর্যটক এবং সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান কেউ জাতি, বর্ণ, ধর্ম এবং লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার না হয়।

বাংলাদেশের পর্যটন উন্নয়ন নীতিমালা ২০১০ এ টেকসই পর্যটন উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। আর এই টেকসই উন্নয়নের জন্য গ্লোবাল কোড অব এথিক্স বাস্তবায়নের নিদের্শনা রয়েছে উক্ত নীতিমালায়।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল নীতি (National Integrity Policy)    প্রণয়ন করেছে যা প্রতিটি মন্ত্রণালয়, দপ্তর এবং সংস্থাসমূহ বাস্তবায়ন করছে। পর্যটন শিল্পে এষড়নধষ ঈড়ফব ড়ভ ঊঃযরপং বাস্তবায়নের জন্য সরকার এর শুদ্ধাচার এর সাথে  সংশ্লিষ্ট দপ্তর সংস্থামূহ পর্যটন শিল্পে পালনীয় আচরণবিধি যুক্ত করে নানবিধ কর্মসূচী গ্রহণ করতে পারে।  এক্ষেত্রে পর্যটন শিল্প উন্নয়নে জড়িত  প্রাইভেট স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ে একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা যেতে পারে।

আমরা যদি এই Global Code of Ethics মেনে চলতে পারি তাহলে বাংলাদেশ টেকসই পর্যটন উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হতে পারবে। এছাড়া, জাতিসংঘ ঘোষিত SDG অর্জনেও একটি মডেল দেশ হতে পারবে।

লেখক: মোঃ জিয়াউল হক হাওলাদার

বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন এর কর্মকর্তা।

Leave a Reply