কংক্রিটের ভারে মুমূর্ষু সেন্টমার্টিন দ্বীপ

Share on Facebook

ইটের দালানকোঠার ভারে  দিন দিন বিপন্ন
হয়ে পড়েছে সেন্টমার্টিন। এভাবে চলতে থাকলে দ্বীপ হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন
সেখানকার বাসিন্দারা। দ্বীপে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা আবাসিক হোটেল ভেঙে ফেলতে দুই বছর
আগে নির্দেশ দেন আদালত। তা বাস্তবায়ন তো দূরের কথা বরং দিন দিন দ্বীপে বাড়ছে
দালানকোঠার সংখ্যা।

সৈকত সংলগ্ন এলাকার কেয়াবন ও ঝোপঝাড় কেটে ফেলা হচ্ছে হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট ও দোকান নির্মাণের জন্য। হোটেলের জেনারেটরের শব্দের ফলে দূষিত হচ্ছে শব্দ। পর্যটন মৌসুমে মানুষের অতিরিক্ত চাপের কারনেও পানি ও পরিবেশ দূষণ হুমকিতে পড়েছে দ্বীপের প্রায় ৬৮ প্রজাতির প্রবাল।

বিপন্ন হয়ে উঠেছে সেন্টমার্টিনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য।

দ্বীপের জেটিঘাট থেকে
দেড় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পশ্চিমে পাড়া। সেখানে সাবেক ইউপি সদস্য রশিদ আহমদের
ছেলে মোহাম্মদ বেলাল উদ্দিনের নতুন বাড়ি নির্মাণ করতে দেখা যায়। বেশ কয়েজন শ্রমিক
প্রবালের টুকরাগুলো দিয়ে বানাচ্ছেন সীমানা প্রাচীর। পাচঁটি কক্ষের মধ্যে দু’টি কক্ষের দেয়াল তোলা
হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, এভাবে দ্বীপের পশ্চিম, মাঝার ও কোনা পাড়ায় আরও বেশ কয়েকটি দালান তুলতে দেখা গেছে। এর মধ্যে
সরকারি-বেসরকারি কর্তৃপক্ষের পাকা ভবনও রয়েছে। এছাড়া দ্বীপে অবাধে আহরণ হচ্ছে
শামুক-ঝিনুক-পাথর।

বাড়ি নির্মাণের বিষয়ে
বেলাল উদ্দিন বলেন, ‘দ্বীপ কর্তৃপক্ষের কাছ অনুমতি নিয়ে দালান নির্মাণ করছি। দ্বীপে শুধু আমি
একা এ কাজ করছি না। এখানে আরও অনেকে দালান নির্মাণ করছেন। তাছাড়া এখানে বিশাল ভবন
নির্মাণ হয়েছে। এতে দ্বীপের কিছু সমস্যা হয়নি। সামান্য এই দালান নির্মাণ করলে
দ্বীপের বড় ক্ষতি হবে না।’

দ্বীপের কয়েকজন
ব্যবসায়ী জানায়, দ্বীপের উত্তর অংশের এক বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে গড়ে উঠেছে ৮৪টিরও বেশি
হোটেল-মোটেল ও ৩০টি রেস্টুরেন্ট। গত পাঁচ বছরে ৫৬টির মতো বহুতল হোটেল তৈরি হয়েছে।

গড়ে উঠছে নতুন নতুন সব দালান-কোঠা

এ বিষয়ে জানতে চাইলে
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, ‘দালানের ভারে দিন দিন
দেবে যাচ্ছে সেন্টমার্টিন। ফলে সামান্য জোয়ার পানি বাড়লে দ্বীপের চার দিকে ভেঙে
যাচ্ছে। গত দুই বছরে দ্বীপের দক্ষিণ পাড়া, হরা বনিয়া,
গলাচিপা, জাদির বিল, কোনা
পাড়া, উত্তর বিল, পশ্চিম পাড়া, ডেইল পাড়াসহ ১৫টি জায়গায় দেড় শতাধিক ঘর ভেঙে গেছে।’

কেউ দ্বীপ নিয়ে
চিন্তা করছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন,
‘শুধু পর্যটন অর্থনীতির সুফল আদায়ের লোভে একের পর এক ভবন নির্মাণ করা
হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে দ্বীপ একদিন হারিয়ে যাবে।’ 

স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, সেন্টমার্টিনে স্থাপনা নির্মাণ করতে গেলেই রাজনৈতিক নেতাকর্মী, জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কিছু কর্মকর্তার একটি চক্রকে ম্যানেজ করতে হয়। তাদের
যোগসাজশে টেকনাফ থেকে প্রায় ৩৪ কিলোমিটারের সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইট, লোহা, সিমেন্ট, বালুসহ যাবতীয়
নির্মাণ সামগ্রী পৌঁছে যায় সেন্টমার্টিনে। সংশ্নিষ্ট দফতর ম্যানেজ থাকায় এসব
নির্মাণ সামগ্রী নির্বিঘ্নে নির্মাণ স্থলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কোনও বাধা ছাড়াই গড়ে
উঠছে হোটেল,কটেজ ও রেস্তোরাঁ। আবার অনেক সময় দ্বীপের তিন
দিকে ছড়িয়ে থাকা প্রাকৃতিক পাথর ব্যবহৃত হচ্ছে অবকাঠামো তৈরিতে। সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য
রক্ষায় দায়ের করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে দ্বীপে পাকা স্থাপনা নির্মাণ
বন্ধ এবং নির্মিত সব স্থাপনা উচ্ছেদ করতে সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিলেন
সুপ্রিম কোটের আপিল বিভাগ। নির্দেশ অনুযায়ী, সেন্টমার্টিনে
ছোট কিংবা বড় কোনও স্থাপনাই নির্মাণের সুযোগ নেই। কিন্তু তারপরও সেখানে গড়ে উঠছে
একের পর এক স্থাপনা।

২০১১ সালে দ্বীপে পাকা স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ এবং নির্মিত সব স্থাপনা উচ্ছেদ করতে সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোটের আপিল বিভাগ। নির্দেশ অনুযায়ী, সেন্টমার্টিনে ছোট কিংবা বড় কোনও স্থাপনাই নির্মাণের সুযোগ নেই। কিন্তু তারপরও সেখানে গড়ে উঠছে একের পর এক স্থাপনা।

সেন্টমার্টিন হোটেল
মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি মুজিবুর রহমান বলেন, আদালতের নিষেধাজ্ঞা পর তারা রায়ের
বিরুদ্ধে আপিল করেন। এখন বিষয়টি আদালতের মাধ্যমের নিষ্পত্তি হবে। নিষেধাজ্ঞার পর
থেকে তারা নতুন কোনও অবকাঠামো নির্মাণ করেনি। আগে যেসব হোটল ছিল সেগুলোতে
কার্যক্রম চলছে।

পরিবেশ অধিদফতর
কক্সবাজার কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, ‘সেন্টমার্টিনে নতুন
করে দালানকোঠা নির্মাণের সুযোগ নেই। যারা দ্বীপে এসব কাজ করছেন তাদের বিরুদ্ধে
পরিবেশ আইনে মামলা করা হবে। আগে যেসব হোটেল-মোটেল ভাঙার নিদর্শনা ছিল, সেসব হোটেল মালিক কর্তৃপক্ষ আদালতে আপিল করেছে। এজন্য আগের নির্দেশনা
কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তা দেখছি আমরা।’

কক্সবাজার উন্নয়ন
কর্তৃপক্ষ চেয়ারম্যান লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) ফুরকান আহমেদ বলেন, ‘সেন্টমার্টিন নিয়ে
সরকারের নির্দেশনা রয়েছে। সেগুলো কেউ অমান্য করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা
ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) কক্সবাজারের প্রধান নির্বাহী এম ইব্রাহিম খলিল
মামুন বলেন, ‘দুই বছর আগে দ্বীপে পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া গড়ে ওঠা আবাসিক হোটেল-মোটেলসহ
১০৬টি ভবন ভাঙার নির্দেশনা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। আদালতের সুষ্পষ্ট নির্দেশ
থাকা সত্ত্বেও প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা সেন্টমার্টিনে গড়ে উঠছে নানা স্থাপনা। এ
বিষয়ে কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে না। সরকারের কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন এ বিষয়ে।’

টেকনাফ উপজেলা
নির্বাহী অফিসার রবিউল হাসান বলেন, ‘সেন্টমার্টিনে নতুন করে কোনও
দালানকোঠা নির্মাণ করতে দেওয়া হবে না। যারা এ কাজ করছেন তাদের বিরুদ্ধে আইনি
ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

Leave a Reply