আমাদের শত হুল্লোড়েও ভাঙলোনা গুলিয়াখালীর নিস্তব্ধতা

Share on Facebook

নিজেকে প্রশ্ন করি প্রায়ই, ‘তোমার বাপু নেই সময় আর সুযোগের কোনটাই! কেন তবে মরো এতোবার উড়ে বেড়াবার শখে?’ নিথর জলের মহামায়ার মায়াজাল কেটে বেরোতে পারলেও হৃদয়ের ক্ষুদ্র একটা টুকরো ফেলে এলাম তার কাছেই। প্রকৃতির মোহ আচ্ছন্ন মন নিয়েই রওয়ানা হলাম সবাই আবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে। এবারের ঠিকানা সীতাকুন্ড।

মোহাচ্ছন্নতা
কাটিয়ে উৎফুল্ল হয়ে এলাম
সবাই আবার ধীরে ধীরে। এমন সময়ে দূর থেকেই নজরে এলো সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ
পাহাড়। যদিও যাচ্ছি না আজ আমরা পাহাড়ে, তবে ঠিক করে ফেললাম তক্ষুনি যে সামনেই কখনো
যাবো আবার। আসন্ন সব ট্রিপের প্ল্যান করতে করতে চিৎকার-চেঁচামেচি আর হুল্লোড়ের একটা পশলা বয়ে গেলো গাড়ির ভেতরটায়। সবাইই যে থাকছি নামহীন সেই
ট্রিপেতেও!

গল্পে গল্পে সময়
আর রাস্তা দু’টোই ফুড়িয়ে, দুপুর ১টা ৩০মিনিটের দিকে পৌঁছে গেলো গাড়ি সীতাকুন্ড
বাজারে। কাছেই থানায় গাড়ি পার্ক করে লাঞ্চের জন্য ঢুকলাম সবাই পাভেলের সাজেস্ট করা
হোটেলে। ভরদুপুর হবার কারনে হোটেল ভরপুর মানুষের ভীড়ে। এরই মাঝে জায়গা খুঁজে দু’টো
টেবিলে বসে পড়লাম সবাই। ভাত, ডাল, ভাজি, ৫-৬ প্রকারের ভর্তা, গরুর ভুনা আর মাছ
দিয়ে হাসাহাসি আর আয়েশ করে খাওয়া সারতে সারতে বেজে গেলো প্রায় আড়াইটা।

তাড়াহুরায় রওনা
হলাম এবার গুলিয়াখালী সৈকতের দিকে। ২০-২৫মিনিটের ড্রাইভের পরেই এসে গেলো
গুলিয়াখালী। যারা কক্সবাজার কিংবা সেন্টমার্টিন কিংবা কুয়াকাটা ঘুরে এসেছে, আমার
একথা শুনে হাসবে সবাই জানি। কিন্তু আমরা যারা আগে কখনো সাগর দেখিনি, উত্তেজনা চেপে
রাখতে কষ্ট হচ্ছিলো এবারে তাদের। দুধের স্বাদ ঘোলেই নাহয় হোক, সে পিপাসা তবু একটুওতো
মিটুক!

গাড়ি রেখে পথ এবারে
পায়ে হাঁটার। জোয়ার নেমে গেছে দুপুরের আগেই। দুই দলে ভাগ হয়ে সামনে যাচ্ছি সবাই। বেশি
বেশি খুশীতে আমি আছি সামনের দলে। শুকনো খোলা মাঠ শেষে শুরু হলো সবুজ ঘাসে ছাঁওয়া
মাটি। একটা-দুটো করে কেওড়া গাছ বাড়ছে সামনের দিকে। এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে আছে ঝুপড়ির
মতো অস্থায়ী কিছু দোকান। আর চোখের সামনে ঝাউগাছের ফাঁকে দিয়ে খানিক দূরেই দেখা
যাচ্ছে বহুল আকাঙ্খিত সাগর। একটা গাছের ডালে দড়ি আর একটুকরো কাঠের তক্তা দিয়ে বানানো
দোলনায় দোল খাচ্ছে ছোট এক ছেলে। আমার পাশেই হাঁটছিলো রাবেয়া। আমি দোলনা দেখেই বলে
উঠলাম রাবেয়াকে, ‘আমি দোলনায় চড়বো!’ আমার কথা শুনতে পেয়ে ছেলেটা নেমে গেলো সাথে
সাথে দোলনা থেকে। বললো, ‘চড়েন!’ রাবেয়াকেও সাঁধলাম দোলনায় চড়ার জন্য। কিন্তু হাসতে
হাসতেইতো সে খুন হয়ে যাচ্ছে আমার কথা শুনে, দোলনায় আর কি চড়বে! দোলনায় উঠে সাগরের
দিকে ফিরে দোল খেতে খেতে সাগর দেখলাম খানিকক্ষণ। ততক্ষনে পেছনের দলের বাকিরাও এসে
গেছে। মিঠু আর শাহাদাতের হাসাহাসি বেশি শুরু
হওয়ার আগেই উঠে পড়লাম দোলনা ছেড়ে।

আরেকটু সামনে
এগুতেই খানিকটা ঢালু হয়ে গেলো উঁচুনীচু কেওড়ার বন। এখানে উচু মাটিতে ঘন সবুজ ঘাস।
আর গর্তের মতো নীচু মাটিতে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেওড়ার শ্বাসমূল। জোয়ার এলে পানিতে
ভরে যায় এসব। কেওড়ার সারি শেষ হতেই শুরু সমুদ্র সৈকতের। কিন্তু পরম স্বাদের সাগরের
জল যে তখনো আরও অনেক দূরে! পাড়ি দিতে হবে কাঁদায় ডুবন্ত সৈকতটাকেও। বর্ণা, রাবেয়া
আর আমি প্রায় নেমেই যাচ্ছিলাম যখন কাঁদায়, পেছনে থেকে ডেকে থামালো বাকিরা। সাধের
সেই রসমালাই খাওয়া যে বাকি আছে আমাদের এখনো!

অগত্যা ফিরে এলাম
আমরা। বনভোজের মতো গোল করে মাটিতে বসে খেতে খেতে হাসাহাসি চললো আরেকদফা। কিন্তু
এতো কাছে সাগর রেখে ডাঙায় বসে কতক্ষণইবা আর থাকা যায়! আর সইতে পারলাম না আমরা। বাকিদেরকে
রেখেই পারভেজ, জ্যোৎস্না, বর্ণা,
রাবেয়া আর আমি নেমে গেলাম কাঁদার রাজ্যে। এপারে থেকে দেখছি কেবল নিথর জলে ছড়িয়ে
ছিটিয়ে নোঙর করা মাছ ধরার নৌকো। ছুঁয়ে দেয়া যাবে যেন হাত বাড়ালেই! কিন্তু কাঁদা
মারিয়ে পানির কাছে পৌছালাম যখন, আমাদের প্রায় হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে নেয়া প্যান্টও তখন
কাঁদায় মাখামাখি। কিন্তু কাঁদায় ডুবে গেলেইবা কি যায় আসে তখন! সামনেই যে নিশ্চুপ
ঘুমিয়ে আছে সাগর সূর্যের আলোয় হালকা সোনালী তরল বুকে নিয়ে। প্রথম দর্শনেই প্রেমে
পড়ে যাওয়ার মতোই যে রূপবান সে!

ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ এসে
ভাঙছে সৈকতে। তীরের কাছে বালুতে ঘোলা জলের শান্ত সাগর। নাকি আমাদের জন্যই শান্ত হয়ে অপেক্ষায় ছিলো সে! একে একে সবাই আমরা
নেমে পড়লাম পানিতে। হাঁটুজলে নেমেই জলকেলি শুরু করলো বর্ণা। যোগ দিলাম আমরাও। ভিজে
চুপসে যেতেই ক্যামেরা মোবাইল সব রেখে আসা হলো শুকনোয়। দূর দূর পর্যন্তও লোকজন নেই
তেমন কেউ। অল্প কিছু ছেলে এসেছে, সম্ভবত আমাদের মতোই দূর কোথাও থেকে। আর আছে কিছু সাদা
গাঙচিল। ধ্যানে বসছে মাঝে মাঝেই নোঙর করা নৌকাগুলোতে। কিন্তু শুধু আমরা ছাড়া আর
কেউই যেন চায় না আজ ঘুম ভাঙুক সাগরের। নিস্তব্ধতায় ডুবে আছে পুরো সৈকত, পুরো জগৎটাই। আমাদের শত হুল্লোড়েও
ভাঙলোনা সে নিস্তব্ধতা। বরং ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ
করে দিলো আমাদেরকেই। যে শান্তির খোঁজে বেড়িয়েছিলাম আমরা একদল অস্থির দস্যু, ঠিক
তারই খোঁজ দিলো সে আমাদের। যেন কোন ধ্যানগুরু দীক্ষা দিচ্ছে তার শিক্ষানবিসদেরকে। আর
ঠিক তখনই আমি প্রেমে পড়লাম আবার তার।

“এতো সহজেই ভালোবেসে ফেলি কেন!
বুঝি না আমার রক্তে কি আছে নেশা-”
আমার জন্যই কি লিখেছিলেন রুদ্র এটা!

সূর্যাস্তের খানিক আগে সোনালী সূর্যের গায়ে প্রথমে রঙ ধরলো কমলা, তারপর লাল। সূর্যের সাথে সখা হয়েই নিজের জলেরও রঙ পাল্টে নিলো সাগর। রঙিন জলের সাগরে প্রিয় বন্ধুদের সাথে দাঁড়িয়ে মুগ্ধতার ধ্যানে সে রূপে ডুবে যেতে যেতে বোধ করলাম, সূর্যের শেষ আলোটার সাথে সাথেই মিলিয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে আমাদের চমৎকার এই দিনটিও।

আরও ট্রাভেললগ পড়ুন, ভ্রমণপিয়াসীর অপেক্ষায় থাকে নিথর জলের লেক মহামায়া

Leave a Reply