খুলনার বহু বছরের পুরনো জোড়া শিবমন্দির

Share on Facebook

খুলনার সাতক্ষীরা শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে আছে ‘ছয়ঘরিয়া জোড়া শিবমন্দির, নানা বৈচিত্র্যের টেরাকোটা ইটে নির্মিত ‘ছয়ঘরিয়া জোড়া শিবমন্দির।

দেশের কয়েকটি বিখ্যাত মন্দিরের মধ্যে একটি খুলনার জোড়া শিবমন্দির। এই মন্দিরের খ্যাতি রয়েছে দেশ ও দেশের বাইরে।

সুন্দরবনের হৃদয়-ছোঁয়া বনবনানীর আবাসন দিয়ে ঘেরা ভৈরব নদসহ অসংখ্য নদ-নদী সমৃদ্ধ শিল্পনগরী খুলনা জেলার প্রত্ননিদর্শন সম্বলিত ৭৪টি প্রত্নস্থলের মধ্যে একটি প্রত্নস্থলের নাম জোড়া শিবমন্দির। খুলনা জেলার অধিকাংশ প্রত্নস্থল দূরবর্তী ও যোগাযোগবিচ্ছিন্ন এলাকায় অবস্থিত হলেও এই জোড়া শিবমন্দির শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। খুলনার মূল শহরের ৫নং ঘাট এলাকায় এ প্রত্নস্থলের অবস্থান।

খুলনার পাওয়ার হাউজ মোড় সংলগ্ন বিআইডব্লিউএ ভবনের উত্তর দিকের অনতিদূরে রিকশায় কিংবা পায়ে হেঁটে গেলে সহজেই চোখে পড়ে ৫নং ঘাট। ঘাটে আছে অসংখ্য কার্গো-জাহাজ। নদী-তীরে আছে স্তূপাকৃত সারের মজুদ ত্রিপল দিয়ে ঢাকা। আছে বেশ কিছু দোকানপাট। রাস্তার পশ্চিম পাশেই আছে ঐতিহাসিক জোড়া শিবমন্দির। এ প্রত্নস্থলে পাশাপাশি দুটি পূর্বমুখী মন্দির দাঁড়িয়ে আছে। দুটি মন্দিরই একই আকৃতিতে   তৈরি।

জোড়া শিবমন্দিরের প্রতিটির বৈশিষ্ট্য অপরিসরের বর্গাকার মূর্তিকোঠা, কৌণিক খিলান-দরজা, বাঁকা কার্নিস, আট চালাকার শিখর এবং পলেস্তারা ও চুনকাম করা দেয়াল। ভেতরের পরিমাপ ২.৮৫ মি./ ৯’-৪” ও ২.৮৫ মি./ ৯’-৪”  এবং বাইরের পরিমাপ ৪.৬০ মি./১৫’-১”  ও ৪.৬০ মি./১৫’-১” । কেবল পূর্ব ও দক্ষিণের প্রতিটি দিক থেকে একটি করে খিলান-দরজা দিয়ে প্রবেশযোগ্য এসব মন্দিরের খিলান একাধিক স্তরে গঠিত দেয়াল খিলান নকশার মধ্যে আবদ্ধ অবতলপটে সংস্থাপিত হয়েছে। প্রতিটি খিলান-দরজার ওপর পরিচিত ফলক স্থাপনের উপযোগী শিল্পভূমি রয়েছে। একটি মন্দিরের কার্নিসের নিচের দু’সারি খোপ নকশা শোভা পাচ্ছে।

মন্দির দুটির উত্তর দিকে একটি বড় দীঘি ছিল। এক সময় দীঘিতে শান বাঁধানো ঘাট  ছিল। জনশ্রুতি আছে, বাংলা ১৩৪৩ সনে এ স্থানটিতে জনৈক বলদেব আগরওয়ালা নামে একজন মাড়োয়ারি একটি বাগান নির্মাণ করেছিলেন। বর্তমানে বাগানটির কোনো  চিহ্ন নেই। তাছাড়া ১৮৮০ সালে খুলনা রেলওয়ে স্টেশন তৈরির সময় সংলগ্ন দীঘিটির একাংশ  ভরাট করে ফেলা হয়েছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে মন্দিরটির লাগোয়া জমিতে একটি পাঠশালা ছিল বলেও জানা যায়। কিন্তু এখন সেই পাঠশালার কোনো অস্তিত্ব আর নেই। আরও জানা যায়, জোড়া শিবমন্দির প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিবরাত্রি উপলক্ষে আটদিনব্যাপী বিশাল মেলা বসতো এই মন্দির প্রাঙ্গনে কিন্তু ১৯৬৪ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার পর থেকে মেলার আয়োজন বন্ধ হয়ে যায় এবং দুটি মন্দিরই দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে।

সরেমজিনে জোড়া শিবমন্দির পরিদর্শন করে নির্ভরযোগ্য সূত্রে ও প্রত্নস্থলের বিভিন্ন তথ্যাদির আলোকে জানা যায়, ১১০৪ বঙ্গাব্দে শ্রী কৃষ্ণরাম বসু জোড়া শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। অতঃপর স্বর্গীয় মূলচাঁদ মুন্ধড়া ও মাতৃদেবী স্বর্গীয়া আন্চা দেবীর স্মরণে শ্রী শিবকৃষ্ণ মুন্ধড়া দুটি শিবমূর্তি বা শিববিগ্রহদ্বয় প্রদান করেন। পরে কে বা কারা মূর্তিদুটি অন্যত্র নিয়ে গেলে একজন রেলওয়ে কর্মকর্তার স্ত্রী কাশী থেকে পাঁচটি মূর্তি এনে সেখানে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে সেগুলো না থাকলেও দুটি পাথরের মূর্তি এখনও পরিলক্ষিত হয়।

খুলনার কুখ্যাত সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদারের সময়কালে জোড়া শিবমন্দির দুটি আবারও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। সেখানে পূজা-অর্চনা, নামযজ্ঞ, কীর্তন, ধর্মীয় শোভাযাত্রাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি রহিত হয়। প্রায় ১৫/১৬ বছর ধরে এ অবস্থা চলতে থাকে। কুখ্যাত এরশাদ শিকদারের পতনের পর ২০০২ সালে খুলনা শহরের তৎকালীন মেয়র শেখ তৈয়বুর রহমান মন্দিরের পাশেই একটি নলকূপ স্থাপনসহ ২০০৩ সালে মন্দির সংস্কারকার্য সম্পাদনে নামফলক স্থাপন করেন। মন্দির উন্নয়নে সক্রিয় সহযোগিতা প্রদান করেন খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার জনাব আনোয়ারুল ইকবাল পিপিএম। ২০০১ সালে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী তালুকদার আব্দুল খালেক জোড়া শিবমন্দিরের সম্মুখস্থ প্রাঙ্গনে বিশাল নাটমন্দির নির্মাণ করেন । ঐ নাটমন্দিরে এখন নামযজ্ঞ, কীর্তনসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন হয়।

জোড়া শিবমন্দিরের তিনটি গেট ও চতুর্পার্শ্বে প্রাচীর রয়েছে। একটি গেট সারাক্ষণ বন্ধ থাকে।

প্রতি বাংলা মাসের শেষ সোমবারে নাটমন্দিরে বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়। শিব চতুর্দশীতে শিবের মাথায় জল ঢালা হয়। ধর্মীয় শোভাযাত্রায় শিবের মাথায় জল ঢালতে প্রতিবছর ৫০ হাজার ভক্তের আগমন ঘটে। মন্দিরের পূজা-অর্জনা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি পরিচালনা করেন খুলনার ধর্মসভার পূজারী শ্রী রবিনচন্দ্র পন্ডিত। মন্দির সংরক্ষণে দায়িত্ব পালন করছেন নিতাই চন্দ্র দাস ও লিটন চক্রবর্তী।

মন্দিরের সীমানায় ৫টা বিভিন্ন প্রকারের ফল ও ফুলের গাছসহ প্রায় সাড়ে তিনশ বছরের পুরাতন একটি বট গাছ রয়েছে। চারিদিকে সুসজ্জিত শান বাঁধানো। এ মন্দিরটির আরও   উন্নয়ন ও   নিরাপত্তার জন্য প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে।

Leave a Reply